ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কে দেখেন গ্রামের ছবি?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৭ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৮
কে দেখেন গ্রামের ছবি? নকশিকাঁথায় গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ। সংগৃহীত

বাংলাদেশকে বলা হয় গ্রামবহুল দেশ। সেই গ্রামের ছবি কি আমরা ঠিক ঠিক দেখতে পাই? সেখানকার অদল-বদল, উন্নয়ন, অবক্ষয়, কুসংস্কারের প্রকৃত চিত্র কতটুকু তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে? রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সমাজতাত্ত্বিক, উন্নয়নকর্মী, সংবাদমাধ্যম কি দিতে পারছে বাংলাদেশের-প্রাণ নামে পরিচিত গ্রাম-জীবনের সঠিক প্রতিচিত্র?

ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার গ্রামে লোকায়ত উন্নয়ন চলছে। সঙ্গে আছে নানা কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতা।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখন গ্রামের চরিত্র ও কাঠামো দ্রুত লয়ে বদলে দিচ্ছে। মানুষের সুখ ও আনন্দ যেমন বাড়ছে, বাড়ছে নানাবিধ যন্ত্রণাও। বাংলাদেশের পরিবর্তমান গ্রামের খোঁজটি জাতীয় সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন-নীতির জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত হলেও সে-চিত্র সম্পূর্ণভাবে উদ্ভাসিত হতে দেখা যায় না।

অতীতের সাহিত্যিকরা গ্রামের গভীর অনুসন্ধান করেছিলেন। বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ছাড়াও শরৎচন্দ্র গ্রামীণ জীবনের আলো ও অন্ধকারকে তুলে ধরেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের পুঁজিবাদী দানবীয় চাহিদা-সৃষ্টিকারী সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার বিরোধিতা করছিলেন ‘রক্তকরবী’ নাটকে। ‘রক্তকরবী’ লেখার আগেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সিটি অ্যান্ড ভিলেজ’ নামের ইংরেজি নিবন্ধে খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে গ্রামসমাজকে ক্রমশ রিক্ত করছে শহর এবং প্রকৃতি-পরিবেশকে বিনষ্ট করছে। রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যিকদের মধ্যে গ্রামসমাজের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধতম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ নবীন তারাশঙ্করের সাহিত্যে প্রকাশিত গ্রামসমাজের সত্যরূপ নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তারাশঙ্কর নিজেও তাঁর গ্রাম-কেন্দ্রিক সাহিত্যধর্মে অবিচল ছিলেন আজীবন। দলমত নির্বিশেষে গ্রামসমাজের সাধারণ মানুষের জীবনধারাকে বুঝতে চেয়েছিলেন তিনি। শুধু বুঝতেই চাননি, উপরন্তু গ্রামীণ জনতার জীবনের সমস্যার নানা বাস্তব সমাধানও দিতে তৎপর হয়েছিলেন।

একাধিক উপন্যাস ছাড়াও তারাশঙ্করের এই মনটিকে অনুসরণ করার অন্যতম প্রধান অবলম্বন তাঁর ‘গ্রামের চিঠি’ নামক গ্রন্থ। অনেকেই গ্রামে যান বা গ্রামে থাকেন, কিন্তু কয়জন তাঁর মতো গ্রামের কথা তুলে ধরতে পেরেছেন? গল্প-উপন্যাসের কৃৎকৌশল গ্রামের চিঠিতে বজায় রাখতে হয় না। তারাশঙ্কর একরঙা কোনও চশমা পরে তাঁর এই চিঠিগুলি লেখেননি। কলকাতার ‘দৈনিক যুগান্তর’-এ ১৯৬৩-র ২৭ জুলাই থেকে ১৯৬৮-র ২৭ মে পর্যন্ত প্রায় ছ-বছর ধরে তারাশঙ্করের গ্রামের চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। চিঠির সংখ্যা ২৩২। পরে এগুলো গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়।

তারাশঙ্কর তাঁর প্রথম চিঠিতেই লিখেছিলেন, এককালে গ্রামই প্রধান ছিল। এখন গ্রামের প্রাধান্য গেলেও গ্রামেই দেশের প্রাণশক্তি নিহিত রহিয়াছে। ’ ভাল-মন্দে মেশানো গ্রামই তাঁর চিঠিতে উঠে আসে। চিঠির বাক্য বহু ক্ষেত্রেই কাটা কাটা, সংক্ষিপ্ত। কখনও কখনও সেই কাটা কাটা বাক্যে মিশে আছে বিদ্রূপ ও শ্লেষ।

