ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দায় কি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০২০
দায় কি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের?

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিটা ‘হয়তো’ স্বাস্থ্য বিভাগ কিছুটা বাগে আনতে শুরু করেছিলো। কিন্তু আমাদের অদূরদর্শী আচরণ পুরো পরিস্থিতিতে মুড়িঘণ্টের ডালের মতো ঘুঁটে দিয়ে চলে গেলো। করোনা ভাইরাসটাকে নিজেরাই সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার এই মহাযজ্ঞ পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখে!

ভাবুন:

- স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলো। সবাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চলে গেলো কক্সবাজার, সাজেক।

- ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করা হলো। সব মানুষ এটাকে মনে করলো বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার ছুটি। নাড়ির টানে বাস-ট্রাক-লঞ্চ-ট্রেন ভরে সবাই বেরিয়ে পড়লো। যেন এক উৎসব!

- ছুটি শেষে আপনাদের দপ্তর প্রধানরা অফিস-কারখানা বন্ধ রাখবেন কী না তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না, আপনারাও হৈ হৈ রৈ রৈ করে আবার ফিরে এলেন শহরে। আবারো উৎসব!

- তাহলে লাভ কী হলো এই কয়দিন ঘরে থেকে? কার জন্য, কীসের জন্য ঘরে থাকলেন?!

- লাভ কী হলো, আমাদের এতো এতো উপদেশের?

- তাহলে এখন আর হটলাইনে ফোন দিলেই কী, আর না দিলেই বা কী?

এখন আর ডাক্তাররা-নার্সরা চিকিৎসা সেবা দিলেই কী, আর না দিলেই বা কী?

এখন আর প্রাইভেট চেম্বার খুলে রাখলেই কী, আর না রাখলেই বা কী?

এখন ১ জায়াগার বদলে দেশের ১০ জায়গায় টেস্ট করালেই কী, আর না করলেই বা কী?

প্রতিদিন নতুন কতো জন আক্রান্ত হলো, নতুন কতো জন মারা গেলো, এটাই বা শুনে লাভ কী?

- পুরো জাতির অপরিণামদর্শিতার দায় কি শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের? শুধু একটি মন্ত্রণালয়ের?

স্বাস্থ্য বিভাগের কথা বলাতে একটা জিনিস মনে পড়লো। আমি গ্রামে বড় হইনি। তবে গ্রামের ‘তেলের ঘানি’র গল্প শুনেছি। একটা গরু বা বলদ দিয়ে ঘানিতে তেল ভাঙানো/মাড়াই করা হয়। গরু বা বলদটার কাঁধে একটা ‘জোঁয়াল’ দিয়ে তাকে চক্রাকারে একই পথে হাঁটানো হয়। গরু থেমে গেলে তাকে চটাং করে আঘাত করা হয়। আরো মজার কথা (পড়ুন অমানবিক) হলো, গরু/বলদটা চোখে কালো কাপড়/গামছা বাঁধা থাকে। যাতে করে গরুটার মনোযোগ ঘাস বা নিজের বাছুরটার ক্ষুধার্ত মুখের দিকে বা অন্য কোনো দিকে চলে না যায়। এভাবেই গরুগুলো ঘুরে ঘুরে ভরিয়ে তোলে তেলের পাত্র।

রাজপথে যে জনস্রোতের ছবি গতকাল দেখলাম, এগুলো দেখে অন্তত আমরা শিঁউরে উঠেছি।

 

চিকিৎসক হবার পর থেকে কম মৃত্যু তো আর আমরা দেখিনি। মৃত বাবা-মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট লিখে তার সন্তানের হাতে তুলে দেওয়ার কাজটা আমাদের কতোখানি অপ্রিয়, শুধু আমরাই জানি। এই কাগজটার ভার কতোখানি, শুধু জানি আমরা আর ঐ স্বজন হারানো মানুষটি।

কাল যারা সারা দেশ চষে এদিক সেদিক ছুটলেন, আজ যারা ছুটছেন, তাদেরকে সরাসরি দোষ দিচ্ছি না। পেটের দায়েই হয়তো ঘরে থাকা হয়নি তাদের। তবে করোনার মৃত্যুমিছিলে কিন্তু দোষী-নির্দোষ কেউই বাদ পড়বে না।

এখনো হয়তো বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯- এর ভয়াবহতা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি, বা আমাদের অনুধাবন করতে দেওয়া হয়নি। যে রোগটা আমরা গায়েই মাখাচ্ছি না, মহাপরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯ হাজারের বেশি মানুষ এখন মৃত সেই রোগে! 

এখন নিজের লেখাগুলো নিজের কাছেই ‘অবান্তর’ মনে হয়।

ঘানির বলদের মতো শুধু চক্রাকারে শ্রম দিয়ে যেতে হবে এখন। চোখে কালো কাপড়। আর ‘বাছুর’ কিংবা ‘ঘাস’- কোনো কিছুর দিকেই তাকানোর আর কোনো সুযোগ নেই।

ভালো থাকুক আমাদের ‘অদেখা’ বাংলাদেশ। ভালো থাকুক ‘সকল’ কিছুর দায় বয়ে চলা অননুপ্রাণিত ‘স্বাস্থ্য বিভাগ’।

লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট। রেজিস্ট্রার (সার্জারি বিভাগ), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা,  এপ্রিল ০৬, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।