সদ্য প্রকাশিত “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে বিচারপতি সিনহা একটি জ্ঞানের কথা লিখেছেন। তাঁর বইয়ের অধ্যায় ১০-এ তিনি লিখেছেন:
“If we do not have respect and confidence over a brother judge, it is unhealthy for the judiciary, and I have seen some who play double roles by pretending to show cordiality externally only.”
অর্থাৎ বিচারপতি সিনহার মতে বিচারপতিগণ যদি একে অপরের ওপর সম্মান এবং আস্থা না রাখতে পারেন, তাহলে তা বিচার বিভাগের জন্য ক্ষতিকর।
নিঃসন্দেহে চমৎকার উপলব্ধি, উপদেশ এবং পর্যবেক্ষণ! কিন্তু বিচারপতি সিনহার “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির পাতায় পাতায় তিনি নিজেই তাঁর অগ্রজ এবং সহকর্মী বিচারপতিদের সম্পর্কে যে অনাস্থা এবং অসম্মান প্রদর্শন করেছেন তা দেখে তাজ্জব হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তাঁর বইটি পড়লে যে কোনো পাঠকের আমাদের বিচার বিভাগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্মাতে বাধ্য। অথচ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ে এই বিচারপতি সিনহাই লিখেছিলেন, বাংলাদেশে একমাত্র বিচার বিভাগই কোনো রকমে ‘‘পানির ওপর নাক ভাসিয়ে’’ নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছে। আর এখন “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে বিচারপতি সিনহা বিচারপতিদের সম্পর্কে যেসব কথা লিখেছেন তাতে তো বিচার বিভাগের নাক-কান-মুখ কোনোটারই অস্তিত্ব তিনি আর রাখেননি!
বইয়ের অধ্যায় ১৩ তে বিচারপতি সিনহা লিখেছেন যে আমাদের বিচার বিভাগের বিচারপতিগণ মূলত ফাঁকিবাজ। সুযোগ পেলেই নাকি তাঁরা নানা বাহানা দেখিয়ে আদালতকক্ষ থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করেন যাতে তাঁদের বেশি কাজ করতে না হয়। আর যেটুকু কাজ করেন তাও খুবই দায়সারা গোছের। এমন কি বিচারপতি সিনহা বইয়ের অধ্যায় ১০-এ এই অভিযোগও তুলেছেন যে, তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত আপিল বিভাগ প্রতিদিন গড়ে দেড় ঘণ্টা করে কাজ ফাঁকি দিত। উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা রায়ও সময় মত লিখেন না। এটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কথা হলো? তাহলে আমাদের দেশে প্রতিদিন এতো এতো মামলার নিস্পত্তি কী করে হচ্ছে? বিচারপতিদের বিরুদ্ধে এই ধরনের ঢালাও অভিযোগ তো আদালত অবমাননার সামিল।
“এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে বিচারপতি সিনহা জনসমক্ষে তাঁর অগ্রজ এবং সহকর্মী বিচারপতিদেরকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। নানা অভিযোগ এনে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। এখন অভিযোগগুলো সত্য না মিথ্যা তা যাচাই করার উপায় কি? সমালোচিত বিচারপতিগণের মধ্যে যারা ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন তাঁরা চাইলে এসব নিয়ে জনসমক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু যারা এখনও নিজ পদে বহাল আছেন তাঁদের কি উপায়? যেভাবেই হোক বিচার বিভাগের সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ তো হচ্ছেই, তাই না?
বিচারপতি সিনহা বেশ কয়েকজন সম্মানিত বিচারপতিকে অযোগ্য বলে অভিযুক্ত করেছেন। যেমন বইয়ের অধ্যায় ১০-এ তিনি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রধান বিচারপতি পদের জন্য অযোগ্য বলে দাবি করেছেন [ … I am sure that Shamsuddin Chowdhury would not be taken into consideration for the office of the Chief Justice for he was not at all competent to occupy that office.]। আবার বইয়ের অধ্যায় ২৭-এ তিনি বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে অযোগ্য বলে দাবি করেছেন। […Syed Mahmud Hossain and Hasan Foez Siddiqui … One was weak in criminal matters and another in civil matters.]
