ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আমরা কি নারীর প্রতি সহিংসতা আপসে মেনে নিয়েছি?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৯
আমরা কি নারীর প্রতি সহিংসতা আপসে মেনে নিয়েছি?

গোটা মহাদেশের রাজনীতিতে চলছে এক চরম অস্থিরতা। ভারতে সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও ৩৫ এর এ ধারা তুলে দিয়ে সেখানকার সরকার গোটা কাশ্মীরে যে অশান্তির আগুন জ্বেলে দিয়েছে, তার উত্তাপ শুধু কাশ্মীর বা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমগ্র বিশ্বে এই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি আলোচনার শিরোনাম হয়ে রয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে প্রতিদিন নতুন নতুন সংবাদ তৈরি হয় আর আমাদের দৃষ্টি সেখানেই আটকে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কড়া হুঁশিয়ারি ও যুক্তরাজ্যের কঠোর মনোভাবকে উপেক্ষা করে ইরানের তেল ট্যাংকার ছাড়া পাওয়ার ঘটনা আমাদের চামড়া শিল্প নিয়ে ভয়ঙ্কর আশঙ্কার খবরকে ছাপিয়ে গেছে।

এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত সামনের দিনগুলোতে প্রবেশ করছি আরও নতুন খবরকে সঙ্গে নিয়ে। তথাপি আমরা ভুলতে পারি না কিশোরী ইয়াসমিনের প্রতি নৃশংসতাকে, তনুর প্রতি পাশবিকতাকে, নুসরত জাহানকে হত্যার ঘটনাকে।

প্রতিদিন আমাদের চারপাশে এমন শত শত ঘটনা ঘটে চলেছে যেগুলো উল্লিখিত ঘটনাগুলোকে ছাপিয়ে নতুন শিরোনাম হচ্ছে। সুজলা, সুফলা, শষ্য-শ্যামলা এই সোনার বাংলার পবিত্র মাটি আজ সম্ভ্রমহীন নারীর কান্নায়, নির্যাতিতা নারীর দীর্ঘশ্বাসে বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। নির্যাতিত এই নারী-কিশোরী-শিশুদের আর্তনাদে বাংলার আকাশ-বাতাশ প্রকম্পিত হচ্ছে। বাংলার পবিত্র মাটিতে পুরুষ নামক দুই শ্রণির মানুষেরই এখন জন্ম হচ্ছে বেশি মাত্রায়, ধর্ষক ও নপূংশক! অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বাংলা মা আজ সুস্থ মস্তিষ্কের বিবেকবান সুপুরুষের জন্মদানের ক্ষেত্রে অনেকটা বন্ধ্যা হয়ে পড়েছে।

প্রতিদিন সংবাদপত্রে অগণিত সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষরূপী হায়েনাদের হাতে মায়ের জাত, নারীদের সম্ভ্রমহানির ঘটনা নিয়ে। এই তালিকায় যেমন রয়েছেন শতবর্ষী নারী (দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ ও ২৫ মে, ২০১৯), তেমনি রয়েছে ছয় মাসের শিশু (পরিবর্তন.কম, ৭ মে, ২০১৭)! একটা পশুর ভেতরেও এমনটা হিংস্র প্রবৃত্তি লক্ষ্য করা যায় না যা আজ মানুষের ভেতর চরম মাত্রায় দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, এই সহিংসতার যে সংখ্যা তা রীতিমতো ভীতিকর। দৈনিক ইত্তেফাক এ বছরের ১১ জুলাই তারিখে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের বরাত দিয়ে প্রকাশ করেছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে শুধু ৪৯৬টি। এরমধ্যে আড়াই বছরের শিশু থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে! ওই সংস্থাটি শুধু প্রতিবেদন তৈরি করেছে প্রকাশিত খবরের। এই খবরগুলো প্রকাশিত হয় হিমশৈলের ভাষমান অংশের মতো। অর্থাৎ, লোকলজ্জার ভয়ে বিরাট অংশের খবর অপ্রকাশিত থেকে যায়। তাছাড়া এই সংখ্যাটি শুধু কন্যা শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতনের প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে তৈরিকৃত প্রতিবেদনের। যদি অপ্রকাশিত সংখ্যা, কিশোরী, নারী, বৃদ্ধা সবার প্রতি যে নির্যাতন ও সহিংসতা সংগঠিত হয়েছে তা একত্রিত করা হয়, তাহলে এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটি আমরা কল্পনাও করতে পারবো না!

