ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাহসী ফারজানা এবং মিডিয়ার দায়

কামাল পারভেজ, সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন বাংলা চট্টগ্রাম। | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১১

ফারজানার সাহস আরেকবার নাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের। বিয়ের আসরে বরকে তালাক বলে চমকে দিয়েছেন আমাদের।

সাহসের প্রতীক হয়ে উঠেছেন আমাদের এ বোনটি। সেই সঙ্গে আমাদের লজ্জায়ও নুইয়ে দিয়েছেন।

বরগুনার আমতলি উপজেলার কালিপুরা গ্রামের মেয়ে ফারজানা ইয়াসমিন। ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করা মেয়ে। বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে গ্রামে গেছেন। এই সমাজে ছেলে-মেয়ের পছন্দটাই যেখানে মুখ্য হয়ে উঠছে, সেখানে ফারজানা নড়েবড়ে হয়ে ওঠা সামাজিকতার পুরনো খুঁটিটা আরেকবার শক্ত করে বাঁধতে গেছেন। ছেলেও শিক্ষিত। স্কুলশিক্ষক। শওকত আলী হীরন। বাড়ি পটুয়াখালির কলাপাড়ায়। সেখানকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
 
কিন্তু সবকিছুই ওলটপালট করে দিলেন ফারজানা। তার সাহসের জোরে। শিক্ষার জোরে। নৈতিকতার জোরে। ঘটনাটা হচ্ছে এরকম: গত শুক্রবার ফারজানার সঙ্গে শওকতের বিয়ে হয়। সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন। কিন্তু কনেকে বরপক্ষের কাছে তুলে দিতে গিয়েই বাঁধে বিপত্তি। শওকতের ফুফু তাহমিনা বেগম (তিনিও কলাপাড়া সদরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) ফারজানার অভিভাবকদের কাছে যৌতুক চান। জানান, টিভি-ফ্রিজ, মোটরসাইকেল দিতে হবে। সেই আবদারে সায় দেন বর শওকত। সেখানে নানা দর কষাকষির একপর্যায়ে এগিয়ে আসেন ফারজানা। জানিয়ে দেন তিনি শওকতের সঙ্গে সংসার করবেন না। তৎক্ষণাৎ তাকে তালাক দেন।
 
দারুণ এক সাহসী উচ্চারণ। আমরা নিকট অতীতে এমন উচ্চারণ শুনিনি। এমন নাগপাশছেঁড়া বুলেট-চপেটাঘাত খুব কমই লেগেছে সমাজের গায়ে।
এখনো যেখানে আমরা মেয়েদের চারপাশের আগল ভাঙ্গার গান গাই, সেখানে ফারজানার এই সাহস, দৃঢ়তা-বাড়তি মাত্রাতো দেবেই।

দিয়েছেও সত্যি। খবরটি এসেছে সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু বড় করুণভাবে। কেউ কেউ বাইরে ছেপেছে, কেউবা ভিতরে। কিন্তু কেউ সিঙ্গেল কলাম অতিক্রম করে নয়। অদ্ভুত এক মিল আছে সবখানে। কেউ এক কলামের বেশি জায়গা দিতে চায়নি এ খবরটির। আবার কেউ কেউ স্কুলশিক্ষক নামের সেই শিক্ষিত গোঁয়ারটির পরিচয় ছাপতে বড় কৃপণতার পরিচয় দিয়েছে। তার বিস্তারিত পরিচয়টুকু দিতে চায়নি। পাছে তার কলংক হবে যে!

