ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

করোনা ভাইরাস: একটি নতুন আপদ নাকি বিশ্ব রাজনীতির ভবিষ্যৎ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪২ ঘণ্টা, জুন ২, ২০২০
করোনা ভাইরাস: একটি নতুন আপদ নাকি বিশ্ব রাজনীতির ভবিষ্যৎ

বিগত কয়েক মাসের নাটকীয় ঘটনা প্রবাহকে পিছে ফেলে করোনা ভাইরাসজনিত বিশ্বজনীন মহামারি চলতি লিপ ইয়ারের প্রধান ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটি দেশের নিজ নিজ জনপ্রশাসন এবং সেসব দেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের জন্য অর্থনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থায় বৃহত্তম চাপও তৈরি করেছে। এই পরীক্ষাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে আরো অনেক বাকি রয়েছে। কারণ, এই মহামারির চূড়ান্ত রূপ দেখা এখনও অনেক দূরে এবং কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পরবর্তী ফলাফল অনুমান করা এখনও দূরের ব্যাপার। তবুও কিছু প্রাথমিক হিসাব-নিকাশ এখনই করা যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য যে, সেসব হিসাব অত্যন্ত হতাশাজনক। 

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ এই মহামারির অর্থনৈতিক ও আর্থিক দিকেই আলোকপাত করে। কিভাবে করোনা ভাইরাস বিশ্ব বাণিজ্য এবং বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে? আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কী ঘটবে? বৈশ্বিক আর্থিক বাজারগুলো কিভাবে আচরণ করবে? ভৌগোলিক এবং সীমানা প্রাচীর অতিক্রম করে যে অভিবাসন চলমান তাতে কিভাবে পরিবর্তন আসবে? 

এসব প্রশ্নগুলো সন্দেহাতীতভাবে মৌলিক প্রশ্ন এবং এগুলো ‘তাদের’ মানে সরকার, প্রধান প্রধান বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ বা আর্থিক সংস্থাগুলোর জন্যই নয় বরং ‘আমাদের’ মানে সারা বিশ্বের সকল প্রান্তের সাধারণ মানুষের জন্যও মৌলিক প্রশ্ন।

এটি আজ স্পষ্ট যে, অসংখ্য মানুষের জীবন বিভাজিত হয়ে যাবে ‘আগে’ এবং ‘পরে’ এই দুই ভাগে কাউকে কাউকে হয়তো তাদের ভ্রমণের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, কেউ কেউ আর উত্থানে সক্ষম হবে না এবং কাউকে কাউকে হয়তো পুরনো পেশায় ফিরে যেতে হবে অথবা পতনের ঝুঁকি দ্বারা তাড়িত হতে হবে।

তবুও রাজনৈতিক অথবা রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক পরিণতির কথা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। সেগুলো উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণও নয়, না ‘আমাদের’ না ‘তাদের’ জন্য। আজকের বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রবণতা ও আবেগের সূচকসমূহ ততটা ভীতিকর যতটা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবণতাসমূহ। করোনা ভাইরাস মানব জাতির উপর যে পরীক্ষা নিয়েছে তার প্রাথমিক ফলাফল মানুষের রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ ক্ষমতার বা আপনি যদি পছন্দ করেন তাহলে তা যে কোনো জীব প্রজাতির নিজের বংশগতিকে রক্ষা করার সহজাত প্রেরণার অনুপস্থিতির স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরছে।  

একের জন্য সবাই নাকি প্রত্যেকেই সকলের জন্য? 
২০২০-২০২৫ বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার প্রতি চ্যালেঞ্জ এথেনীয় বা তথাকথিত থুসিডিডিয়ান প্লেগ (খ্রীপূ ৪৩০) থেকে শুরু করে ইবোলা মহামারি (২০১৪-২০১৫) পর্যন্ত সকল মহামারিই কোন না কোনভাবে শেষ হয়েছে। দ্রুত হোক আর দেরি করেই হোক চলমান করোনা ভাইরাসজনিত বিশ্বজনীন মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে। যাহোক, বিভিন্ন মহামারি বৈশ্বিক ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। এদের কোনো কোনটাকে তুলনা করা যায়, যাকে কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা ‘আপদ’ (Bug) বলে আখ্যায়িত করেন তাদের সাথে। এমনসব ‘আপদ’ যেগুলো অনিচ্ছাকৃত এবং এরা কম্পিউটার প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ও অপ্রত্যাশিত ফলাফলের জন্ম দেয়। অপরাপর আপদসমূহ এমন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত চরিত্র ধারণ করে যে, তারা হয়ে ওঠে গাঠনিক বৈশিষ্ট্য, প্রয়োজনীয় দিক. বিশেষত্বসূচক বৈশিষ্ট্য এবং এমনকি প্রোগ্রামের ‘বাড়তি কর্মক্ষমতা’র পরিচায়ক।  