প্রতিদিন নতুন নতুন মাত্রা ও নতুন অপকৌশল যুক্ত হচ্ছে এই জঘন্যতাকে বেগবান করার জন্য। ভারত থেকে আমদানি করা সেই ‘নির্ভয়া নির্যাতনের কৌশল’ তথা ‘চলন্ত গাড়িতে নারীর শ্লীলতাহানি’ ব্যাপকভাবে লুফে নিয়েছে এদেশের বিকৃতমনা দল! শুধু তাই নয়, তাতে যুক্ত করছে ভিন্ন মাত্রা। পুরো একটি জাতির স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে ‘কাশ্মীরী গার্ল’ লিখে গুগলে সার্চ করার মতো বিকৃত রেকর্ড তৈরি হচ্ছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীবের এই ধরণীতে! এই নৃশংসতার শেষ কোথায় আমরা সত্যিই জানি না। নারীর প্রতি এমন অবর্ণনীয় নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা হচ্ছে সবশ্রেণীর পুরুষ নামের কিছু হিংস্র ইতরের দল। এই ঘটনাগুলো আমাদের বরাবরই কাঁদিয়ে যায়। তবু আমরা হতবিহ্বল হয়ে যাই, আমাদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, আমরা হতাশার তলানীতে নিমজ্জিত হই, যখন দেখি নরকের কীটগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাবা’ নামের পবিত্র মুখোশ পরা ব্যক্তি। তাকে আবার সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে জঘন্য কাজটি করতে সহায়তা করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়খ্যাত ‘মা’ নামের আরেকটি পবিত্র সত্তা (দৈনিক সমকাল, ১৯ জুলাই, ২০১৯)। আমরা আঁতকে উঠি, যখন শুনতে পাই- এই জঘন্যতম অপরাধটির নায়ক সমাজের সবচেয়ে পবিত্র দায়িত্বের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক। আমরা অত্যন্ত মর্মাহত হই, যখন জানতে পারি এই নিকৃষ্টতম কাজটি করেছে একজন মসজিদের ইমাম, মন্দিরের একজন পুরোহিত। বর্তমানে এমন শ্রেণী-পেশা, সম্পর্কের পুরুষ পাওয়া কঠিন, যার নাম এই জঘন্যতম কাজটি সংগঠনকারীর তালিকায় পাওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে পুরুষ নামক প্রজাতিটি নারীলোলুপ পিশাচ হিসেবে সৃষ্টির সবচেয়ে অমঙ্গল ভয়াবহতার মূর্ত প্রতীকে পরিণত হতে চলেছে।

মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী যদি ইতিহাস রচনায় অংশ নিতে পারতো, তাহলে হয়তো সৃষ্টির সেরা জীবের পাশাপাশি মানুষ সম্পর্কে এত নিকৃষ্ট ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করা হতো, যা দেখে সৃষ্টিকূলের প্রত্যেকটি প্রাণী এই প্রজাতি থেকে লজ্জায়, ঘৃণায়, ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতো হয়তো। লোলুপতার বিশ্বে মানবতা আজ সত্যিই নির্বাসিত। প্রতিদিনের নিষ্ঠুরতা আগত দিনটিতে অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই পাশবিক মানসিকতা সজীব ও শুভ্র জীবনের সমস্ত রং নষ্ট করে দিয়ে তাকে নরকে পরিণত করেছে।

অথচ সৃষ্টির আইনে সে বিধান ছিল না। নারী-পুরুষ একত্রে মিলে যেন পৃথিবীটাকে স্বর্গীয় রূপে গড়ে তুলতে পারে তার সমস্ত উপকরণ অকাতরে দিয়েছেন মহান সৃষ্টিকর্তা। দিয়েছেন জীবন বিধান। সেই বিধান মোতাবেক মানবজীবন এমন বিশ্রী ও পাশবিক হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটানোর সময় স্রষ্টা উভয়েরই পূর্ণ অধিকার দিয়ে দিয়েছেন। নারীর মাঝে দিয়েছেন মাতৃত্ব, মমতা, ভালোবাসার আধার। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘এই পৃথিবী এবং এর মধ্যস্থিত সব কিছুই মূল্যবান। কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে একজন সৎকর্মশীল নারী’ (মুসলিম)। সেই নারীকেই এতটা অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে যে, পৃথিবীটা আজ নারীর জন্য নরকে পরিণত হয়েছে। স্রষ্টার বিধান ছাড়াও দেশে দেশে নিজেদের জন্যই মানুষ নিজেরা তৈরি করেছে আইন, সংবিধান, নীতি ও আদর্শ। সবকিছুতেই নারী ও পুরুষের প্রতিভার বিকাশের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।  

এত কিছুর পরও শুধু দৈহিক শক্তির বলে নারীর জন্য পৃথিবীকে বিষময় করেছে পুরুষ সমাজের কতিপয় কীট। সমাজে পুরুষ মানুষের দু’টি শ্রেণীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই নিবন্ধে। যে একটা শ্রেণীর কথা এতক্ষণ উল্লেখ করা হয়েছে, তারা বিকৃত মস্তিষ্কের দ্বারা পরিচালিত হয়ে দৈহিক শক্তিকে পুঁজি করে পৃথিবীটাকে নরক বানিয়ে নিজেদের পরিচিত করেছে ধর্ষক হিসেবে। এর বাইরে আর যে শ্রেণীটি রয়েছে তারা সমস্ত বৈধ শক্তি থাকা সত্ত্বেও নারীর প্রতি সমস্ত প্রকার অত্যাচার, নির্যাতনকে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন, মাঝে মাঝে বিলাপ করছেন। এদের আচরণ দেখে মনে হয়, এরা নারীর প্রতি সমস্ত প্রকারের সহিংসতার সঙ্গে একটা আপস-রফা করে ফেলেছেন! অথবা এরা পৌরুষত্বকে বিসর্জন দিয়ে একটা নপুংসক শ্রেণীতে পরিণত হয়েছেন। একথা যদি মেনেও নেই, তবু সময় ইতোমধ্যেই অনেকটা পেরিয়ে গেছে আবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার- আমরা কি পুরুষত্বহীন জাতি হয়ে সবকিছু সহ্য করে যাবো, যতদিন না নির্যাতিত নারীদের দীর্ঘশ্বাসের ভারে খোদার আরশ কাঁপিয়ে পৃথিবী ধ্বংস না হয়? নাকি পৌরুষত্বকে জাগ্রত করে সমস্ত অন্যায়ের বিপরীতে রুখে দাঁড়াবো? আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা প্রয়োজন- নারীকে যে পুরুষ যথাচিত সম্মানটুকু করতে পারে না, সে হতে পারে দিগ্বিজয়ী, কিন্তু আসলে সে কাপুরুষ।

লেখক
মো. আক্তারুজ্জামান
সদস্য, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার
পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।