১৯৬৩ সালের ১৭ আগস্টের চিঠিতে তারাশঙ্কর স্বাধীন দেশের উপরওয়ালাদের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘ইহারা গ্রামের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না, কারণ ইহারা উপরওয়ালা। দেশের শাসক। মধ্যে মধ্যে ভাবি, আঃ, ইংরেজ কি কলই পাতিয়া গিয়াছে। যে আসে সেই রাবণের মাসতুতো ভাই হইয়া দাঁড়ায়। ’ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যেমন, রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও তেমন। বহু কষ্টে গড়ে ওঠা একটি গ্রামের স্কুল ঘিরে রাজনৈতিক দলের বিবাদ। এক জনে মামলা লাগায়, অন্য জনে ফাঁসায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না।

বীরভূমের একটি স্কুলের কথা লিখেছিলেন তারাশঙ্কর। শিক্ষকদের বেতনের খাতায় লেখা হয় এক বেতন, তাঁরা পান অন্য বেতন। নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্য তাঁদের ১৬০ টাকা হিসাবে। কিন্তু তাঁরা পান ৭০ টাকা হিসাবে। এই অপধারা খোঁজ নিলে এখনও বাংলাদেশের বহু গ্রামেই পাওয়া সম্ভব।

একটি চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে তবে রকম-সকম যেন একেবারে সেকেলে রাজতন্ত্রের মতো, রাজা প্রয়াত হলেই সুযোগসন্ধানীরা উঠে পড়ে লাগে। দেশের সাধারণ মানুষ অনেক দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রকে রাজতন্ত্র বলেই ভাবতে অভ্যস্ত। ’

চিঠিতে গ্রামের আনন্দ উৎসবের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। এসেছে সেকাল একালের তুলনা: সে নবান্নের বাটি ভরা দুধ, আধখানা কোরা নারকেল, দুচারটে মর্তমান কদলী, অঞ্জলি ভরা চিনি ‘হাতের নুলোটি ডুবিয়ে লোকে হুপ হাপ করে খেত প্রথম প্রহরে। দ্বিতীয় প্রহরে এক অন্ন পঞ্চাশ ব্যঞ্জন। নবান্নের সেই আহার-বাহার নেই বটে, তবে কোথাও কোথাও গ্রামসমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন চোখে পড়ে। একটি গ্রামে ধর্মগোলা তৈরি করে সুদখোর মহাজনের হাত থেকে সকলকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করেছেন।

তারাশঙ্করের গ্রামের চিঠি যখন লেখা হচ্ছে তখন বঙ্গদেশে উদ্বাস্তু-সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করেছে। তারাশঙ্কর বিশ্বাস করতেন বঙ্গদেশের গ্রাম এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তারাশঙ্কর হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অন্তত পঁচিশ হাজার গ্রাম বেছে নিয়ে সেসব গ্রামে গড়ে দশ ঘর লোকের পুনর্বাসন করা সম্ভব। নানা জেলাতেই আবাদযোগ্য পতিত জমি রয়েছে। সেই জমি ব্যবহার করা উচিত। সেই জমি ব্যবহার করলে পূর্ববঙ্গ থেকে সমাগত উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে এত জটিলতার সৃষ্টি হত না বলে অনেক বিশেষজ্ঞও মনে করেন।

তারাশঙ্কর যে গ্রামের চেহারা দেখেছিলেন, সে চেহারা হয়তো এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজনীতিও জটিলতর হয়েছে। তবে গ্রাম সম্বন্ধে মূলগত সমস্যার স্বরূপ একই। তা হলো, আমরা গ্রামের উন্নয়নের কথা ভাবি, কিন্তু গ্রামকে ভেতর থেকে চেনার চেষ্টা করি না।

তারাশঙ্কর গ্রামকে ভেতর থেকে চিনতে ও চেনাতে চেয়েছিলেন। আমাদের রাজনীতিবিদগণ বা সাহিত্যিক কিংবা সমাজ-গবেষকরা সে চেষ্টাটি সরেজমিনে করলেন না। গ্রাম রয়ে যাচ্ছে মুখের কথায়, কল্পনায় ও স্মৃতিতে। বাস্তবের পরিবর্তমান গ্রামকে সমস্যা ও সম্ভাবনার আলোকে পূর্ণ রূপে দেখা হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৮

এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।