প্রথমেই আসা যাক নীতিমালা কী ও কেন? প্রত্যেকটি পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মানোন্নয়নে করণীয় ঠিক করতে স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদনকৃত একটি যুগোপযোগী নীতিমালা থাকা ও তা অনুসরণ করা উচিত। এক্ষেত্রে নীতিমালাটি যতটা কাছাকাছি বা অভিন্ন করা যায় সেটি চিন্তা করা যেতে পারে।
এবার আসা যাক ভালো শিক্ষক কীভাবে পাওয়া যাবে সে আলোচনায়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভালো মানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে হবে। সেজন্য বিশ্বর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিয়মিত কারিকুলাম ও কোর্স আপডেট করে যেতে হবে। মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অনুকরণীয় হতে পারে। একাডেমিক মেধাক্রমের শীর্ষ সাত শতাংশ বা এটিকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ থেকে অন্যান্য শর্তাবলী পূরণ করা সাপেক্ষে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
লক্ষণীয় বিষয় যে, প্রস্তাবিত নীতিমালাটিকে অভিন্ন বলা হলেও এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং শুধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রভাষক নিয়োগে মেধাক্রমিক শীর্ষ সাত শতাংশ বিষয়টি রাখা হয়েছে যেটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৭-০৮ থেকে কার্যকর রয়েছে। এ বিষয়টি সব বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করতে পারে। শিক্ষক হওয়ার পর তাকে শিক্ষা ও গবেষণায় প্রশিক্ষিত হতে হবে আর এজন্য তাকে বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর ডিগ্রির (এমএস বা পিএইচডি বা পোস্ট ডক) লাভের জন্য পাঠানোর জন্য ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ কি নীতিমালায় রয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের গবেষণার জন্য সাধারণ কোনো বরাদ্দের কথা কি নীতিমালায় রয়েছে? আওয়ামী লীগ সরকারের নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ও প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপে সরকারি খরচে দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ। কিন্তু সেটির ক্ষেত্রেও বেশি অগ্রাধিকার বা কোটা বরাদ্দ রয়েছে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য। অন্যদিকে ৯৯ শতাংশ বা সিংহভাগ শিক্ষকই যাচ্ছেন নিজ প্রচেষ্টায়, যেদেশে যাবেন সেদেশের বৃত্তি বা ফান্ড যোগাড় করে। এহেন পরস্থিতিতে বিদ্যমান আইনে প্রাপ্য ছুটিই একমাত্র সম্বল। সেই ছুটি নিয়েও নানা কালা-কানুন চাপানোর চেষ্টা চলছে প্রস্তাবিত নীতিমালাটিতে। অন্যদিকে সরকারের তথা জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিদেশ সফর, প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসছেন, যার কোনো বাস্তব সুফল দেশবাসী দেখছে না। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজ প্রচেষ্টায় বিশ্বব্যাপী সুনামের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত থেকে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত করছে। শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং সাধারণ গবেষণা অনুদান/বরাদ্দের কথা নীতিমালায় না এলে সায়েন্স সাইটেশন ইনডেক্সড জার্নালগুলোতে গবেষণা প্রকাশনার শর্ত জুড়ে দেওয়া দুই টাকায় ঘিয়ে ভাজা মচমচে জিলাপি খাওয়ার ইচ্ছার মতো বিষয় হয়ে গেল কি-না, সেটাও একটা প্রশ্ন।
আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা অনেকদূর এগিয়ে থাকতো, তার প্রমাণ ইতিহাস ঘাটলেই জানা যায়। স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে দিয়েছিলেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য। কাজটি অনেকদূর এগিয়ে গেলেও পচাঁত্তরে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে সেটির কবর রচিত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ফের পদক্ষেপ নেন শিক্ষানীতি প্রস্তুতিতে এবং শিক্ষানীতি-২০০০ প্রস্তুতও হয়েছিল। কিন্তু ২০০১-এ ক্ষমতার পালাবদলের কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা আবার সরকার গঠন করলে সেটি চূড়ান্তভাবে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধুর নেওয়া পদক্ষেপটি প্রায় চার দশক পরে বাস্তব রূপ লাভ করে। উল্লেখ্য যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়েও ১৯৭৩-এ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল যেটির প্রতিফলনও শিক্ষানীতিতে রয়েছে। এখন দেখা যাক শিক্ষানীতি-২০১০-এ কী বলা আছে-“Autonomy is a must for the centres of higher studies including the universities. (Section-8, page-23)”. “The proper dignity of teachers everywhere from the primary to the highest level is a very important factor. A separate pay scale will be introduced for teachers of all levels to enhance their financial benefits. (section-25, page-60)”. “বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল উচ্চতর শিক্ষা কেন্দ্রে অবশ্যই স্বায়ত্তশাসন থাকবে। ”(সকশন-৮, পৃষ্টা-২৩)। “প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল পর্যায়ের শিক্ষকের যথাযথ সম্মান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সকল পর্যায়ের শিক্ষকের আর্থিক সহায়তা লাভ বৃদ্ধির জন্য একটি আলাদা বেতন কাঠামো করা হবে। ” ( সেকশন-২৫, পৃষ্টা-৬০)।
