এখন পৃথিবীর মানুষের অন্যান্য পোষাকের মতো নিত্যসঙ্গী হয়ে গেছে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, চশমা, টুপি আর পিপিই। অর্থাৎ নিজের শরীরকে যত প্রকারের আবরণ দিয়ে বাইরের সংস্পর্শ থেকে পৃথক রাখা যায়- তারই চেষ্টা।
এখনও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না যে, এই কোভিড-১৯ মানুষ তৈরি করেছে- নাকি প্রাকৃতিক। এ নিয়ে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক তর্ক-বিতর্ক গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এই মহামারি নিরাময়ের জন্য প্রতিষেধক তৈরিতে সাধ্য সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টায় উন্নত দেশগুলো বসে নেই। মানুষ যেখানে সারাদিন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে সময় ব্যয় করতো আজ অনেকেই অতি জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না। শুধুমাত্র অতি প্রয়োজনীয় সংস্থাসমূহ সেবা, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তার জন্য কঠোর মনোবল নিয়ে বাইরে আছে।
ঘরে নির্দিষ্ট কাজের পর মানুষের মনে নানান চিন্তার উদ্রেক ঘটে। এ সময়ে নেগেটিভ ভাবনা আমাদেরকে বেশি কাবু করে ফেলে। মনের গভীর ভাবনার ছাপ শরীরের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতা অনুভব হয়। তাই মনকে সতেজ ও সুস্থ রাখার জন্য ছবি এঁকে কিছুটা স্বস্তি ও শান্তি দেওয়া যেতে পারে।
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় দেশের শিশু-কিশোররা একেবারে ঘরবন্দি হয়ে আছে। তারা সামাজিক দূরত্বের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়া অন্য কোনভাবে নিজেদের বিনোদনের জন্য সময় কাটাতে পারছে না। অনেক সময় নিজেকে ভাবছে নিঃসঙ্গ। এ ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ছবি আঁকা যেতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, অনেকেরই আঁকিবুকির কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তাহলে কি হবে? না- এখন যে ছবি আঁকা হবে তা একান্তই নিজের অভিব্যক্তির প্রকাশ মাত্র। কালি, কলম, পেন্সিল, পেস্ট্যাল, বিভিন্ন রং ইত্যাদি দিয়ে আপনি আপনার সামনের কাগজটিতে কিছু এঁকে নিজেকে, নিজের অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে দেখতে পারেন। এবং এই চিত্রকর্ম অন্যজনের সাথে শেয়ার করুন। দেখবেন আপনি আনন্দ পাচ্ছেন এবং যারা এই ছবি দেখবেন তারাও আনন্দিত হবেন।
এবার কিছু ছবি আঁকার বিষয় উল্লেখ করছি, যাতে আপনার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাবে, আপনি প্রশান্তি পাবেন সর্বোপরি আনন্দ প্রকাশ করতে পারবেন।
ইমোশন: মনের ওপর অতিরিক্ত চাপের কারণে চলমান যে কোনও ঘটনায় আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। সাধারণত রাগ বা দুঃখজনিত কারণে তা ঘটে।
ইমোশনাল হুইল: বিভিন্ন রং ব্যবহার করে পট বা আপনার নির্দিষ্ট পরিসর ভরাট করা।
মেডিটেটিভ পেইনটিং: সৃষ্টিশীল কাজ করা। এ ক্ষেত্রে পূর্বের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই।
লাইন এর ব্যবহার: আপনি লাইন এঁকে ছবি আঁকতে পারেন। নির্দিষ্ট বিষয় ফুটিয়ে তুলতে পারেন বা বিষয়ের কাছাকাছি কিছু আঁকতে পারেন।
পাহাড় বা উপত্যকা: আপনি পাহাড়ে নিশ্চই বেড়াতে গিয়েছিলেন। এখন আপনি মনে মনে সেই পাহাড়ের ছবিটি নিজের মনের মতো করে আঁকুন। এতে ভালো লাগার বিষয়টি তৈরি হবে।
আপনি বেলুন বা যে কোনও ত্রিমাত্রিক ফর্ম যেমন- ছোট কোনও পণ্যের প্যাকেটের গায়ে, পরিত্যক্ত কাপড় ইত্যাদিতে একা বা দলবদ্ধভাবে পরিবারের সবাই রং লাগিয়ে রেখা এঁকে দেখতে পারেন। এভাবে আপনার সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ করতে পারলে মনের ইমোশন পর্যায়ক্রমে কমে যাবে।