আমরা জানি, অনেককিছুতে গণমাধ্যমের ভূমিকা সরকারের অসীম ক্ষমতার চেয়েও বেশি কাজ দেয়। বিশেষ করে, গ্রামে ফতোয়া-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের সোচ্চার কন্ঠ অনেককিছু বদলে দিয়েছে। এখনো মানুষ বিচার না পেলে আগে গণমাধ্যমের দুয়ারে আসেন। আস্থা রাখেন।
 
কিন্তু সেই আস্থার প্রতিফলন কেন আমরা ফারজানার বেলায় দেখলাম  না? এই সমাজে এখনো বেশিরভাগ মেয়ে যেখানে পরিবারের ভুল সিদ্ধান্তওমেনে নিচ্ছে অসহায়ভাবে, সাহসের অভাবে সেখানে এক ফারজানার কৃতিত্বটাকে কেন আমরা বড় করে দেখাতে পারি না। কেন আরেকটু বড় স্পেস পায় না ফারজানা? ফারজানার খবরটি যেদিন ছাপা হয়েছে (রোববার), সেদিন সংবাদপত্রে আরো অনেক খবর ছাপা হয়েছে। দুই-তিন কলাম করে সেসব খবর ছাপা হয়েছে। তার অনেক খবরই হয়ত সেভাবে গুরুত্ব রাখে কিনা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।

কিন্তু ফারজানার খবরটি আবারো সমাজের-বিবেকের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যেখানে বড় দাওয়াই হবার সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছিল, সেখানে গণমাধ্যম তা করল না। সুযোগটা নিল না। বা নিতে চাইল না।

আমরা গ্রামে আগে দেখতাম প্রকাশ্যে যৌতুক নিয়ে দর কষাকষি হত। সময়ে তা পাল্টেছে। এখন বলা হচ্ছে, মেয়ের সঙ্গে যা দেন দিতে পারেন খুশি হয়ে। আগে দরকষাকষি হত বলে দেওয়া- নেওয়ার বিষয়টি এক হিসাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এখন দরজা খোলা রেখে আরো বেশি করে বেকায়দায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে মেয়ের পরিবারকে। অনেককে দেখেছি, বরপক্ষ নির্দিষ্ট করে কিছু চায়নি বলে তাদের মন জোগাতে, ভাল জিনিসপত্র দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে-খেয়েছে। আইন-আন্দোলনের পরও যখন নতুন মোড়কে যৌতুক দেওয়া- নেওয়ার এই অবস্থা, তখন আমরা কী করে বলি, সমাজ অনেকখানি সভ্য হয়েছে।

সেখানে ফারজানা হতে পারে নতুন এক আন্দোলনের প্রতীক। নতুন এক সাহসের নাম। সেটাই কেন সামান্য ভীরুতার সাঁকো ধরে সহজে পার করে দিতে চাচ্ছে সংবাদমাধ্যম, তাই এক রহস্য। তাই এক বিরাট প্রশ্নের। ভবিষ্যতের জন্য একটা বিরাট ঝুঁকি-দায় মাথায় নিয়েও ফারজানা যদি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন, সেখানে মিডিয়ার দায় নিতে না পারার অজানা অক্ষমতা আমাদের বিস্মিত করে।

এখন মিডিয়ার পাশাপাশি ফারজানার জন্য দায় আছে সরকারের-স্থানীয় প্রশাসনের। কারণ, আমরা জানি আইন করে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই আইন অনুসারে কেউ যৌতুক চাইলে-নিলে, মামলা না হলেও প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে। এমন বিধান আছে। প্রশাসনের ক্ষমতা আছে। এখন তাদের উচিত, সেই শিক্ষক নামধারী যৌতুকবাজ শওকত এবং তার ফুফু তাহমিনা বেগমকে আইনের আওতায় আনা। তারা শিক্ষকতা পেশায় থাকতে পারেন কিনা, তা খতিয়ে দেখা। কারণ, তারা আইনিভাবে দোষী সাব্যস্ত না হলেও শিক্ষক পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। সরকারি স্কুলের শিক্ষক হয়েও সরকারি আইন ভেঙ্গেছেন। অপরাধ করেছেন।
 
যারা সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়েও আইন ভাঙ্গেন, নৈতিকতার রীতি ভাঙ্গেন তখন তারা সমাজে আলোর বদলে অন্ধকারই ছড়ান। শিক্ষা বিলাতে পারেন না। কেবল প্রশাসন নয়, এখন এ বিষয়টি বড় করে আলোচনায় এনে নিজেদের দায় মেটাতে পারে গণমাধ্যম।

[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।