মানুষের প্রাণ বাঁচানোর বিষয়টিকেই সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তাই সংক্রমণ প্রতিরোধ যতটা সম্ভব নিশ্চিত করে তবেই কোনো ক্ষেত্রে বিধিনিয়ম শিথিল করা হবে।
সারা বিশ্বে সুনিশ্চিতভাবেই ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামন্দা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড বা আইএমএফ জানিয়েছে, ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে চলেছে এশিয়া। তদের মতে, গত ৬০ বছরে এই প্রথম এশিয়ার অর্থনীতিতে কোনও প্রবৃদ্ধি হবে না। ২০০৮ সালের মন্দার সময়েও এমন ঘটেনি। ইউরপিয়ান ইউনিয়ন ইতোমধ্যে ২০০ বিলিয়ন ইউরোর প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। জার্মানিসহ গোটা ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সেই আর্থিক মন্দার মুখে কড়াকড়ি শিথিল করার জন্য ব্যাপক চাপে আছে। তাই বাংলাদেশের কথা ভাবলে আতংক এসে ভর করে। বাংলাদেশে এখনি দরিদ্র জনগোষ্ঠী যে খাদ্য সংকটে পড়েছে, করোনা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবস্থায় তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভাবতে ভয় লাগে।
দুই.
বাংলাদেশে ২০.৫% জনগণ দরিদ্র এবং সে হিসাবে দেশে দরিদ্র জনগণের সংখ্যা হলো তিন কোটি চল্লিশ লাখ (২০১৯ সালের সরকারি দারিদ্র আয়সীমা অনুযায়ী)। আমরা যদি এই দারিদ্র আয়সীমা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করি (একইসাথে দারিদ্র এবং আর্থিক অসহায়ত্ব বিবেচনায় নিয়ে যারা ভঙ্গুর এবং দারিদ্র সীমার কাছে), তাতে দারিদ্র এবং আর্থিক অসহায়ত্বের শতকরা হার দাঁড়ায় ৪৫.৪%। অর্থাৎ, দেশে দরিদ্র এবং আর্থিক অসহায় জনগণের সংখ্যা এখন প্রায় ৭ কোটির কাছাকাছি। এর মধ্যে দেশের চরম দারিদ্র সীমার নীচের বা হতদরিদ্র জনগণের হার ১০.৫%। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) -এর মতে করোনা ভাইরাসের কারণে গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ৪০-৪২ লাখ মানুষ আবার গরিব হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশই দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
এগুলো বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, দেশের ন্যূনতম ১.৯ কোটি পরিবারের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং নিম্নআয়ের মানুষেরা বিশ্ব মহামারী কোভিড-১৯ -এর সর্বোচ্চ হুমকির মুখে রয়েছে। দিন মজুর এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনা ভাইরাসজনিত বর্তমান সংকটের সময়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই বিশাল দরিদ্র এবং আর্থিকভাবে অসহায় জনগণের কর্মহীনতা এবং আয়হীনতার পরিপ্রেক্ষিতে এই জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (যেমন সিপিডি, সানেম, জিইডি, বিআইজিডি ) আর্থিক ঝুঁকির বিশ্লেষণ করছে।
তিন.
করোনা ভাইরাসজনিত সংকট এবং আর্থিক সংকটের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে একটি আশাব্যাঞ্জক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যেটি আমাদের জিডিপির তিন শতাংশেরও বেশি যা সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়তে পারে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) দেশের ১.৯ কোটি পরিবারের জন্য তার মধ্যে থেকে ৩০,০০০ কোটি টাকা নগদ সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব করেছে যা জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ। এর আওতায় দেশের চলতি মূল্যের হিসাবে নিম্ন দরিদ্রসীমায় বসবাসকারী প্রতিটি চার সদস্যের পরিবারকে প্রতিমাসে ৮০০০ টাকা করে দুই মাস সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রণোদনা প্যাকেজ এবং নগদ সহায়তা প্রদানের প্রস্তাবের এই বিপুল পরিমান অর্থের (জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ যা প্রায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকার সমান) সংকুলান করা। বাস্তবতার নিরিখে কিছু উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক. কৃচ্ছতা সাধন: সরকারের যে বিভিন্ন কম গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব ব্যয় আছে, বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেটে যে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো আছে সেগুলোকে স্থগিত বা বাতিল করে অর্থের সাশ্রয় করা যেতে পারে।
খ. উন্নয়ন সহযোগীদের অনুদানে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে সেগুলো হতে যাচাই বাছাই করে তাদের সম্মতিক্রমে কিছু অর্থ এই ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা যেতে পারে।
গ. আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন- বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক, এশিয়ান অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক ইত্যাদির কাছ থেকে সম্ভব হলে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধার জন্য সমঝোতা করার চেষ্টা করা। বাজেট সাপোর্ট পাওয়া সবচেয়ে ভালো হবে।
ঘ. সরকারকে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিতে হবে। সংকট থাকলেও সরকারকে ব্যাংক থেকে টাকা নিতেই হবে, তবে তা সতর্কতার সাথে করতে হবে।
ঙ. হয়তো নতুন টাকা ছাপাতে হবে (একদম উপায় না থাকলে)। এই উভয় ক্ষেত্রেই মূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
চ. ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান গ্রহণের যে উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে তা আরও বিস্তৃত করে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যেতে পারে। তাদেরকে উৎসাহিত করতে তাদের সম্মতিক্রমে বিশেষ দাতা কার্ড প্রদান করা যেতে পারে।
ছ. কিছু বিলাসী দ্রব্য বা সেবার ওপর বিশেষ ভ্যাট/কর আরোপ করা যেতে পারে। যেমন- প্রতিমাসে ১০০০ টাকার বেশি মোবাইল বিলের ওপর কিছুটা অধিক হারে ভ্যাট/কর আরোপ করা যেতে পারে।
জ. এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মাধ্যমে অনুদানে যেসব কাজ হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগ এই উদ্দেশে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, প্রণোদনা প্যাকেজের বিপুল পরিমান অর্থের সঠিক ব্যবহার এবং নগদ সহায়তা বিতরণের সুব্যবস্থা করা।
প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থের সঠিক ব্যবহার জটিল বিষয় এবং স্বল্প পরিসরে এখানে আলোচনা করা হলো না। নগদ সহায়তা বিতরণের বিষয়টি আলোচনা করাটা আমাদের জন্য কিছুটা সম্ভব।
চার.
