ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রশিদ তালুকদারের সঙ্গে অন্যায়ের ক্ষমা নেই

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিংএডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১১
রশিদ তালুকদারের সঙ্গে অন্যায়ের ক্ষমা নেই

রশিদ তালুকদার ভাই প্রফেশনে আসেন আমাদের জন্মেরও অনেক বছর আগে। এরপরও তিনি আমাদের সবার প্রিয় `রশিদ ভাই` হন।

এটি শুধুমাত্র রাজনীতি আর মিডিয়াতেই বুঝি সম্ভব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলের সব নেতাকর্মী থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ বনিতার কাছে ছিলেন প্রিয় `মুজিবভাই`। মাওলানা ভাসানী ছিলেন সবার `হুজুর`।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে `স্যার-ম্যাডাম` এসব ঢুকেছে জিয়া-এরশাদ জমানায়। সামরিক বাহিনীর উর্দি গায়ে দিয়ে বন্দুক দেখিয়ে তারা ক্ষমতায় আসেন। মিলিটারি প্রফেশনের জুনিয়ররা তাদের `স্যার` বলতেন। রাজনীতিতে এসে তারা সেই স্যারই রয়ে যান। স্যারদের বেগম সাহেবেরা ম্যডাম। তাই জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া, এরশাদের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ দু’জনে বিএনপি-জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের কাছে সেই যে `ম্যাডাম` হয়েছেন, তারা আমৃত্যু ম্যাডাম। বঙ্গবন্ধু ও মুজিব ভাইয়ের কন্যা শেখ হাসিনা হয়েছেন `আপা`।

মিডিয়ার এই `ভাই` ডাক নিয়ে সাম্প্রতিকালের মজার একটি দৃষ্টান্ত আছে। দেশের এই মুহুর্তের সবচেয়ে সিনিয়র সক্রিয় সাংবাদিকদের অন্যতম তোয়াব খান জনকন্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক। তার ভাগ্নে  বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলাম খান পত্রিকাটির প্রধান বার্তা সম্পাদক। অফিসের ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় খেয়াল হয় কামরুল ভাই’ও তার মামা তোয়াব খানকে `তোয়াব ভাই` বলেই ডাকেন। কি ব্যাপার কামরুল ভাই, মামাকে ভাই ডাকেন যে? কম কথার মানুষ কামরুল ভাই। সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে বলেন, ওটাতো তার নামের অংশ। তোয়াব ভাই। এই আমাদের মিডিয়া জগত।

প্রিয় রশিদ তালুকদার ভাই’র শারীরিক অবস্থা, লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার খবর পড়ে উদ্বিগ্ন মন। তার পান চিবুনো সদা হাসিখুশি মুখটি মনে করে চোখ ভিজে আসে। এরপর হিসাব করে দেখি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার অনেক বয়স হয়েছে। বিলাত-অস্ট্রেলিয়ার হিসাবে অবশ্য এটি কোন বয়সই না। ৮৫ বছর বয়সী রানী এলিজাবেথ এখন অস্ট্রেলিয়া সফরে এসে প্রতিদিন নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ায় এটি তার ষোলতম সফর।

আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষজনের নানান বালা-মুসিবতের পাশাপাশি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ-বালাই যেমন নেই, মিডিয়ার মানুষজনেরতো তা আরও নেই! নিজেদের ঝুঁকিতে রেখে সারা সময় দেশের মানুষের নিরাপত্তা উদ্বেগের রিপোর্ট লেখেন-ছবি তোলেন মিডিয়ার মানুষেরা! এসব রিপোর্ট পড়ে ছবি দেখে মানুষের ভেতর থেকে উফ-আহ প্রতিক্রিয়া বেরোয়। কিন্তু কেউ জানেন না এসব নির্মাণ শিল্পীর হাঁড়ির খবর!

