ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

তবুও আগুন জ্বেলে রাখি… 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০২০
তবুও আগুন জ্বেলে রাখি… 

২০০৮ সালের পর যারা আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছেন কিংবা সক্রিয় হয়েছেন, তারা শুধু ক্ষমতায় থাকার সুবিধাগুলোই ভোগ করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলের রাজনীতি করা যে কতটা দুরূহ, এটি তারা অনুভব করতে পারবেন না। 

সুতরাং শুধু সরকারি দলের সহযোগী কিংবা ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা থেকে বিরোধী দলের হয়ে রাজনীতি করা কাউকে মূল্যায়ন করা যায় না।  

দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে যারা ১৯৯৬ সাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা শুরু করেছিলেন, তাদের শুরুটা মসৃণ হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়।

ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের মারধর করে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়া, পরীক্ষা দিতে না দেওয়া, স্থানীয়দের সহায়তায় চাঁদাবাজি করাসহ নানা রকমের অত্যাচার চলতে থাকে।

তারপরও কিছু তরুণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন। সরকার পরিবর্তন হলে এই অন্যায় অনিয়ম দূর হবে, এমন স্বপ্ন দেখছেন। অন্যদিকে যারা ১৯৯৬ সালের আগে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা মানুষগুলো কিসের আশায়, কিসের নেশায় রাজনীতি করেছিলেন? 

তখন তো ৫ বছর পরপর ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না! বিরোধী দলের রাজনীতি করার পরিণাম যেগুলো আজকে গল্প মনে হয়, সেই সময় সেটাই তো নিষ্ঠুর বাস্তবতা ছিল।  

যাদের নিজের মধ্যে এবং পরিবারের কারো মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আছে, কেবলমাত্র তারাই তখন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আসতেন। সুতরাং সেই বৈরী সময়ে ছাত্রলীগ করে আসা নেতাকর্মীদের প্রতি সাধারণ মানুষের সবসময় একটি অন্য রকম শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। তেমনই একজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন ডা. বশির আহমেদ (জয়)। বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে তিনি ডা. জয় নামেই পরিচিত।

ডা. বশির আহমেদ জয়ের জন্ম হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর, ১৯৭১ সালে। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ায় বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘জয়’। তার পিতা এম এ গনি একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মাতা বেগম দেলোওয়ারা গনি ছিলেন একজন গৃহিণী। ৫ ভাই এবং ৪ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম।  

তিনি ১৯৮৭ সালে মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি এবং ১৯৮৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর আগে তিনি ৫ম শ্রেণী এবং ৮ম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। স্কুল জীবনে তিনি একজন মেধাবী ছাত্র এবং চৌকস ফুটবলার ছিলেন।  

১৯৮৯ সালে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের (শেবাচিম) ২১তম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হওয়ার দিন থেকেই ডা. বশির আহমেদ জয় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। তবে এর পেছনে কাজ করেছিল পারিবারিক বিপর্যয়ের দুঃসহ স্মৃতি। ডা. বশির আহমেদ জয়ের বড় ভাই মোশাররফ হোসেন খোকন সেই সময় বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে ‘বাংলার খেয়া’ জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্তব্যরত অবস্থায় তিনি ১৯৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর আততায়ীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন।  

তার পরিবারের সদস্যরা বহুবার চেষ্টা করেও তার খুনের বিচার পাননি। জয়ের পিতা এবং অন্যান্য ভাইয়েরা পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার এই মেধাবী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হত্যার বিচার সম্পন্ন করতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।  

মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষেই জয় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেল থেকে ক্রীড়া সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। পরবর্তী দুটো ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তিনি ক্রীড়া সম্পাদক এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি ছাত্রাবস্থায় যুব রেড ক্রিসেন্টের সহ-সভাপতি এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  

’৯০ এর দশকের প্রথমভাগে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালায় ছাত্রদল ও শিবির। যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি বরিশালের আব্দুর রহমান বিশ্বাস এবং তার ছেলে ডা. নাছিম বিশ্বাস।  

ওই সময় ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র মৈত্রীও ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছিল। ক্যাম্পাসে অস্ত্র ও স্থানীয়দের সহায়তায় ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারের  চেষ্টা করলেও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সমর্থন সব সময়ই ছাত্রলীগের বেশি ছিল।

প্রধান বিরোধীদলের ছাত্র সংগঠন হওয়ার কারণে সেসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর সবচে বেশি নির্যাতন চালানো হয়েছিল। সভা-সমাবেশ করতে বাধা দেওয়া, মিছিলে অতর্কিত হামলা, হোস্টেল থেকে বহিষ্কার, হয়রানিমূলক মামলা ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। এসবের মধ্যে থেকেও যে হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রনেতা শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা. বশির আহমেদ জয়।

ডা. বশির আহমেদ জয় ছাত্রবস্থা থেকেই অসম সাহসী ছিলেন। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় একটি ঘটনা তার মুখ থেকেই শোনা যাক। তিনি বলেন, ‘মেডিক্যালে পড়ার সময় আমার সহপাঠী এবং ঘনিষ্ট বন্ধু আক্তার নেহালের বাসা ছিলো পুরান ঢাকার আগামসি লেনে। বরিশালের উদ্দেশে সদরঘাট যাওয়ার পথে আগামসি লেনে ওদের বাসা হয়ে যেতাম। একদিন জানলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি জাতীয় বেঈমান খন্দকার মুশতাকের বাসা নেহালদের বাসার খুব কাছেই। ’ 