নগদ টাকা হস্তান্তর করাই সবচেয়ে স্বচ্ছ ও কার্যকর ব্যবস্থা বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের উদ্যোগে দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের তালিকা প্রস্তুতের যে কর্মসূচি চলছে, তা প্রশংসনীয়। তবে এক্ষেত্রে তালিকা তৈরি ও হালনাগাদ করতে অবশ্যই প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। সরকারের কাছে ইতোমধ্যে সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের জন্য তালিকা রয়েছে যা ইউএনডিপিসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগিদের সহায়তায় ডাটাবেইজ হিসাবে আছে। সেটি অতি দ্রুত হালনাগাদ করে (বাদ পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠি এবং আর্থিকভাবে অসহায় জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করে) প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি ব্যবহার করে সরাসরি সুবিধাভোগীর কাছে অর্থ পৌছানো নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে সরকার অপচয় হ্রাস ও সঠিক সুবিধাভোগী নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব রোধ নিশ্চিত করে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে।
সিপিডির প্রস্তাবটি এক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য: ‘প্রস্তাবিত অর্থ সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সুবিধাভোগীদের নিবন্ধনের জন্য একটি আবেদন ব্যবস্থা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে হটলাইন নম্বরের ব্যবস্থা থাকলে তাতে আবেদনকারীদের সুবিধা হবে। স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃপক্ষ, সরকার প্রতিনিধি, পুলিশসহ এনজিও উন্নয়ন কর্মীদের সংশ্লিষ্ট করে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মনোনয়ন অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে প্রস্তুতকৃত তালিকাটি সরকারি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে, যা অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচির মাধ্যমে সঞ্চালিত হতে পারে। ’
খাদ্য এটিএম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র: দুস্থঃদের মাঝে খাদ্য কার্ড বিতরণ করে খাদ্য এটিএম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা প্রদানের পদ্ধতি ভিয়েতনামে খুবই সফল হয়েছে। এটি বাংলাদেশে সহজেই চালু করা যেতে পারে স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে।
পাঁচ.
আমাদের আমলাতন্ত্রের দক্ষতা, সরকারি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা নিয়ে নানা ধরণের সমালোচনা থাকলেও এর মাধ্যমেই এই বিতরণ ব্যবস্থা করতে হবে। এর অংশ হিসেবে আমি বলতে পারি, সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিলে এই আমলাতন্ত্রই এই কাজ সূচারুভাবে করতে পারবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে চেষ্টা করছেন। নিশ্চিত করতে হবে যে এই বিতরণ প্রক্রিয়ায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যেন সত্যিকার অর্থে সাহায্য পায়। এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে, বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলো এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য খাদ্য ও অর্থ যোগান দেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে তৃতীয়পক্ষীয় বা সামাজিক পরিবীক্ষণ যোগ করা যেতে পারে।
যদি আমরা এই কাজ ঠিকভাবে করতে না পারি, দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?
(নোট: ১. বাংলাদেশে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যয় পদ্ধতি দিয়ে দারিদ্র্য মাপা হয়। এ দেশের একজন নাগরিক দৈনিক ২ হাজার ১২২ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করতে প্রয়োজনীয় আয় করতে না পারলে তাকে গরিব হিসেবে ধরা হয়। আর দৈনিক ১ হাজার ৮০৫ ক্যালরি খাবার গ্রহণের মতো আয় না থাকলে হতদরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। জিইডির হিসাবমতে, চারজনের একটি পরিবারের আয় যদি মাসে ৬ হাজার ৪০০ টাকা হয়, তাহলে ওই পরিবারের সবার জন্য দৈনিক কমপক্ষে ২ হাজার ১২২ ক্যালরি খাবার কেনা সম্ভব হবে। আর আয় যদি ৫ হাজারর ২০০ টাকা হয়, তাহলে তারা ১ হাজার ৮০৫ ক্যালরি খাবার কিনতে পারবে।
২. বিশ্বব্যাংক ব্যক্তিগত আয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্য পরিমাপ করে। দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম আয় করলে ওই ব্যক্তিকে গরিব হিসেবে ধরা হয়। )
লেখক: জার্মানির ডর্টমুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় ডক্টরেট। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের উপ-প্রধান; বর্তমানে বাংলাদেশস্থ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে লিয়েনে কর্মরত।