প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে একটি মধ্যমে আয়ের দেশ হিসেবে গড়ার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন। আমরা ইতিমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেদেরকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।
ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়নে এই সরকার সময় পাবে বড়জোর ছয় মাস। এরপরই জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে বিজয়ী হলে এ বাজেট বাস্তবায়নে সরকার তার পরিকল্পনা মতো কাজ করবে। ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ বাজেট বাস্তবায়নে গতি হারাবে বলেই মনে হয়।
ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে ২০২১ সালের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০১৫ সালেই তা অর্জিত হয়। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অচিরেই আমরা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হবো’। বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সুখী, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এটি এই সরকারের অন্যতম উন্নয়ন পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক এজেন্ডাও। সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নে এ সরকার কাজ করছে।
সমৃদ্ধ দেশ গড়তে গত এক দশকে আমাদের বেশকিছু অর্জন আছে। আমরা নবজাতক ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস করতে পেরেছি। স্বাস্থ্যখাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, দারিদ্র বিমোচনে আমাদের অগ্রগতি আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় আমরা কাজ করছি। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের আরো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে একেবারেই প্রথম সারিতে।
নারী অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের অগ্রগতি লক্ষণীয়। নারী শিক্ষায় আমরা আগের থেকে এখন অনেক এগিয়ে।
বিশ্ব অভিবাসনকে একটি সংকট হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশ সে সংকটকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে চায়। কিন্তু রাজনৈতিক অভিবাসন ও শরণার্থী সংকট আমাদের অর্থনীতির ওপর একটি অতিরিক্ত চাপ। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে সেটি উঠে এসেছে। এ সংকট মোকাবেলায় বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে।
উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টিতে কর্মসংস্থান একটি বড় নিয়ামক। চাহিদার তুলনায় আমরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারিনি। প্রতি বছরই চাকরির বাজারে যোগ হচ্ছে প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমশক্তি। কিন্তু আমাদের সে পরিমাণ কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। তাই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে ও একই সাথে দক্ষতা উন্নয়নেও কাজ করতে হবে। । দেশি ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় আমরা এখনো পিছয়ে আছি। অথচ বাস্তবতার নিরিখে এক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে থাকার কথা। ’জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১’ কে আরও কার্যকর করতে হবে।
সব উন্নয়নের মূলকথা হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন। এক্ষেত্রে যদিও আমাদের অগ্রগতি প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় ভালো। তবে এটি যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ বর্তমানে মধ্যম মানবসম্পদ উন্নয়ন দেশের অন্তর্ভুক্ত। মানবসম্পদ উন্নয়নের যে সব সূচক আছে; যেমন-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতার বিকাশ-এসব খাতে আরো অধিক সম্পদের সঞ্চালনের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। এটি বর্তমান সরকারের বিবেচনাধীন। এক্ষেত্রে উপযুক্ত নীতি ও কৌশল প্রণয়ন জরুরি।
২০১০ সালে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয় তা এখন বাস্তবায়নাধীন। কিন্তু শিক্ষা-গবেষকরাই বলছেন, আমাদের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ আরো সময়োপযুগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রাথমিক স্তরে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ এগিয়ে চলছে। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণও চলছে। পাশাপাশি উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং, শিক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হ্রাস, শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে আরো জোর দিতে হবে। কারণ, শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার।
সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা আমরা এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি। বিশেষ করে গ্রামের বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আজও স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসেনি। যদিও কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা হয়েছ, কিন্তু এর সুফল মানুষের দোড়গোড়ায় এখনো পৌঁছায়নি।
সাবর্জনীন শিক্ষা, জনমুখী স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার কল্যাণ কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী, কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ ও সচেতনামূলক কার্যক্রমের সম্প্রসারণ করা সময়ের দাবি। রাষ্ট্রীয় সুযোগ ও সেবাকেন্দ্রের বিকেন্দ্রীকরণ ও তাতে জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণের প্রয়োজন আছে।
এ কথা সত্য, সামাজিক খাতে বিগত একদশকে আমাদের অগ্রগতি লক্ষ্যণীয়। কিন্তু দারিদ্র নিরসণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক সুরক্ষামূলক তেমন কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। যা আছে, তাও কার্যকর না।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’কে কেবল রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ না রেখে একে দক্ষতা-উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসেও এটি একটি কার্যকর হাতিয়ার।
আমাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে কিন্তু দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাস পায়নি। এটি হওয়ার কথা নয়। ফলে এ অসমতা হ্রাসের ক্ষেত্রে আমাদের সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।
আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও খাদ্যনিরাপত্তা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। দেশের সকল মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদের সরবরাহ আমরা আজো নিশ্চিত করতে পারিনি। পুষ্টিহীনতা আজো বিদ্যমান যা ভবিষ্যতের জন্য একটি হুমকি।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন (প্রথম অধ্যায়, প্যারা-৮), “ব্যক্তিগতভাবে আমার গর্বের বিষয় হলো যে বিগত শতাব্দীর ৭০ ও ৮০’র দশকে আমি ‘বিশ্ব ভিক্ষুক’ বলে অবহেলিত হয়ে আজকে সফল একজন অর্থমন্ত্রীর সম্মান পাচ্ছি”।
এটাই আজকের বাস্তবতা। তলাবিহীন ঝুড়ির শাপমোচন করে আমরা আজ উন্নয়নের রূপকল্প তৈরি করছি। সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন করে ‘রূপকল্প ২০৪১’ নিয়ে কাজ করছে। এসবই সরকার ও জনগণের; মানে বাংলাদেশের অর্জন। রূপকল্প বাস্তবায়ন বা সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রা- যাই বলি, জনগণই এখানে মূল শক্তি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৩ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৮
এমজেএফ