রিলাক্সেশন: প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে আমাদের মানসিক চাপ সহ্য করতে হয় অনেক বেশি। তাই এই বৃত্ত থেকে বের হওয়া অতি জরুরী। আপনার প্রিয় গান বা যে কোনও গান শুনে অনুভব করে তার ছবি আঁকা যেতে পারে এই সময়ে।
ফিঙ্গার পেইন্ট: আপনার হাতের আঙ্গুলের মধ্যে রং লাগিয়ে কাগজে বা কাপড়ের ওপর সেই রং লাগান। যে কেউ এই চেষ্টা করতে পারেন।
বিশেষ চিহ্ন আঁকা: জ্যামিতিক এই নকশাগুলো আঁকার মাধ্যমে আপনার ধৈর্য্য পরীক্ষা এবং আনন্দ অনুভব করতে পারবেন। বর্ণ বা শব্দ, বাক্যকে সুন্দরভাবে লিখা শিল্পভাষায় আখ্যায়িত যে শিল্প, তার নাম ক্যালিওগ্রাফি। বাংলা প্রতিশব্দ সুন্দর লেখা। এই ক্যালিওগ্রাফিও হাতে বা কম্পিউটারের মাধ্যমে সৃষ্টির চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
ক্লোজআপ : চোখের ক্লোজআপ অর্থাৎ বাস্তব আকারের চেয়ে বড় করে চোখের ছবি পেন, পেন্সিল, রং দিয়ে আঁকতে পারেন।
নিজেকে মুক্ত রাখা: এক্ষেত্রে কোনও বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে আপনি ছবি আঁকুন এবং কেমন হলো তাও বিচার না করা।
কোলাজ: যে কোনও কাগজ কেটে ডিজাইন করা যায়। কাগজ কেটে আঠা দিয়ে আটকিয়ে একটি পরিসর ভরাট করে দেখতে পারেন।
প্রকৃতির দৃশ্য: প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যগুলোতে মনের বিচরণ অত্যন্ত আনন্দের হয়। এই প্রকৃতিতে কোনও একটি ছোট বিষয় থাকলে, তা আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে রং-তুলিতে। যেমন-পাখি, ফুল ইত্যাদি।
আনন্দ: ছবি মানে শুধু দুঃখ আর বেদনা নয়, আনন্দকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় এখানে। আপনার বিশেষ কোনও আনন্দের দিনের ছবি আঁকতে পারেন। কিংবা একেবারে কোনও বিষয় চিন্তা না করে আপনি এঁকে দেখুন আপনার মন কি বলে! এক্ষেত্রে যে কোনও মাধ্যমে ছবি আঁকা যায়।
আপনি কি বিশেষ কোনও মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, প্যাগোডায় গিয়েছেন? তাহলে ঐ স্থানটির পরিবেশ বা স্থাপত্য কাঠামো আঁকতে পারেন। চলমান মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে কোনও ছবি আঁকতে পারেন। আমাদের জাতীয় পতাকা, স্মৃতিসৌধ, পতাকা হাতে মুক্তিযোদ্ধা, মহান স্বাধীনতার আনন্দ, বিজয় দিবসের আনন্দের ছবি আঁকা যায়। কিংবা আঁকতে পারেন করোনাযোদ্ধাদের ছবিও।
আপনার মনের ছবি: আমাদের মনের ভিতর কি আছে সেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। বিচিত্র এই মন বিচিত্র অনেক কিছুই ভালোবাসে। যাকে গাণিতিক হিসেবে মিলানো যাবে না। তাই মনের ভিতরের রূপটা দেখে নিতে পারি। যেমন- কিছু রং পানি দিয়ে মিশিয়ে কাগজের ওপর ঢেলে দিয়ে কাগজটাকে ভাঁজ করে হালকা চাপ দিয়ে নিলেই সুন্দর একটা রূপ তৈরি হবে। একটা ফুল বা পাখি, পশু বা নিজের প্রতিকৃতি আঁকুন যেটার সঙ্গে আসলে বাস্তবতার মিল নেই। আপনার স্বপ্নকে আঁকুন যেখানে আপনার মনের ভিতরের প্রতিফলন ঘটবে। এজন্যই আমেরিকান দার্শনিক সুসানে ক্যাথেরিনা লেঙ্গার (Susanne langer) বলেছিলেন, Art is the creation of forms symbolic of human felling.
অতীতের বেদনাময় স্মৃতি বা ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন দেখে আমাদের মন ভারাক্রান্ত হয় বেশি। তাই কিছু ছবি এঁকে বর্তমান সময়ে নিজেকে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করতে হবে। এতে মনের ওপর চাপ কমবে, শান্তি ও আনন্দ উপভোগ করা যাবে নিজের মধ্যে বা সবার সঙ্গে।
লেখক: পরিচালক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।