ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র: আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৯
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র: আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা

আজ ১০ এপ্রিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস। ১৯৭১ সালে আজকের এই দিনেই বাঙালি জাতি তার আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিল। 

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক দলিল। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫০(১) অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালীন অস্থায়ী বিধান হিসেবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হবে।



পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখন সম্পূর্ণ আকারে বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে (পঞ্চম তফসিল)। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদ একটি মৌলিক কাঠামো রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দান করেছে । এর ফলে ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অসংশোধনযোগ্য বিধানে পরিণত হয়েছে।

বহু বছরের জাতিগত বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির অন্তর্গত বাঙালি জনগোষ্ঠী তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। জন্ম নেয় একটি নতুন রাষ্ট্র - বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস মোটেও সুখকর নয়। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য প্রয়োজন: (ক) একটি সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী; (খ) একটি সুনিরূপিত সীমানা; (গ) একটি সরকার ব্যবস্থা; এবং (ঘ) সার্বভৌমত্ব। আন্তর্জাতিক আইনে আবার শুধু এই চারটি বিষয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র যতক্ষণ না পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে রাষ্ট্র বলা হয় না।

যেহেতু আন্তর্জাতিক আইনে রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রয়োজন, সেহেতু পূর্ব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের একটি অংশ যখন, তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে তখন আন্তর্জাতিক মহল কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার-বিরুদ্ধ। একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের মাথাব্যথা থাকবার কথা নয়। তবে দু’টো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশ্ব কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য। প্রথমত; যখন রাষ্ট্র তার নাগরিকের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে; এবং দ্বিতীয়; যখন রাষ্ট্রের অন্তর্গত কোনো জনগোষ্ঠী সার্থকভাবে তার আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োগের স্বীকৃতি লাভ করে।

জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার একটি প্রাচীনতম অধিকার। যদিও আন্তর্জাতিক আইনে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি এসেছে অনেক পরে, তথাপি আমরা দেখেছি যুগে যুগে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের সফল প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া অথবা পরবর্তীতে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োগে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব লাভের নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। যুগে যুগে ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার-এর যে ইতিহাস আমরা দেখি, ঠিক একইরকমভাবে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি ও প্রয়োগের ইতিহাসও অনেক প্রাচীন। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সময়ে এবং পরে ‘জাতীয়তাবাদ’ চেতনার যে উত্থান তা বেশিরভাগ সময়েই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিল। একদিকে যখন অটোমান, রাশিয়ান, অস্ট্রিয়ান অথবা জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব দখলের নগ্ন প্রতিযোগিতা চলেছে, ঠিক তখন একইসঙ্গে অবহেলিত, শোষিত, নির্যাতিত জনগোষ্ঠী তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে।

আধুনিক বিশ্বে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের সফল প্রয়োগ আমরা দেখি ১৭৭৬ সালে উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ অধ্যুষিত কলোনিসমূহের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে। একই রকমভাবে, ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সফল বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয়। ১৯ শতকজুড়ে বিশ্বব্যাপী আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের সফল দাবি জানিয়েছে আমেরিকার স্পেন অধ্যুষিত রাষ্ট্রসমূহ এবং ইউরোপে গ্রিস, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অন্যতম ভিত্তি হলো জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন। কার্ল মার্কস এবং ভ্লাদিমির লেনিন-এর লেখায় আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি ঘুরে-ফিরে এসেছে বহুবার। আর তাই, ১৯১৭-এর বলশেভিক যুদ্ধের পর ১৯১৮ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকারকে সুনির্দিষ্টভাবে সংযোজন করা হয়। বিশ শতকের গোড়ার দিকে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার  দাবিতে জোরালো সংগ্রাম হতে দেখা যায়। ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি লাভ করে কানাডা, নিউজিল্যান্ড, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, আইরিশ ফ্রি স্টেট, কমনওয়েলথ অব অস্ট্রেলিয়া ও ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকা এবং ফরাসি ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পায় লেবানন।

আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনে সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৪৫ সালের ইউনাইটেড ন্যাশনস চার্টারে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়: ‘To develop friendly relations among nations based on respect for the principle of equal rights and self-determination of peoples and to take appropriate measures to strengthen universal peace.’

১৯৪৮ সালের Universal Declaration of Human Rights সনদে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি পরোক্ষভাবে উল্লিখিত হয়: ‘Everyone has the right to a nationality and that no one should be arbitrarily deprived of a nationality or denied the right to change nationality.’

তবে, জাতিসংঘের ১৯৬০ সালের ঘোষণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের পূর্ণ স্বীকৃতি। একইভাবে ১৯৬৫ সালের International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) এবং International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights (ICESCR) এর দুটোতেই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে: ‘All peoples have the right of self-determination. By virtue of that right they freely determine their political status and freely pursue their economic, social and cultural development.’