১৯৬২ সালে পেশা জীবন শুরু করেন রশিদ তালুকদার। অবসরে গেছেন ২০০৭ সালে।   তার ছবি দেখে দেখে আমাদের রাজনীতি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-আন্দোলনের জ্ঞান হয়েছে। বিশেষ করে উনসত্তুরে মিছিলের সামনে স্লোগানরত প্রতিবাদী সেই পথশিশুটির ছবি দেখে এখনও মন ফুঁড়ে যে পংক্তিটি বেরোয়, আমার প্রতিবাদের ভাষা আমার প্রতিশোধের আগুন! ঊনসত্তুর-সত্তুর-একাত্তর-বাহাত্তরের এমন অনেক স্মরণীয় ছবি তুলেছেন রশিদ তালুকদার। একাত্তরের ২ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, আগুন ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসমুদ্রে তর্জনি উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধুর অমর কবিতাখানি--- ``এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম`` ঘোষণা, এরপর ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ প্রস্তুতির ছবি, ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে রাজাকারদের চবয়নেটে খোঁচানো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গলিত-বিকৃত মরদেহ, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, এমন নানা স্মরণীয় ছবির ভিড়ে রশিদ তালুকদারের মাস্টারপিস বুঝি উনসত্তুরের সেই ছবিটাই। সবারই যেন এমন একটি মাস্টার পিস থাকে।   ছবিটি তোলার পরপর পাকিস্তানিদের গুলিতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সেই আজন্ম সংগ্রামী পথশিশুটির জীর্ন রোগাটে দেহখানি। আমরা যাকে আর মনে রাখিনি।

রশিদ তালুকদার ভাই’র সঙ্গে মাঠে দেখা, সখ্য এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে। আন্দোলন দেখলেই বুঝি এমন রশিদ ভাইরা নিষ্ক্রয়-বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। বাংলাদেশের আজকের মিডিয়া নেতৃত্বের সিনিয়রদের বেশিরভাগ ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান, অবজারভার, চিত্রালী, দৈনিকবাংলা, ললনা, বিচিত্রা এসব পত্রিকায় সৃষ্ট-বিকশিত। যেমন তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিচিন্তা, দেশবন্ধু, খবরের কাগজ, পূর্বাভাস, প্রিয় প্রজন্ম, আজকের  কাগজ-ভোরের কাগজের হাত ধরে এসেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইত্তেফাকের মতো সিনিয়রদের মর্যাদা-পৃষ্ঠপোষকতা আর কেউ সেভাবে দেয়নি-দেয় না।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ইত্তেফাকের বেশ ক’জন নামকরা ফটোগ্রাফারের সিনিয়র তালিকায় রশিদ তালুকদার, আফতাব আহমদ, মোহাম্মদ আলম, শামসুদ্দিন চারু ছিলেন অন্যতম। প্রতিদিন জনতার মিছিলের সঙ্গে থাকতেন মোটর সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে। স্বৈরাচার মিছিলে হামলা চালালে কে মিছিলকারী, কে মিডিয়াকর্মী সে বাছবিচার করে না। তেমন হামলায় রিপোর্টাররা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে বা চলে যেতে পারেন। রশিদ তালুকদারের মতো ফটো সাংবাদিকরা তা পারেননা। ভালো একটি এক্সক্লুসিভ অ্যাকশন ছবির আশায় ঝুঁকি নিয়ে আরও বেশি ঢুকে যান সংঘাতের মাঝখানে! রশিদ তালুকদারের মতো ফটো সাংবাদিকরা এভাবে যে কতবার পাকিস্তানি, বাংলাদেশি সামরিক-গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার, মৌলবাদীদের পুলিশ-ক্যাডারদের লাঠি-আঘাতের মার খেয়েছেন-খান এর কোনও লেখাজোখা নেই।

সেই চির চঞ্চল রশিদ তালুকদার লাইফ সাপোর্টে চলে যাবার খবর বাংলানিউজে পড়ার সঙ্গে মনোয়ারুল ইসলামের রিপোর্টের তথ্যে চোখ ভিজে আসে, মন বিক্ষুব্ধ হয়। এমন একজন কৃতী মানুষ, যার ছবি ঘরে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে আমাদের রাজনীতিকরা রাজনীতি করেন, ক্ষমতায় যান, কিন্তু রশিদ তালুকদারকে একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়নি? এত দলবাজ, রাম-শ্যাম-যদু-মধু’ও এ পুরস্কার পেয়েছেন! কিন্তু  রশিদ তালুকদার নন! জিয়া-এরশাদের তার ব্যাপারে অনেক কষ্ট-অসন্তুষ্টি থাকতে পারে। ‘স্বাধীনতা পদক বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদেরও দেওয়া হয়েছে, তাই পদকের ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ নেই’,  ---রশিদ তালুকদারের এমন মন্তব্যে অসন্তুষ্ট হতে পারেন খালেদা জিয়া? কিন্তু শেখ হাসিনার অসন্তুষ্টিটা কী কারণে? নাকি তার মৃত্যুর পর মরণোত্তর পদকে সম্মানিত করার অপেক্ষা? রশীদ তালুকদারের সঙ্গে এ অন্যায়ের ক্ষমা নেই।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ১৪০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।