ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাঘ, সুন্দরবন ও বাংলাদেশ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৮
বাঘ, সুন্দরবন ও বাংলাদেশ .

সুন্দরবন হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল যা রয়েল বেঙ্গল খ্যাত বাঘের আবাসস্থল হিসাবে বহুল পরিচিত। সুন্দরবন অঞ্চলটির কিছু অংশ বাংলাদেশের ও কিছু অংশ ভারতের মধ্যে পড়েছে; যার মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। 

সুন্দরবনের মোট আয়তনের শতকরা প্রায় ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে এবং চল্লিশ শতাংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত। বনবিভাগের সমীক্ষা অনুসারে, ২০০৪ সালে বাংলাদেশে মোট বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি, যা কমতে কমতে ২০১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০৬টিতে।

 এখন পর্যন্ত ধারণা করা হয়, ১০৬ টি বাঘ আছে বাংলাদেশের সুন্দরবনে ।  

যেখানে ২০১৫ সালে ভারতে বাঘের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৬ টি, যার সংখ্যা ২০১৬ সালে এসে দাঁড়ায় ৮৫ টিতে । এখন প্রশ্ন হল যে সুন্দরবনের  আয়তন বাংলাদেশ অংশে বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমছে আর ভারত অংশের আয়তন কম হওয়া সত্ত্বেও বাঘের সংখ্যা কেন বাড়ছে আর এই মুহূর্তে আমাদের করণীয়ই বা কি ?

সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে রক্ষার্থে ভারতের বনবিভাগ অনেক আগেই বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং তা যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করে আসছে। এই যেমন সুন্দরবনে জনসাধারণের অবাধ বিচরণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।  
সুন্দরবনের আশেপাশের বসতবাড়ি উচ্ছেদ করেছে, যাতে বাঘ ও মানুষের কোনো ধরনের কনফ্লিক্ট না হয় বা কোনো বাঘ মানুষ দ্বারা বা মানুষ বাঘ দ্বারা আক্রান্ত না হয়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনের ভেতরে যেসব আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করে, তাদের সুন্দরবন থেকে সরিয়ে দূরে কোথাও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির সহযোগিতা নিচ্ছে।  
যেসব জায়গাগুলোতে অনবরত বাঘ বিচরণ করে সেসব জায়গায় সিসি টিভি এর মাধ্যমে জনসাধারণের বিচরণ পর্যবেক্ষণ এবং জনসাধারণের প্রবেশ সীমিতকরণ নিশ্চিত করা হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে তারা সুন্দরবনকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীকে বসবাসের জন্য উপযুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ দিতে সামর্থ্য হয়েছে।  

ফলে সেখানে বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। ভারতের সুন্দরবন অংশে বনদস্যুর সঙ্গে সাধারণ মানুষের বা নিরাপত্তাবাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা বিরল। এসব কার্যক্রমের জন্য ভারতের সুন্দরবন অংশে বাঘের আবাসস্থল অধিক নিরাপদ হচ্ছে, ফলে সেখানে বাঘের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।  

এবার আসি বাংলাদেশ অংশের আলোচনায়। সুন্দরবনের আশেপাশের মানুষ জীবিকার  তাগিদে অনেকেই সুন্দরবনকে বেছে নিয়েছে। কেউ মধু সংগ্রহ করতে অবাধে সুন্দরবনে প্রবেশ করছে, আবার কেউ বা গোলপাতা  সংগ্রহ বা মাছ ধরার তাগিদে অবাধে প্রবেশ করছে বনের গহীনে।  

আবার কিছু কিছু অসাধু লোক বনের কাঠ এবং লাকড়ি সংগ্রহের  জন্যে অবাধে বনের ভেতরে প্রবেশ করছে। আর এসবই হচ্ছে বন বিভাগের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের অনুমোদন সাপেক্ষে।  

শর্ত অনুযায়ী তারা অনুমোদন নিচ্ছেন কিন্তু অনুমোদনের পর আর সেই শর্ত মানছেন না। পাঠকের কাছে প্রশ্ন, সুন্দরবনে বাঘের আঙিনায় গিয়ে মধু সংগ্রহ করা নিরাপদ নাকি নিজের বাড়ির আঙিনায় কৃত্রিম উপায়ে মধু চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা সহজ ও নিরাপদ? 

