ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমার বাবা, আমার পিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৬ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৮
আমার বাবা, আমার পিতা প্রতীকী ছবি

বাবা ছিলেন রাশভারী, একগুঁয়ে, মেজাজী মানুষ। আমার অন্য ভাইবোনেরা বাবার ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকতো। আমরা ভাইবোনেরা আমাদের বড় ঘরের বারান্দায় পাটি বিছিয়ে বাবার কাছে পড়তাম। সাত ভাইবোনের মধ্যে বাবার হাতের মার না খাওয়ার রেকর্ডটাও আমার। কেন জানি কেবল আমার বেলায় তার আলাদা পক্ষপাত ছিল। এর জন্য আমার অন্য ভাইবোনেরা আমার প্রতি খানিকটা ঈর্ষান্বিতও ছিল। 

আমাদের গ্রামে প্রতি শুক্র ও সোমবার হাট বসতো। এখনও তাই বসে।

আমাকে ছাড়া বাবা হাটে যেতেন না। আমি ‘খালই’ হাতে বাবার পিছে পিছে কখনও হেঁটে, কখনও দৌঁড়ে হাটে যেতাম। এ ব্যাপারে আমার কোনো ক্লান্তি ছিল না। শুক্র ও সোমবারের হাটের দিনের জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। এর অবশ্য একটা কারণও ছিল। হাট থেকে বাবা আমাকে চিনির ‘মুরালী’, গুঁড়ের ‘টানা’ কিনে দিতেন।  

সুখে-দুখে, আনন্দ-বেদনায় যাপিত জীবনে আমার বাবা একটা বড় সংসারের হাল ধরে ছিলেন আমৃত্যু। তিনি কখনও কখনও বিপন্ন হয়েছেন, আশাহত হয়েছেন, কিন্তু তার সামান্য আঁচও আমাদের শরীরে লাগতে দেননি। কত শত স্মৃতিবিজড়িত বাবার সান্নিধ্যর সেই দিনগুলো আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। বাবার সঙ্গে সোমবার হাটে গিয়েছি। দুপুর থেকেই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। এর আগে কয়েকদিন একটানা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত আর পিচ্ছিল হয়েছিল। বাড়ি আর হাটের মাঝামাঝি গিয়ে বাবা বুঝলেন রাস্তাঘাটের এই অবস্থায় আমাকে নেওয়া ঠিক হয়নি। বাবা খুব তড়িঘড়ি করে হাট শেষ করে বাড়ির পথ ধরলেন। কিন্তু কিছুদুর আসতেই আকাশ ভেঙে নেমে এলো বৃষ্টি, সঙ্গে ঝড়ো বাতাস। বাবা আর আমি দু’জনেই ভিজে একসা। রাস্তার পিচ্ছিল কাঁদার মধ্যে বারে বারে আমার পা পিছলে যাচ্ছিলো। বাবা আমার হাত ধরে হাঁটছিলেন। হঠাৎ বাবা হাঁটা বন্ধ করে রাস্তার উপর বসে পড়লেন। আমাকে বললেন, ‘বজল, কাঁধে ওঠ’। বাবা আদর করে আমাকে ‘বজল’ বলে ডাকতেন। আমি ভয়ে ভয়ে বাবার কাঁধে চড়ে বসলাম। বাবার এক হাতে বাজারের ‘খালই’, কাঁধে আমি, অন্য হাত দিয়ে আমাকে শক্ত করে ধরে সেই সোমবারের হাটের দিনের সন্ধ্যায় বাড়ির পথে হাঁটছেন।  

বাবা কখনও আমাদের ভাইবোনদের কাঁধে নিয়ে আদর করেছেন কিনা মনে নেই। কিন্তু সেদিন বাবার প্রশস্ত কাঁধে চড়ে তার চওড়া বুকে দু’পা রেখে আমি বাড়ি ফিরেছিলাম। শুধু তাই নয় আমার রাশভারী, মেজাজী বাবার কাঁধে বসেই তলপেটের চাপ ধরে রাখতে না পেরে প্রস্রাব করে দিয়েছিলাম। টের পেয়ে বাবা শুধু বললেন, ‘এই বজল, এ তুই কি করেছিস? আমি ভয়ে লজ্জায় থরথর করে কাঁপছিলাম। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বাবা আমাকে কাঁধ থেকে আছড়ে মাটিতে ফেলে দেবেন। কিন্তু বাবা কেবল বললেন, ‘শক্ত করে বস, পড়ে যাবি তো’। বাড়ি ফিরে বাজারের ‘খালই’ উঠোনে রেখে বাবা আমাকে নিয়ে সোজা নদীতে। অনেক যত্নে, অনেক আদরে বাবা আমাকে গোসল করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়েছিস খোকা’?

জীবনের অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমিও এখন বাবা। বাবা মারা গেছেন ১৯৮৬ সালের এক সোমবারে। সেদিনও ছিল আমাদের গ্রামে সপ্তাহের হাটবার। কিন্তু সেই হাটে বাবাও ছিলেন না, আমিও ছিলাম না। হয়তো ডালা ভর্তি করে দোকানিরা চিনির ‘মুরালী’, গুঁড়ের ‘টানা’ বিক্রি করেছেন। হয়তো একটানা বৃষ্টিতে রাস্তা ছিল কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। ছিলেন না কেবল একজন শিশুকে বহন করার পিতার প্রসস্থ কাঁধ, আর একখানি চওড়া বুক।

মাঝে-মধ্যে যখন গ্রামে যাই, তখন গোরস্থানে বাবার কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বাবাকে স্পর্শ করে বলি, হে আমার জন্মদাতা পিতা, আপনিই শিখিয়েছিলেন কিভাবে মাটির সঙ্গে কথা বলতে হয়। কিভাবে মাটিতে উপ্ত বীজ থেকে জীবনের উন্মেষ ঘটে। আপনি বলেছিলেন, সব সময় জানবি, বৃষ্টিভেজা মাটিতে শস্যের সম্ভাবনার গন্ধ পাওয়া যায়।

ফেরার পথে মনে হয় কেউ একজন আমার শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, ‘কেমন আছিস বজল, কেমন আছিস খোকা’। আমার দু’চোখের পাতা জলে ভারী হয়ে যায়।

...লেখক: মো. বজলুল হক বিশ্বাস, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব




বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৮
আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।