এখানে উল্লেখ্য যে, বিচারপতি সিনহা যে অস্থিতিশীল অবস্থায় আমাদের বিচার বিভাগকে রেখে নিরুদ্দেশযাত্রা করেছিলেন সেখান থেকে যেভাবে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিচার বিভাগকে অল্প সময়ের মধ্যে স্থিতিশীল করে তুলেছেন এবং জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। আবার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আদালত অবমাননার মামলায় বিচারপতিদের সহনশীলতা প্রসঙ্গে যে দৃষ্টান্তমূলক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা শুধু বর্তমানে নয় ভবিষ্যতেও বিচার বিভাগের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। কিন্তু “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটি পড়লে মনে হবে ইহজগতে আমাদের বিচারপতিগণের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বাটখারা যেন একমাত্র বিচারপতি সিনহার কাছেই আছে! আর তিনি এক ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে যখন-যাকে ইচ্ছা সেই বাটখারাতে মাপছেন!
বিচারপতি সিনহা তাঁর “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের যে স্বভাব-চিত্র তুলে ধরেছেন তাতে মনে হবে আমাদের বিচারপতিগণের মূল উদ্দেশ্য বিচার করা নয়, বরং আখের গোছানো। কখনও তাঁরা নিজেদের বিচারিক কাজ বাদ দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে যাওয়ার জন্য দিন-রাত এক করে ফেলছেন [বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, অধ্যায় ৬; বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, অধ্যায় ৯], আবার কখনও বা প্রধান বিচারপতি হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে দৌড় দিচ্ছেন [সাবেক প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম, অধ্যায় ৬; সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, অধ্যায় ৬; বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যায় ১০]। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, উপরোক্ত বিচারপতিগণের কাছ থেকে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক রায় পেয়েছি।
বিচারপতি সিনহার মতে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের প্রধান বিচারপতি পদে আসীন হওয়ার পর থেকেই নাকি কারণে-অকারণে বিদেশ ভ্রমণ করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বইয়ের অধ্যায় ১০-এ বিচারপতি সিনহা অভিযোগ তুলেছেন: “After assuming office, Mozammel Hossain began going on foreign trips. Whenever an invitation came, whether it was befitting for a Chief Justice to visit was not a concern to him.” একইভাবে অধ্যায় ১০-এ বিচারপতি সিনহা অভিযোগ তুলেছেন যে, বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই সরকারী খরচে বিদেশ ভ্রমণ করতেন [“...Abdul Wahhab Miah... simply visited Singapore without participating in discussion.”]। অভিযোগগুলো যে কতখানি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা সেটা দলিল-পত্র যাচাই করলেই দেখা যাবে।
বিচারপতি সিনহা তাঁর “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের ‘দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে দ্বিধা বোধ করেননি। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং বিচারপতি এম এনায়েতুর রহীম আমাদের উচ্চ আদালতের অত্যন্ত সুপরিচিত এবং সুদক্ষ বিচারক হিসেবে গণ্য। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁদের বিচারিক রায় বিশ্বে বাংলাদেশকে এক অনন্য স্থানে আসীন করেছে। কিন্তু এই দুইজন বিচারপতিকে বিচারপতি সিনহা তাঁর বইয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, তাতে মনে হবে তাঁরা বিচারিক কাজ বাদ দিয়ে সারাদিন অন্যের তদবির করে ঘুরে বেড়ান। অধ্যায় ৬-এ বিচারপতি সিনহা লিখেছেন:“Obaidul Hasan and M. Enayetur Rahim were junior to Abdul Wahhab Miah when they were practicing at the Bar... These two judges were going door to door for the elevation of their senior to the Appellate Division.”
