ক্লাস ফাইভ। হরতাল দেখব বলে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। বাজারের ও মাথায় ঢাউস সাইজের গাছের গুড়ি রাস্তায় ফেলা হয়েছে। সুতরাং রিকশা চলাচলও বন্ধ। সাইকেল নিয়ে গেলেও রাস্তার নিচ দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হরতালের সমর্থনে মিছিল হচ্ছে। মিছিল শেষে চা সিঙ্গারার এন্তেজাম থাকে। আমিও মিছিলে শরিক হলাম। আমার ভাগে সিঙ্গারা পড়েনি। পড়েছে দুটা বেলা বিস্কুট। রং চা পেয়েছি। চায়ে বিস্কিট চুবিয়ে খাচ্ছি। চা শেষ হবার আগেই ধরধর করে দৌড়ানি শুরু হল। দৌড়ে স্কুলের পেছনে টিনের বাথরুমের সামনে হাজির। মারামারির সময় বাথরুমই নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দেখি কেউ একজন আমাদের আগেই ঢুকে বসে আছে। আমরা তার নিরাপত্তা আরো নিশ্চিত করে দিয়ে এলাম। দরজার বাইরে থেকে হুক লাগিয়ে দিলাম। এখন আর কেউ সন্দেহ করবে না ভিতরে কেউ আছে।
ঠুস ঠাস দুটো বোমাও ফাটল। চারদিকে শুধু দৌড়াদৌড়ির শব্দ আর দোকানের শাটার বন্ধ করার শব্দ। কানু মিয়ার দোকানের সামনে বিএনপি’র চ্যালা জুবায়ের ভাইয়ের পায়ে বোমা পড়েছে। পা উড়ে গেছে। দৌড় দিলাম সদ্য ল্যাংড়া হওয়া জুবায়ের ভাইকে দেখার জন্য। গিয়ে দেখি সেখানে নাই। কানু মিয়ার দোকানের সামনে মেঝেতে পড়ে আছে তার কিছু রক্ত। ততক্ষণে উত্তেজনায় আমাদের রক্তও টগবগ করছে। মারাত্মক থ্রিল অনুভব করছি। জোবায়ের ভাইকে দেখতে না পারার হতাশা কাজ করছে। আশা করছি, শিগগিরই আরো কয়েকজনের পায়ে বোমা পড়বে। পাড়ার পরিচিত কয়েকজন বিএনপি’র বড়ভাই বিশাল সাইজের রামদা নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। রামদা ওয়ালার পেছনে পেছনে আমরাও দৌড়াচ্ছি। রাম দা দিয়ে কাউকে কোপ দেয় কিনা তা দেখব। ছোট ছিলাম বলে আমাদের কোনও ভয় ছিল না। আমাদেরও কেউ কিছু বলছিল না। বরং কৌতূহল কাজ করছিল প্রচণ্ড। আওয়ামীলীগের দু জনকে ধরে আনা হলো। রাম দা নিয়ে বিএনপি’র বড় ভাইরা হম্বিতম্বি করছিল। কিন্তু কাউকে কোপ দিচ্ছিল না। একজন কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার করে দা উঠায়। প্রতিবারই আমরা সে দৃশ্য দেখব বলে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ছি। কোপ দেয় না। দা নামিয়ে ফেলে। হম্বিতম্বি দেখে আমরা কাহিল।
অবশেষে বাংলাছবির মতো শেষ দৃশ্যে পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা গেল। এবার আওয়ামীলীগ বিএনপি যুগপৎভাবে পালাচ্ছে। বিএনপি ক্ষমতায়, বিএনপি পালাচ্ছে কেন বুঝলাম না। বোঝাবুঝির কারবার পরে। এখন পালানোর সেশন। আমরাও তাদের সাথে সাথে ধান ক্ষেতের আইল দিলে পালালাম।
এটা নব্বই এর দশকের প্রথম দিকে বেগম জিয়ার প্রথম কালের ঘটনা। আমার প্রথম হরতাল দর্শন। এরপর অনেক হরতাল দেখেছি। এখনো দেখছি। এখনকার হরতালকারীরা আর নুপুংসক নেই। তারা জোয়ার মর্দ হয়ে গেছে। এখন পিকেটাররা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলে। মৃত লাশের উপর আফ্রিকান জংলীদের ন্যায় মনমুগ্ধকর ওয়াকা ওয়াকা নৃত্য হয়। যে দলের লোক মারা গেছে তারাও খুশি। পুরো দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করা হয়। বিভিন্ন দূতাবাসে এই ওয়াকা-ওয়াকা ভিডিও পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় চা সিঙ্গারা দাওয়াত দিয়ে এই ভিডিও দেখানো হয়। যদি একটু সহানুভূতি পাওয়া যায়। যদি একটু করুণা বর্ষণ হয়। আর আমরা সাধারণ জনগণ হরতালের দিনে স্রষ্টার করুণা বর্ষণের আশায় বসে থাকি। দিনটি যেন শুভ যায় দোয়া করি।
শেষের গদ্য (পাদটীকা) :
৪ তারিখ হরতাল দিয়েছে বিএনপি। যেসব দিন আমাদের এমনিতেই শুভ হয় বা না হলেও বিশেষ কোন ক্ষতি হয়ে যায় না আমরা সেই সব দিনে প্রায়শঃই ‘শুভ’ শব্দটি যোগ করে দিই, শুভ কামনা করি। যেমন শুভ জন্মদিন, শুভ নববর্ষ বা শুভ বিবাহবার্ষিকী। আর যেসব দিন শুভ হওয়া একান্তই অপরিহার্য সেই সব দিনে আমরা শুভ বলে শুভ কামনা করি না। হরতাল তেমনই একটি দিন। নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত ব্যস্ত মানুষ রুটি রুজির ধান্ধায় হরতালের দিন রাস্তায় বেরোয়। পুলিশের এবং পিকেটারের ইট ছোড়াছুড়িতে কিছু মানুষ রাস্তায় চিৎপটাং হয়। আর তথাকথিত সন্দেহজনক গতিবিধির আওতায় পড়ে কিছু মানুষের হাজতবাস হয়। দু একজন গোলাগোলিতে ভবলীলা সাঙ্গ করে বিদায় নিয়েও বিপদে পড়েন। তার লাশ নিয়ে মিটিং হয়। মিছিল হয়। শেষে পোস্ট মর্টেমের নামে কাটাছেঁড়া হয়। লাশ নিশ্চয়ই মনে মনে বলে, `না মরাটাই ভাল ছিল। মরে গিয়েই বিপদে পড়লাম !`
হরতাল আমাদের জন্য সরকারি ও বিরোধীদলের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার একটি দিন। ছেড়ে দে মা, কেদে বাঁচি টাইপের দিন।
আসুন আমরা হরতালের এই দিনটাতে বলি- হরতাল শুভ হোক। এই দিনটা শুভ হওয়া খুবই জরুরি ।
মনোয়ার রুবেল
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও ব্লগার।
[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১৩৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১১