অভিন্ন নীতিমালাটি প্রস্তুতির কাজে যারা দীর্ঘদিন (প্রায় ৩ বৎসর) জড়িত ছিলেন তারা কি আদৌ জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে অবগত নন? শিক্ষকেরা সম্মানের কোন ক্রমে অবস্থান করছেন সেটি জানার জন্য চলুন দেখা যাক ওয়ারেন্ট অব প্রসিজিউর (১৯৮৬), যেখানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্মানের একটি ক্রম ১ থেকে ২৫ পর্যন্ত রাষ্ট্র করে রেখেছে। সেখানে সরকারের সচিব মহোদয়দের অবস্থান ১৬-তে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়েরা ১৭-তে, অতিরিক্ত সচিব ও সিলেকশন গ্রেড প্রফেসরগণ ১৯-এ, ২১-এ রয়েছেন যুগ্ম-সচিব আর এক ধাপ নিচে ক্রম ২২-এ অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ। উপরোক্ত ক্রম থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সম্মানের জায়গায় সচিবদের অনেক নিচে এবং চাকরির ক্ষেত্রেও সার্বিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতেও অনেক বঞ্চিত। তুলনার কথাটি সঙ্গত ও যৌক্তিক কারণেই এসে যায়। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসেন; আর বিসিএসের পরীক্ষাটি হয় এখনো দশম শ্রেণির সমমানের বাংলা, ইংরেজি, গণিত আর বিএ সমমানের ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান, আন্তর্জাতিক বিষয় ও কিছু বিশেষ বিষয়ের ওপর। এমনকি ব্যাংকাররাও চাকরি ক্ষেত্রে শিক্ষকদের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা প্রাপ্ত হচ্ছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে বিশেষায়িত শিক্ষায় মনোনিবেশ না করে বিসিএস বা ব্যাংকে নিয়োগলাভের জন্য দশম শ্রেণির পড়াশোনা নিয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ছে। যার ফলে আগামী দিনের বাংলাদেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। বিভিন্ন পেশার মধ্যে যখন মর্যাদা ও সুযোগপ্রাপ্তির পার্থক্য কমে আসবে তখন সব পেশাতেই মেধাবীরা যেতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হবে। এতে দুর্নীতি ও আন্তঃপেশা বৈষম্য অনেকটা কমে আসবে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষক শ্রেণীর কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা একটু বেশি। বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও কতিপয় শিক্ষক সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক খবর প্রচার হওয়ায় শিক্ষক সমাজের প্রতিও মানুষের শ্রদ্ধার জায়গাটা একটু হলেও নিচে নেমে এসেছে। যে কোন পেশার ক্ষেত্রেই কর্মের মূল্যায়ন ও জবাবদিহিতা অবশ্যই জরুরি। স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নিয়ে শিক্ষকেরাও নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এর মূল কারণ শিক্ষকদের রাজনীতিচর্চা। রাজনীতিকে টাকা কামানোর হাতিয়ার হিসেবে বানিয়ে নিয়েছেন কিছু শিক্ষক। অবৈধ সিন্ডিকেট তৈরি করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্ষেত্রেই আধিপত্য বিস্তার করে চলছে। সংখ্যায় তারা কম হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের দাপট বেশি। কিন্তু তাদের সেসব কাজের দায় পড়ছে পুরো শিক্ষক সমাজের ওপর। অভিন্ন শিক্ষানীতি কি তাদের এ ক্ষমতার জোরকে নিবৃত্ত করতে পারবে?
সার্বিক বিবেচনায় আমাদেরও মনে হয় একটি নীতিমালা হওয়া দরকার, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এ বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাবী ও অধিকতর অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে সরকার সুপারিশ চাইতে পারে। উক্ত সুপারিশের আলোকে বর্তমানে প্রস্তাবিত অভিন্ন নীতিমালাটি সংশোধন করার মাধ্যমে সরকার সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশনা দিতে পারে এবং স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সিন্ডিকেটের অনুমোদন সাপেক্ষে এটি কার্যকর করতে পারে। কিন্তু যদি তা না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে এটি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়তশাসনের ওপর সেটি আঘাত হিসেবে বিবেচিত হবে। আমাদের বিশ্বাস, শিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার পিতা বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অক্ষুন্ন থাকে এমন পদক্ষেপই নেবেন।
লেখক
ড. মো. সৈয়দ এহসানুর রহমান
অধ্যাপক, পশুবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে গবেষক হিসেবে কিংদাও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চীনে কর্মরত
ইমেইল: [email protected]
এবং
ড. মো. এনামুল হক
অধ্যাপক, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৮০২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯
এইচএ/