দেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে।
এমনকি মহামারি করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) ধূমপায়ীরাই বেশি আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুবরণ করছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।
তবে এভাবেই কি তামাকের ভয়াল ছোবলে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আক্রান্ত হতেই থাকবে? ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লালিত সেই স্বপ্ন কি বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে না? বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই হবে।
আর এজন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে তামাক নিয়ন্ত্রণে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। অবলম্বন করতে হবে নানা কৌশল। আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। প্রতিকূল অবস্থার কারণে অন্যান্য বছরের মত ওইভাবে দিবসটি হয়তো পালন হচ্ছে না। তারপরও দিবসটি পালনে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘তামাক কোম্পানির কূটকচাল রুখে দাও, তামাক ও নিকোটিন থেকে তরুণদের বাঁচাও’। তাই এবারের তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আসন্ন ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে উচ্চহারে তামাকের করারোপ অত্যন্ত জরুরি।
কেননা গবেষণায় দেখা গেছে, যদি উচ্চহারে করারোপের ফলে তামাকের প্রকৃত মূল্য ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয় তাহলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। আর করোনার এই ভয়াবহ সময়ে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই ভাবতে হবে। কেননা, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ অনেক বেশি।
তাহলে নারীর চেয়ে পুরুষ করোনায় বেশি আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ কি ধূমপান? কিংবা তরুণ প্রজন্ম করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণও কি একই? এমন প্রশ্ন এখন মানুষের মনে উঁকি দিচ্ছে।
তামাকের ব্যবহার হ্রাস করতে এবারের (২০২০-২১) বাজেটে তামাকপণ্যের কর বৃদ্ধি করতে হবে। এতে তরুণ-যুবকরা তামাকের এই ভয়াল ছোবল থেকে সুরক্ষার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সেইসঙ্গে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের কাজও অনেকখানি এগিয়ে যাবে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ‘এফসিটিসি’ অর্থাৎ ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’ নামের চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে কিন্তু বাংলাদেশ ‘এফসিটিসি’র প্রতিপালনে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো- বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোই সুবিধা আদায় করছে।
ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণ কিংবা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। এজন্য বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন ও সহায়ক নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। একটি বিষয় কর্তৃপক্ষকে অনুধাবন করা উচিৎ- ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
একই সময়ে তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয় ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের চেয়ে তামাক ব্যবহারে অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। সেই সঙ্গে তামাকজনিত রোগে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। তামাকজনিত কারণে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় কয়েক লাখ মানুষ। তাই করোনার ভয়াবহতা রুখে দেওয়াসহ অকাল মৃত্যুর মিছিল বন্ধ এবং তামাকখাতে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি লাঘবে অবশ্যই তামাকজাত পণ্যের কৌশলী নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
তামাকের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী পরিচালনা, তামাকের উৎপাদন হ্রাসসহ কৌশলে ধূমপায়ীদের ধূমপানের প্রতি নিরুৎসাহিত করতে হবে। আর ধূমপায়ীদের ধূমপানের প্রতি নিরুৎসাহিত বা তামাকের ব্যবহার কমানোর কার্যকর উপায় হলো সিগারেটের প্রকৃত মূল বৃদ্ধি করা। তাই বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত একটি দেশ গড়ে তুলতে চাইলে আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে তামাকপণ্যের ওপর উচ্চহারের কর আরোপ করা অত্যন্ত জরুরি।
আর এই উচ্চহারে করারোপের বিষয়ে কিছু প্রস্তাব ও সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যে প্রস্তাবগুলো হলো-
১. সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪টি থেকে কমিয়ে ২টিতে (নিম্ন এবং উচ্চ) নিয়ে আসা।
২. বিড়ির ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার মূল্য বিভাজন তুলে দেওয়া।
আর সুপারিশগুলো হলো-
১. সকল তামাকপণ্যের ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস করতে মূল্যস্ফীতি এবং আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি করা।
২. বিভিন্ন তামাকপণ্য ও ব্রান্ডের মধ্যে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য ব্যবধান কমিয়ে আনার মাধ্যমে তামাক ব্যবহারকারীর ব্রান্ড ও তামাকপণ্য পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত করা।
৩. করারোপ প্রক্রিয়া সহজ করতে তামাকপণ্যের মধ্যে বিদ্যমান বিভাজন (ফিল্টার/নন ফিল্টার বিড়ি, সিগারেটের মূল্যস্তর, জর্দা ও গুলের আলাদা ট্যারিফ ভ্যালু প্রভৃতি) তুলে দেওয়া।
৪. সকল ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য উৎপাদনকারীকে করজালের আওতায় নিয়ে আসা।
৫. পর্যায়ক্রমে সকল তামাকপণ্য অভিন্ন পরিমাণে (শলাকা সংখ্যা এবং ওজন) প্যাকেট/কৌটায় বাজারজাত করা।
৬. একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (৫ বছর মেয়াদি) করা, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাস এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
৭. সকল প্রকার ই-সিগারেট এবং হিটেড (আইকিউওএস) তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা।
৮. কঠোর লাইসেন্সিং এবং ট্রেসিং ব্যবস্থাসহ তামাক কর প্রশাসন শক্তিশালী করা, কর ফাঁকির জন্য শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যবস্থা করা।
আর এই কর প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী (১ দশমিক ৩ মিলিয়ন সিগারেট ধূমপায়ী এবং ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন বিড়ি ধূমপায়ী) ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবেন। সিগারেটের ব্যবহার ১৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে প্রায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বিড়ির ব্যবহার ৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হবে।
দীর্ঘমেয়াদে ১ মিলিয়ন বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যুরোধ সম্ভব হবে এবং ৬ হাজার ৬৮০ কোটি থেকে ১১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে (জিডিপির ০ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে।
আসন্ন বাজেটে এই প্রস্তাবনা ও সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এবারের তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টি সার্থক হবে বলে আশা রাখি। ফলে অদূর ভবিষ্যতে ধূমপানমুক্ত, সুস্থ ও স্বাস্থ্যসম্মত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথটি সুগম হবে বলে প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ: ১৩২৭ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২০
এসএস/জেআইএম