বর্তমানে কয়জন মানুষ সুন্দরবনের আশেপাশে গোলপাতার তৈরি ঘরে বসবাস করেন? যারা জ্বালানির জন্যে সুন্দরবন থেকে কাঠ ও লাকড়ি সংগ্রহ করে তারা যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে তাহলে কী সেটা আরও বেশি উত্তম নয়? সুন্দরবনের ভেতরে কিছুদিন পরপরই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। কিছুদিন পরপরই শোনা যায়, বনদস্যুরা সুন্দরবনে লোকজনকে ধরে নিয়ে জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে।  

বনের ভেতরে যদি এই ধরনের কার্যক্রম হয় তাহলে সুন্দরবনে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী কতটুকু নিরাপদ? যদি সুন্দরবনে ১০৬ টি বাঘ থেকে থাকে তাহলে ১২ হাজার ৭২০ টি হরিণ থাকার কথা (খাদ্যশৃংখলা হিসেবে)।  

সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূল এলাকায় বাঘের জন্যে হরিণ শিকার করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সচরাচর বাঘেরা ছোটখাটো স্থন্যপায়ী প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। যেমন বনবিড়াল, বন্য শুকর ইত্যাদি।  

বন বিভাগের জরিপ অনুযায়ী, ২০০১ থেকে আজ অবধি প্রায় ৪৯ টি বাঘকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া কিছুদিন পরপরই বাঘ খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে প্রবেশ করে। এতে অতিসহজেই বোঝা যায়, সুন্দরবনে হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী যাদের উপর বাঘ নির্ভরশীল তাদের সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে।  

এছাড়া বনে অবৈধ্যভাবে কাঠ সংগ্রহের কারণে ঝোপঝাড়ও অনেক কমে যাচ্ছে। ফলে বাঘের পক্ষে হরিণ শিকার অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সুন্দরবন ও সুন্দরবনের বাঘকে রক্ষা করার জন্যে আমাদের এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ।  

আমাদের করণীয়:
১।  সুন্দরবনের ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

২। বনে যদি মানুষের বসবাস থেকে থাকে তবে তাদের সুন্দরবন থেকে সরিয়ে করে অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।  

৩। সুন্দরবনে মধু, কাঠ, গোলপাতা সংগ্রহ এবং মাছ শিকার বন্ধ করতে হবে। এসবের উপর নির্ভরশীল জনসাধারণকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং কৃত্রিম উপায়ে মধু, গবাদিপশু ও মাছ  চাষের প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে হবে। এছাড়া প্রতিটি পরিবারে বায়োগ্যাস স্থাপন করতে হবে।  

৪। সুন্দরবন ঘেঁষে লোকালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মানুষ এবং বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীকে পরস্পরের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। এছাড়া সুন্দরবন ঘেঁষে লোকালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে সোলার প্যানেল স্থাপন করে লোকালয়ে বাঘের প্রবেশ কমানো যেতে পারে।

৫। সুন্দরবনের যেসকল এলাকা অপরাধপ্রবণ এবং অবৈধভাবে মানুষের চলাচল বেশি সেইসব এলাকাকে সিসিটিভি স্থাপন করে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে।  

৬। বাঘের পর্যাপ্ত খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করতে সুন্দরবনের কাছাকাছি হরিণ ও শূকর এর খামার করে; শূকর, হরিণের বংশ বাড়িয়ে তা  সুন্দরবনে বাঘের জন্য প্রেরণ করতে হবে।  

৭। সুন্দরবনের লবণাক্ততা দূর করার জন্য এবং সুপেয় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার জন্য প্রাকৃতিক জলাধারের ব্যবস্থা করতে হবে।  

৮। বাঘের আক্রমনে নিহত ও আহত মানুষ ও গবাদিপশুর জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।  

বাংলার জীববৈচিত্র্য ও  প্রাকৃতিক বিপর্যয় রক্ষার্থে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলকে বাঁচাতে সুন্দরবন এবং বাঘকে বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে বন উজাড় হবে, অতিরিক্ত জোয়ারভাটার কারণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে, মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাবে।  

সরকার প্রতিবছর শতশত কোটি টাকার প্রকল্প দেন পরিবেশ ও প্রকৃতিকে করতে। আমাদের উচিত পরিকল্পিতভাবে সেই টাকা ব্যয় করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের জন্য একটি সুস্থসুন্দর এবং বসবাসের উপযোগী সুন্দরবন তৈরি করা। তবেই রক্ষা পাবে আমাদের সুন্দরবন এবং সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ রয়েল বেঙ্গল টাইগার।  

লেখক: ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কিউরেটর, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৮
এমএ/                     
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।