‘জাতির জনককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকারীদের একজন ফাঁসির দড়িতে না ঝুলে উল্টো স্বাধীন বাংলাদেশে আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছে, এটি চিন্তা করলেই মাথায় আগুন ধরে যেত। ভাবতাম আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের এত নেতা, এত কর্মী, তারা কেন এই নোংরা লোকটাকে মারতে পারে না? ফ্রিডম পার্টির ছেলেরা প্রকাশ্যে গোলাগুলি করে, আওয়ামী লীগের সভায় বোমা মারে, আমাদের ছেলেরা কেন পারে না? একদিন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। নেহালের বাসা থেকে বেরিয়ে, হাতে একটি লাঠি নিয়ে একাই মুশতাকের বাড়ির গেটে হাজির হলাম। অন্ধের মতো বন্ধ গেটে লাঠি দিয়ে বাড়ি মারতে থাকলাম, গালি দিতে দিতে লাথি মারতে থাকলাম। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ এসে হাজির হলো। ’

ডা. বশির আহমেদ জয় বলেন, ‘‘এর মধ্যে নেহালও কয়েকজন স্থানীয় বন্ধু নিয়ে চলে এসেছে। নেহাল বলে উঠলো, ‘করছিস কি, বিএনপি ক্ষমতায়, এখন যদি মামলা খাস, কে বাঁচাবে? বরিশাল চল তাড়াতাড়ি। ’ আমার কানে অবশ্য ওর কথাগুলো ঠিকমত ঢুকছিল না। ও আমাকে টেনে ওদের বাসায় নিয়ে আসে। দেয়ালের ওপার থেকে শীর্ণ দেহের মোশতাক তার সাদা ভ্রুর কুঁচকে আমার দিকে যে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, সেই দৃশ্য আমি জীবনেও ভুলবো না। ’’ 

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে অনেকের মতো বশির আহমেদ জয়ের ওপর সরকারি দলের দমন পীড়ন শুরু হয়। এমবিবিএস পাস করে দীর্ঘদিন চাকরি জোটেনি, বরং পুরোনো মামলাগুলোকে আবার সচল করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি বাধ্য হয়ে ২০০৫ সালে সৌদি আরবের কিং আজিজ হাসপাতালে চাকরি নিয়ে দেশ ত্যাগ করেন।

কিন্তু রক্তে যার জাতির জনকের আদর্শ, সে কি আর দেশ ছেড়ে বেশিদিন দূরে থাকতে পারে? ২০০৮ সালে দলের সংকটময় অবস্থায় সৌদি আরবের উচ্চ মাইনের চাকরি আর বিলাসী জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। এসেই প্রাণের দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দেন।  

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ডা. বশির আহমেদ জয়ের মতো ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতার যেভাবে মূল্যায়ন হওয়া উচিত ছিল, বাস্তবে সেরকম হয়নি। তিনি ২০০৯ এবং ২০১২ সালের বিএমএ নির্বাচনে সেন্ট্রাল কাউন্সিলর পদে অংশ নিয়ে জয়ী হয়ে আসলেও পরবর্তীতে গ্রূপিং লবিংয়ের পঙ্কিল রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন।  

স্বাধীনচেতা মনোভাব আর চাটুকারিতায় অভ্যস্ত না হওয়ার কারণে অধিকাংশ চিকিৎসক নেতাদের কাছেই তিনি বিরাগভাজন ছিলেন। এক ধরনের চাপা অভিমান নিয়েই নীরব থেকেছেন। একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

পারিবারিক জীবনে ডা. বশির আহমেদ জয় বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক। উনার স্ত্রী ডা. শারমীনা সুলতানা ইউনিসেফের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার পদে যোগ দেন। ২০১৩ সালে তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে ডি-কার্ড ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের কন্সালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। পেশাগত ব্যস্ততার পাশাপাশি তিনি একজন অনলাইন এক্টিভিস্ট হিসেবে নিরলসভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন।  

বঙ্গবন্ধুর প্রতি আবেগ এবং শ্রদ্ধা থেকে কিছুদিন আগে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ পাঠচক্র নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গঠন করেছেন। গত কয়েক বছর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতা পদ হারিয়েছেন।  

এরকম অস্থির পরিস্থিতিতে বশির আহমেদ জয়ের মতো স্বচ্ছ ইমেজের ছাত্রলীগ নেতার খুব প্রয়োজন। কারণ দেশ গড়তে হলে নেতাকে শুধু দুনীতিমুক্ত হলেই চলবে না, তাকে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক বাহক হতে হবে। ডা. বশির আহমেদ জয়ের মতো মুজিব আদর্শের সৈনিকদের মূল্যায়ন করলে এগিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ।  

লেখক: মেডিকেল অফিসার, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকা।
সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র সংসদ, শেবাচিম, বরিশাল।  
সাবেক সহ-সভাপতি, শেবাচিম শাখা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৯
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।