ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদের সফর ও বাংলাদেশের সুযোগ

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৮
নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিদের সফর ও বাংলাদেশের সুযোগ জ্বালিয়ে দেওয়া একটি রোহিঙ্গা জনপদ। ছবি: সংগৃহীত

রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও তা নিরসনে এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। জাতিসংঘের বিভিন্ন সভা-পরিষদ, সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব বিশ্ব বিভিন্ন সময়ে তাদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কিন্তু তাতে সংকট সমাধানের পথে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে, সম্প্রতি জাতিসংঘ, অন্যান্য সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গা প্রশ্নে নড়েচড়ে বসেছে। তারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে এক ধাপ এগিয়েছে বলেই মনে হয়। 

জাতিসংঘের উভয় পরিষদেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো পরিষদেই এ লক্ষ্যে কোনো প্রস্তাব পাশ হয়নি।

মূলত চীন ও রাশিয়ার জন্যই কোনো প্রস্তাব পাশ করা যায়নি। তাই রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক প্রয়াস বন্ধ করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি বারবার তুলে ধরেছেন। ফলে, বিশ্ববাসীও নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভাবছে। এরই ফলে, আমরা দেখতে পাই, সর্বশেষ কমনওয়েলথ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রোহিঙ্গা বিষয়ে তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। হয়তো অচিরেই তারাও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে।  

এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আগামীকাল (শনিবার, ২৮ এপ্রিল) ঢাকায় আসছেন। বাংলাদেশে দুই দিন অবস্থান করে প্রতিনিধি দলটি মিয়ানমার সফরে যাবে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও অস্থায়ী সদস্য বলিভিয়া, গায়না, কাজাখস্থান, কুয়েত, নেদারল্যান্ড, পেরু, পোলান্ড, সুইডেন ও  আইভরিকোস্টের প্রতিনিধিরা এ সফরে থাকবেন।  

নিরাপত্তা পরিষদের এ সফর নতুন করে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে আবার বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সহায়ক হবে। এ সফরের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা যে একটি মানবাধিকার ও মানবিক সংকট তা বিশ্ববাসী উপলব্ধি করবে। এ সফরের ফলে সমস্যাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব পাবে।

রোহিঙ্গা সমস্যার মতো অপরাপর আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদই সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সংস্থা। নিষেধাজ্ঞা, শক্তি প্রয়োগ বা অন্য যেকোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ফলে, এই প্রতিনিধি দলের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে বাংলাদেশকে। এ সমস্যার নেপথ্য কারণ, রোহিঙ্গাদের জাতিগত ইতিহাস, সমস্যার রূপরেখা এবং সেইসঙ্গে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বাস্তবচিত্র তাদের সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে।  

প্রতিনিধি দলটি মিয়ানমারেও যাবে। যদিও মিয়ানমার এরইমধ্যে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাবতীয় প্রমাণ নষ্ট করে দিয়েছে। তাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। সিস্টেম্যাটিক কিলিং, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ কোনো কিছুই তারা বাদ দেয়নি। বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের পর সবশেষ গত আগস্ট থেকে যে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে, তার সব প্রমাণ গায়েব করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই তারা করেছে। এরমধ্যে অবশ্য বিশ্ব গণমাধ্যমে অনেক কিছুরই প্রমাণ রয়ে গেছে। বাংলাদেশকে সেসব প্রমাণ প্রতিনিধি দলটির নজরে আনতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যচিত্র তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশে শরণার্থী, সেটাও জাতিসংঘের এ প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরতে হবে। জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে তাদের আন্তর্জাতিক ও আইনগত পরিচয় ‘শরণার্থী’ সে বিষয়টিও।  

বলতে হবে, রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই বাংলাদেশের নাগরিক নয়, তারা মিয়ানমারের নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে এসে এখানে শরণার্থী জীবন যাপন করছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনই এর স্থায়ী ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান। জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের কাছে রোহিঙ্গাদের এই প্রকৃত অবস্থাটি নির্দ্বিধায় তুলে ধরা জরুরি।  

আগেই বলা হয়েছে, জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদই সর্বোচ্চ ক্ষমতার জায়গা। তারা জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের প্রস্তাব আনতে পারে। এমনকি মিয়ানমারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদ শক্তি প্রয়োগেরও ক্ষমতা রাখে। নতুনভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের এ রকম সফর এটিই প্রথম। নিরাপত্তা পরিষদের এরকম সফর শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বেও এর নজির খুব বেশি নেই। সমস্যাটির গুরুত্ব উপলব্ধি করেই তারা ঢাকায় আসছে। কাজেই এ সফরের গুরুত্ব উপলব্ধি করা আমাদের জন্য আরও বেশি জরুরি। এ সফরে বাংলাদেশের কার্যকর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ এই প্রতিনিধিদলের কাছে রোহিঙ্গাদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে এটাই প্রত্যাশা।

এই প্রতিনিধি দলটি গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার যেতে চেয়েছিল। মিয়ানমার সরকার তখন সম্মত হয়নি। এতো দিনে তারা নির্যাতনের সব সাক্ষ্য ও তথ্য-উপাত্ত গায়েব করার চেষ্টা করেছে। ফলে আমাদের হাতে যা আছে তা প্রকাশে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না। সেইসঙ্গে রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারেরই নাগরিক তার প্রমাণও উপস্থাপন করতে হবে। কারণ, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক বলে মনে করে না। তাই রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের নাগরিক এটা প্রমাণ করা না গেলে আমাদের আন্তর্জাতিক ও আইনগত অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। ফলে, রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা যাবে না। তখন রোহিঙ্গাদের বোঝা বাংলাদেশের ‍ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হবে। যেটা আমাদের কাম্য নয়।

এদিকে মিয়ানমারও নিরাপত্তা পরিষদের সফরে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করতে চাইবে। রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর বিশ্বের চাপ রয়েছে। আগে রাখাইনে তারা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা এমনকি সাংবাদিকদেরও প্রবেশে বাধা দিয়েছে। এতে তারা সমালোচিত হয়েছে। এই প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানিয়ে মিয়ানমার এ সমালোচনা থেকে আপাতত খানিকটা হয়তো রেহাই পাবে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, তারা এই প্রতিনিধি দলের কাছে রোহিঙ্গা বিষয়ে যতোটা সম্ভব মিথ্যাচার করবে এবং তারা যে নামকাওয়াস্তে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেটাও জাহির করবে। ফলে, বাংলাদেশকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হবে।  

নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের বোঝাতে হবে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘকে সহযোগিতা করতে সম্মত হওয়ার ভান করলেও বাস্তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করেনি। নো ম্যানস্ ল্যান্ড থেকে একটি পরিবারকে ফিরিয়ে নিয়ে তারা গণমাধ্যমে জাহির করেছে যে প্রত্যাবাসন শুরু করেছে। এ জাতীয় মিথ্যাচারের নমুনাও প্রয়োজনে তুলে ধরতে হবে।
নিরাপত্তা পরিষদকে বলতে হবে, কম-বেশি প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে শরণার্থী। এ সংকট মোকাবেলায় বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ তার মানবিক হাত বাড়িয়েছে। বিশ্ববাসীকে এখন সমাধানের পা বাড়াতে হবে। এ সংকট বাংলাদেশের সৃষ্ট নয়, বাংলাদেশ এর জন্য দায়ী নয়। তাই এর দায়ভারও বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও রীতি-নীতিবিরুদ্ধ। নিরাপত্তা পরিষদ সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ।  

বাংলাদেশ সময়: ২২০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৮
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।