এছাড়া ১৯৭০ সালের Declaration on Principles of International Law-তেও আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব লাভ করেছে। জাতিসংঘের অধীনস্তঃ অন্যতম বিচারিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ১৯৭১ সালের ২১ জুন বিখ্যাত ‘নামিবিয়া অপিনিয়নে’ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে শাসিত/শোষিত জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োগকে আন্তর্জাতিক আইনে একটি ন্যায়সম্মত দাবি বলে ঘোষণা করে।

বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক আইনের এইরূপ সমর্থনে এবং জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের সর্বজনীন স্বীকৃতির ফলশ্রুতিতে অতীতের ঔপনিবেশিক কলোনিগুলো এক এক করে স্বাধীনতা লাভ করতে শুরু করে গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্বে শুধু ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োগের ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থিত ছিল। মনে করা হতো, পূর্বে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোনো জনগোষ্ঠী যদি সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োগের দাবি করে তবে তা অবশ্যই ‘রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার’ পরিপন্থী হবে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব কোনোক্রমেই এরকম দাবিকে সমর্থন করবে না। আর তাই আমরা দেখি, ১৯৭১-এর পূর্ব-পরিস্থিতিতে কাতাঙ্গা, বায়াফ্রা, সুদান, চাদ, ইথিওপিয়া, তিব্বত, কুর্দিস্তান অথবা ফরমোসা-এগুলোর কোনো ক্ষেত্রেই জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োগকে আন্তর্জাতিক মহল স্বীকৃতি দেয়নি। যুক্তি মূলত একটাই- আন্তর্জাতিক বিশ্বে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতাকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার পরিপন্থি কোনোরকম বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক মহল হতে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।
 
১৯৭১ সালে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের অন্তর্গত পূর্ব পাকিস্তানে যখন বাঙালি জনগোষ্ঠী তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়, তখন আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রাথমিকভাবে তা বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আন্তর্জাতিক মহলে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দান করা হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থনের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক উন্মোচিত হয়।

আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার ১৯৪৫ সালের ইউএন চার্টারের সময় হতে সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত হয়ে এলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত এই অধিকার শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বৈধভাবে ব্যবহৃত হতে পারে বলেই ধরে নেওয়া হত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োগের ধারণাটি ব্যাপকতা লাভ করে।

‘রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা’ নীতিকে পরিহার করে, আন্তর্জাতিক বিশ্ব কেন সেদিন বাংলাদেশিদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিল তা অবশ্যই বিবেচনার দাবিদার। কাতাঙ্গা অথবা বায়াফ্রাতে যা সম্ভব হয়নি, বাংলাদেশে কেন তা সম্ভব হলো তা আন্তর্জাতিক আইন গবেষক মাত্রই জানতে আগ্রহী হবেন। মোট কথা কেন আন্তর্জাতিক আইন বাংলাদেশের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োগে স্বাধীনতা ঘোষণাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপ না ভেবে বরং এটিকে আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা দান করেছে, তা আমাদের জানা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক আইনবিশারদেরা বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করবার চেষ্টা করেছেন কেন ‘রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা নীতি’ পরিহারের মূল্যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকে আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তাদের আলোচনায় বেশ কয়েকটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়-
(ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অস্বাভাবিক ভৌগোলিক অবস্থানগত দূরত্ব;
(খ) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, ঐতিহ্যগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষণীয় বৈষম্য;
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে উত্থাপিত হয়েছিল; কোনো সামরিক বাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক উত্তরণের হাতিয়ার হিসেবে নয়;
(ঘ) পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর (প্রায় ৫৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর) পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়;
(ঙ) পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দাবি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না; বরং ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর হতেই প্রায় ২৪ বছর ধরে নানা রকম শোষণ, বৈষম্য ও নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে তা দৃঢ়তা লাভ করেছে; পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী নানারকম শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, আলাপ-আলোচনা এবং সমঝোতায় ব্যর্থ হয়ে তবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে;
(চ) পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর কোনোরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হওয়ার আশংকা ছিল না;
(ছ) পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তান রাষ্ট্র তার জন্মের পর হতেই নির্বিচারে শোষণ ও অত্যাচার করেছে; এমনকি ২৫শে মার্চের থেকে যে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও সশস্ত্র আক্রমণ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত করা হয়েছিল- তার সবই ছিল আন্তর্জাতিক আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ;
(জ) পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবির প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের প্রভাবশালী অংশের সহমর্মী মনোভাব ও সহযোগী আশ্বাস ছিল।

ওপরে আলোচিত বিষয়সমূহের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা লাভ করে। সৃষ্টি হয় আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক নতুন যুগ, যেখানে আন্তর্জাতিক আইন ‘রাষ্ট্রের অখণ্ডতা’ রক্ষার আন্তর্জাতিক নীতিকে বিসর্জন দিয়ে মানবমুক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১৯৭২ সালের প্রণীত সংবিধান-এর সবকিছুই প্রতিফলিত করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি আদায় এবং সংগ্রামের ইতিহাসকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার তাই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ১৯৭১-এর মার্চে আত্ম-নিয়ন্ত্রিত জনগোষ্ঠী চেয়েছিল- (ক) বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র; (খ) বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি; (গ) গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্ণতা; (ঘ) শোষণবিহীন সমাজ ব্যবস্থা; এবং (ঙ) ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় কাঠামো।

বাংলাদেশের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ একটি ঐতিহাসিক সত্য। এই সত্যটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি অর্জন করেছে, তেমনি অন্যদিকে সাংবিধানিক প্রতিকৃতি লাভ করেছে। যে জাতি ‘রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা’র প্রাচীর ভেদ করে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ে সফল হয়েছে, সে জাতি যদি নিজে তার আত্ম-প্রকৃতি ভুলে বসে, তবে ১৯৭১ মিথ্যে হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটিয়ে, পুঁজিবাদী শোষণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এবং রাষ্ট্রকে ইসলামী নেকাবে আবৃত করে যে রাষ্ট্রকে আজ আমরা ‘বাংলাদেশ’ নামে বিশ্বমাঝে পরিচিত করে তুলতে চাইছি, তা কোনো অবস্থায়ই ১৯৭১ সালের বাঙালি জনগোষ্ঠীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশ নয়।

লেখক; আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।