বিচারপতি সিনহা তাঁর “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে দাবি করেছেন, আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারপতিগণ হর-হামেশাই পেশাগত অসদাচরণ করে থাকেন। আদালত চলাকালে তাঁরা প্রায়শই পেশাগত আচরণের সীমারেখা লঙ্ঘন করেন। যেমন তিনি তার বইয়ের অধ্যায় ১০-এ পেশাগত অসদাচারনের অভিযোগ তুলেছেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বিরুদ্ধে। আবার একইভাবে অধ্যায় ৬-এ বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়াকে নিয়ে উল্লেখ করেছেন:
“He [Justice Wahhab Miah] was lobbying robustly for his elevation. At one point of time he even started behaving abnormally in open court ... ”
অর্থাৎ বিচারপতি সিনহার মতে বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে যাওয়ার জন্য এতটাই মরিয়া হয়ে তদবির করছিলেন যে এক পর্যায়ে বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া প্রকাশ্য আদালতে অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করলেন। আমি জানি না বিচারপতি সিনহা এর মধ্য দিয়ে কী প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া প্রকাশ্য আদালতে অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করলেন কিন্তু সেই আদালতে উপস্থিত আর কোনো বিচারপতি, আইনজীবী, আদালত-কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী বা বিচারপ্রার্থী কেউই বিষয়টি একবারও উপলব্ধি করলেন না, করলেন শুধু বিচারপতি সিনহা! কী হাস্যকর যুক্তি !
আবার উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের পেশাগত অসদাচারণ শুধু আদালতকক্ষেই যে হয় তা কিন্তু বিচারপতি সিনহা মনে করেন না। বিচারপতি সিনহা “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইয়ের অধ্যায় ১২-তে অভিযোগ করেছেন, আদালতকক্ষের বাইরেও তাঁরা সেটা করে থাকেন নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষায়। ছুটি কমিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কর্মদিবস ১০ দিন বৃদ্ধি করায় বিচারপতি সিনহার সাথে বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা, বিচারপতি ইম্মান আলী সহ অন্যান্য বিচারপতিগণ এত খারাপ এবং অপমানজনক ব্যাবহার করেন যে তিনি সহ আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাকি স্তম্ভিত হয়ে যান। আবারও এক অবিশ্বাস্য আষাঢ়ে গল্প ফাঁদলেন বিচারপতি সিনহা! কারণ বিচারপতিরা যখন কোনো বিষয়ে শলা পরামর্শ করেন তখন তারা তা একেবারেই গোপনীয় ভাবে নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে করেন। সেখানে অন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত থাকেন না। সুতরাং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্তম্ভিত হবার মত কোনো ঘটনা ঘটার প্রশ্নই আসে না।
বিচারপতি সিনহা আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের একেকজন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস চালিয়েছেন তাঁর “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে। বইটির পাতায় পাতায় নিজের বিরুদ্ধে “ষড়যন্ত্রের থিওরি” তুলে ধরেছেন বিচারপতি সিনহা। বইটি পড়লে মনে হবে যেন এই পৃথিবীতে যারাই উচ্চ আদালতের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বা ভবিষ্যতে পাবেন, তাঁরা সবাই মিলে একটাই কাজ করেছেন, করেন এবং করবেন আর তা হলো বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তবে মজার ব্যাপার হলো তাঁর বিরুদ্ধে করা কোনো ষড়যন্ত্রই আবার বিচারপতি সিনহার অজানা থাকে না। দৈব ক্ষমতাবলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রসমূহ জানতে পেরে যান!
