ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

ক্ষমা করো পৃথুলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৮
ক্ষমা করো পৃথুলা পৃথুলা রশীদ

সভ্যতার ঊষালগ্নে সমাজের নেতৃত্ব ছিলো নারীদের হাতে, ইতিহাসবিদরাও এমনটাই বলেন। সে সময় সব সিদ্ধান্ত নিতেন নারীরা। কখন কোথায় শিকার করা হবে তাও নির্ধারণ করতেন তারাই।

এরপর প্রস্তর যুগে ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয় মানুষ। তারপর থেকেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শুরু।

এই জমি/বনভূমি আমার, এমন দাবিই প্রথম রক্তপাত ঘটিয়েছিলো; এটাও ইতিহাস লেখকরা খুঁজে বের করেছেন। তারপর থেকেই মূলত, পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার পত্তন, পুরুষতান্ত্রিকতার শুরু। যে পুরুষতান্ত্রিকতা বলতে শেখায়- অ্যারোপ্লেন কেন, নারীরা গরুর গাড়ি চালালেও দুর্ঘটনা ঘটাবে!

সোমবার (১২ মার্চ) নেপালের স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিটে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় ইউএস-বাংলার বিএস২১১ ফ্লাইটটি। পৃথুলা রশীদ ছিলেন সেই ফ্লাইটের সহকারী পাইলট। ৭১ জন আরোহীর মধ্যে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫১ জন।  

কী কারণে, কীভাবে ঘটেছিলো সেই দুর্ঘটনা তার অনুসন্ধান করছে একাধিক তদন্ত কমিটি। যার রিপোর্ট এখনো প্রকাশিত হয়নি। অথচ আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ ইতমধ্যেই পৃথুলা রশীদ একজন নারী বৈমানিক হওয়ায় সব দোষ তার ওপর চাপাচ্ছে।

নেপাল সংবাদমাধ্যম ইতোমধ্যেই পৃথুলা রশীদকে ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ নামে আখ্যায়িত করেছে। তারা কেন এমনটা করলো! অথচ, বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পৃথুলা রশীদকে নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ অশালীন মন্তব্য করে দুর্ঘটনার দায় দিয়েছে তারই কাঁধে। তারপরও কেন নেপাল সংবাদমাধ্যম পৃথুলাকে এত বড় সম্মান দিলো?

কারণ, সেদিন চাইলেই হয়তো পৃথুলা জীবিত অবস্থায় দুর্ঘটনা কবলিত উড়োজাহাজটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু পৃথুলা ছিলেন তার দায়িত্বের প্রতি অটল। মানবিকতার দিক থেকে তার ছিলো আকাশের মতো বড় একটি মন। নিজের জীবন বিপন্ন করে সেদিন ১০ জন নেপালিকে উড়োজাহাজ থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ পর্যন্ত উড়োজাহাজটি থেকে না নেমে তিনি যাত্রীদের জীবন বাঁচাতে ছিলেন মরিয়া।  

এসব কথা নেপাল সংবাদমাধ্যমকে দুর্ঘটনায় কবলিত ফ্লাইটটির সংশ্লিষ্টরা কিংবা বাংলাদেশি কোনো যাত্রী দেননি। নেপালি যেসব নাগরিককে উড়োজাহাজটি থেকে বের হতে পৃথুলা রশীদ সেদিন সাহায্য করেছিলেন সেইসব যাত্রীদের বক্তব্যেই সাহসী এই নারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে নেপালের সংবাদ মাধ্যম। আর এ কারণেই নেপালের সংবাদ মাধ্যম পৃথুলা রশীদকে ‘ডটার অব বাংলাদেশ ’ নামে আখ্যায়িত করেছে।

আজ যখন পৃথুলা রশীদের কারণে বিশ্ব দরবারে আমরা ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ এর দেশ হিসেবে পরিচিত তখন এই দেশেরই একটি গোষ্ঠী অশ্লীল নানা শব্দে তাকে অপমানিত করছে।

ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ৩৬ বছরে ৭০টি উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় পড়েছে। সেসব ফ্লাইটে তো কোনো পৃথুলা রশীদ ছিলেন না। তাহলে সেসব ফ্লাইট কেন দুর্ঘটনায় পতিত হলো? খুব জানতে ইচ্ছে করে।

পৃথুলার মূল অপরাধ ছিলো, সে নারী। আর নারী হয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখা তো আরো বড় অপরাধ। তার ওপর পৃথুলা সে স্বপ্ন বাস্তবায়নও করেছে, কী সাহস সেই মেয়ের!

সবচেয়ে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ যেটি পৃথুলা রশীদ করেছেন তা হলো, নিজের জীবন দিয়ে ১০ জন ভিনদেশির জীবন রক্ষা করেছেন; বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন। একজন নারী হয়ে এতকিছু করার কোনো অধিকার পৃথুলার ছিলো না- এমনটাই মনে করে আমাদের সমাজের অসুস্থ মানসিকতার সেই গোষ্ঠী!

এসব দেখে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ১৯৮৬ তে প্যান এমএর ফ্লাইট ৭৩ ছিনতাইয়ের পর যাত্রীদের রক্ষা করেছিলেন কেবিন ক্রু নিরজা ভানোত। সেই ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান। পরে নিরজাকে ভারত সরকার অশোক চক্র পুরস্কারে ভূষিত করে। তার নামে ২০০৪ সালে দেশটির ডাকটিকিটও অবমুক্ত করে। পাশের দেশের ঘটনা, অথচ আমাদের সমাজের একটা অংশ পৃথুলা রশীদকে নিয়ে নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে।

পৃথুলা রশীদ তুমি আমাদের ক্ষমা করো। এ সমাজের কিছু মানুষ (এদের মানুষ বলতেও কষ্ট হয়) তোমার প্রাপ্য সম্মান দিতে তো নারাজ, উল্টো নারী হিসেবে খাটো করতেও দ্বিধা করছে না। আমরা তোমার কাছে অপরাধী। পরপারে ভালো থেকো পৃথুলা রশীদ। পারলে এই নোংরা সমাজকেও ক্ষমা করো।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৮
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।