এই যেমন ধরেন, তিনি টেলিফোন তুললেন আর সাথে সাথেই ক্রস কানেকশন হয়ে গেল। সেখানে তিনি শুনতে পান তাঁকে নিয়ে বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া এবং বিচারপতি মমতাজ উদ্দিনের ষড়যন্ত্রের কথাবার্তা। তাঁর বইয়ের অধ্যায় ৩-এ বিচারপতি সিনহা লিখেছেন:
“On the intercom I was surprised to overhear at that time that he [Justice Abdul Wahhab Miah] was talking with Momtazuddin and I heard their discussions because of a cross connection. Justice Abdul Wahhab Miah was telling Justice Momtazuddin Ahmed in clear terms that Sinha would not be confirmed as he was a corrupt judge and that there were many allegations against him.”
বিচারপতি সিনহা তার বইয়ের অধ্যায় ১৫(ম)-তে উল্লেখ করেছেন যে, জনকণ্ঠ পত্রিকার আতিকুল্লাহ মাসুদ এবং স্বদেশ রায়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলাতে তাঁদের যেন ক্ষমা করে দেয়া হয় এই ব্যাপারে বিচারপতি নাজমুন আরা বিচারপতি সিনহাকে অনুরোধ করতে আসেন। বিচারপতি সিনহা বিচারপতি নাজমুন আরার এরূপ আচরণে স্বভাব-সুলভভাবেই ষড়যন্ত্রের আভাস পান! কিন্তু তিনি কীভাবে নিশ্চিত হন যে, বিচারপতি নাজমুন আরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত? কারণ বিচারপতি সিনহা খবর পান যে যখন আদালতে ওই মামলার শুনানি চলছিল তখন আমাদের আইনমন্ত্রী নাকি কোনো এক রাতে বিচারপতি নাজমুন আরার বাড়িতে দেখা করতে যান। কী হাস্যকর! আইনমন্ত্রী বিচারপতি নাজমুন আরার বাড়িতে যদি দেখা করতে গিয়েও থাকেন, যাওয়ার নানা কারণ থাকতেই পারে। কিন্তু না, বিচারপতি সিনহা একেবারেই নিশ্চিত যে সেটা আসলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবারই জন্য!এ ধরনের অভিযোগ পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কীইবা হতে পারে?
আবার এই যে জনকণ্ঠ পত্রিকার আতিকুল্লাহ মাসুদ এবং স্বদেশ রায়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা সেখানে অবমাননাকারীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন দোলন। অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন দোলন মামলা পরিচালনা করার সময় আদালতে একটু রূঢ় আচরণ করেন বলে বিচারপতি সিনহার মনে হয়। ব্যস, ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে যান বিচারপতি সিনহা! এবার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়াকে চিহ্নিত করেন বিচারপতি সিনহা। বিচারপতি সিনহা তার বইয়ের অধ্যায় ১৫(ম)-তে উল্লেখ করেছেন:
“It appeared to me that Salahuddin Dolon had a close relationship with Abdul Wahhab Miah. This I came to know subsequently from his own version.”
আবারও বিচারপতি সিনহা এক হাস্যকর বিষয়ের অবতারনা করলেন যে, তার বিরুদ্ধে করা কোনো ষড়যন্ত্রই বিচারপতি সিনহার অজানা থাকে না। কোনো না কোনো্ দৈব ভাগ্যবলে নাকি তিনি তা জানতে পেরে যান। আর এবার তিনি আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তাঁর “ষড়যন্ত্র থিওরী” প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তিনি ‘নেপথ্যের ষড়যন্ত্র-নায়ক’ হিসেবে এবার অভিযোগের তর্জনী তোলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের দিকে। এ ব্যাপারে বইয়ের অধ্যায় ১৫(ম)-তে বিচারপতি সিনহা উল্লেখ করেছেন:
“Salahuddin Dolon told him [Justice Abdul Wahhab Miah] that ... ABM Khairul Haque called and pressurized him to accept the brief on behalf of the contemnors and that he did not make those remarks voluntarily, but because of the request and pressure from Justice ABM Khairul Haque he was compelled to make those remarks.”
তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে, সাবেক এবং বর্তমান সকল বিচারপতিই আসলে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন? এটা কি বিশ্বাস করার মত কোনো কথা? এটা কি আদৌ সম্ভব? আসলে বিচারপতি সিনহার এই ধরনের “ষড়যন্ত্র থিওরি” প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য নিজের কুকর্ম ঢাকা দেওয়া ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
বিচারপতি সিনহার মতে আমাদের বিচার বিভাগ কিছুতেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না কারণ আমাদের নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগকে প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করে আসছে। আবার একই সাথে তিনি অভিযোগ করেছেন যে, আমাদের বিচারপতিদের আসলেই স্বাধীন ব্যক্তিত্বের অভাব রয়েছে। তাঁরা নিজেরাই নাকি পারেন না নির্বাহী বিভাগের চাপকে অগ্রাহ্য করতে। তবে মজার ব্যাপার হল, কোনো বিচারপতি যদি বিচারপতি সিনহার সঙ্গে একমত না হন, বা তাঁর প্রত্যাশিত পথে না হাঁটেন তবেই তিনি মনে করে বসেন যে ঐ বিচারপতি ব্যক্তিত্বহীন।
এর একটি উদাহরণ বিচারপতি সিনহা দিয়েছেন তাঁর বই এ। আমরা জানি আমাদের সংবিধান অনুযায়ী যে কোনো বিচারপতির স্বাধীনভাবে বিচারিক কাজ করার এখতিয়ার আছে। সুতরাং যে কোনো মামলাতে বিভক্ত রায় আসতেই পারে। যেমনটি ঘটেছে হাইকোর্ট বিভাগে ষোড়শ সংশোধনীর মামলাতে। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ এবং বিচারপতি আশরাফুল কামাল বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। দু’পক্ষই নিজ নিজ আইনি ব্যাখ্যা রায়ে তুলে ধরেছেন। কিন্তু বিচারপতি সিনহা এই রায় থেকে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তাতে তিনি বিচারপতি আশরাফুল কামালের বিরুদ্ধে ব্যক্তিত্বহীনতার বায়বীয় অভিযোগ তুললেন। বইয়ের অধ্যায় ২৭-এ তিনি লিখেছেন:
“Quazi Reza-ul Hoque maintained his integrity and did not succumb to the pressure whereas Md. Ashraful Kamal possibly could not overcome the pressure.”
অথচ আমরা জানি এই বিচারপতি আশরাফুল কামাল বাংলা ভাষায় উচ্চ আদালতে রায় লেখার বিষয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। স্রেফ তার সঙ্গে মতের মিল না হবার কারণে এমন একজন জাতীয়তাবোধসম্পন্ন বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যক্তিত্বহীনতার বায়বীয় অভিযোগ তুলতেও বিচারপতি সিনহা কুণ্ঠাবোধ করেননি।
“এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে বিচারপতি সিনহা তাঁর জ্যেষ্ঠ ও সহকর্মী বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সীমাহীন অভিযোগ এনেছেন; অযথা বিষদগার করেছেন। যেই বিচার বিভাগে তিনি ১৮ বছর সময় কাটালেন, যে বিচারপতিদের সঙ্গে তিনি এই ১৮ বছর কাজ করলেন তাঁদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের শেষ নেই। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে এত বিদ্বেষ, এত অভিযোগ থাকলে এতটা পথ এক সঙ্গে তিনি হাঁটলেন কী করে! অনেক আগেই তো তাঁর পদত্যাগ করা উচিৎ ছিল। বিচারপতি সিনহার উল্লেখিত অভিযোগগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তো বিচারপতি সিনহার বিচার বিভাগ নিয়ে কোনো স্বপ্নই দেখার কথা না। সেক্ষেত্রে স্বপ্নভঙ্গের কথাও তো আসে না। তাহলে বিচারপতি সিনহা এই ১৮ বছর ধরে কিসের মোহে পড়ে রইলেন বিচার বিভাগের চৌকাঠ ধরে? বিচারপতি সিনহা কি তবে “এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিনড্রোম” থেকে কখনই বের হতে পারবেন না?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৮
জেএম/