প্রথম দৃশ্যপটটি এমন হবে যে, যদি পুরো মানবজাতি বা একক জনগোষ্ঠী যেটি এই মহামারি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং এর দ্বারা সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি থেকে এবং ভবিষ্যতে এর প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। দ্বিতীয় দৃশ্যপটটি অনিবার্য হবে যদি সঠিক সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করা না যায়। এই মহামারি থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা বিস্মৃত হয় এবং এই মহামারি প্রচলিত রাজনৈতিক অগ্রাধিকারসমূহ, ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, মনস্তাত্ত্বিক আচরণ এবং পুরোনো জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনে। আপদটিকে (Bug) বিবেচনা করা হয় একটি সমস্যা হিসেবে, এমন একটি বৈশিষ্ট্য যাকে দেখা হয় অনিবার্য হিসেবে। আপনি একটি আপদ (Bug) স্থির করবেন কিন্তু আপনি একই বৈশিষ্ট্যের ভেতরে বসবাস করবেন। চলুন, চলমান করোনা ভাইরাসজনিত মহামারির সুনির্দিষ্ট বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখি।  

যুক্তি বলে যে, জনসংখ্যা সমাবেশ ঘটবে একটি স্বাভাবিক ঝুঁকির বিরুদ্ধে বিশেষ করে যখন এটি ঘটে মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে যেটি বিবর্তনের সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করছে। মানুষ, আমরা জানি, একটি সামাজিক জীব। অন্তর্গত ভুল বুঝাবুঝি এবং দলগত দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে - অন্তত কিছু সময়ের জন্য - একটি সত্যিকারের বৈশ্বিক সমস্যার একটি সমাধান খুঁজে বের করতে মানবজাতির আলোকপাত করা উচিত।  

আর এখন যখন মানবতা একটি বৈশ্বিক মহামারি অতিক্রম করছে, আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? রাজনীতিবিদরা আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতে নিজ নিজ অবস্থান পরিবর্তন করার ব্যাপারে লক্ষণীয়ভাবে গররাজী। করোনা ভাইরাসের এই বিস্তার না পেরেছে সিরিয়া পরিস্থিতির ইদানিংকালের তীব্রতা ঠেকাতে, না পেরেছে লিবিয়ার যুদ্ধবিরতি চুক্তির ভাঙন ধরাতে। ইরান এই মহামারির একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হওয়া সত্বেও ওয়াশিংটন তেহরানের প্রতি তার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রতিকীভাবে শিথিল করতে মোটেও তাড়িত হয়নি। এমনকি এই মহামারি ওপেক+ চলাকালে রাশিয়া এবং সৌদি আরবের মধ্যকার পারস্পরিক সমঝোতায় সামান্য ছাড়ের অনুমোদনও করতে পারেনি, যা তেলের মূল্যের পতন এবং বৈশ্বিক অর্থ বাজারের অনুবর্তী আতংককে ঠেকাতে পারতো। এই সকল বিষয়ে এবং অন্য আরো অনেক বিষয়ে মানবগোষ্ঠী আত্মসংরক্ষণের বৈশ্বিক স্বার্থকে পিছে ঠেলে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অপরাপর গোষ্ঠী স্বার্থের সুযোগ সুবিধার জন্যে।  

উপরন্তু, এই মহামারিটাকেও গ্রহণ করা হচ্ছে ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সচিব উইলবার লুইস রস আশাবাদী ছিলেন যে, করোনা ভাইরাসজনিত মহামারি ‘উত্তর আমেরিকার কাজের ক্ষেত্রকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করবে। ’ একদল পশ্চিমা অর্থনীতিবিদ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঘোষণা করে দেন যে, এই মহামারি হয়তো বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে ‘চীনা যুগ’-এর অবসান ঘটাবে এবং বেইজিং-এর অর্থ এবং বেইজিং-এর অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে মার্কিনীদের চূড়ান্ত বিজয় বয়ে আনবে। অবশ্যই চীন যে প্রথম করোনা ভাইরাসের শিকারে পরিণত হয়েছিল এই সত্যটিকে তুলে ধরা হয় একটি মহামারি ঠেকাতে একটি কর্তৃত্বশীল ব্যবস্থা কতটা অনুপযোগী তা বলার বা চীনা কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপ কতটা অপ্রতুল, চীনে মানবাধিকার পরিস্থিতি পুনর্ব্যক্ত করা এবং এরকম আরো অনেক বিষয় উপস্থাপন করার চমৎকার সুযোগ হিসেবে।

বিগত কয়েক সপ্তাহে মার্কিন কর্মকর্তারা দোষী হিসেবে ‘চাইনিজ’ (উহান) ভাইরাসকে উল্লেখ করার সুযোগ একবারও হাতছাড়া করেনি। অপরদিকে চীনা কর্মকর্তারা সন্দেহ ব্যক্ত করেছে যে, ভাইরাসটি গত অক্টোবর মাসে উক্ত শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সামরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী মার্কিন সেনারাই বহন করে এনেছিল।  

সব কিছুর উপরে এই মহামারি শুরুর চার মাস পরে আমাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বিশ্ব এখনও প্রতিদিনই ক্ষণস্থায়ী বিরোধ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আত্মগর্ব, কৌশলগত অর্জন এবং ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ঝগড়া ফ্যাসাদ করে যাচ্ছে। অন্যভাবে বললে, এই মহামারীটি একটি বৈশ্বিক ‘আপদ’ হিসেবে ততটা উপলব্ধ হয়নি, যেটিকে যেকোন মূল্যে ঠেকাতে হবে। কিন্তু এটিকে গ্রহণ করা হয়েছে বিশ্ব রাজনীতির নতুন এক বৈশিষ্ট্য হিসেবে যাকে নিজ নিজ স্বার্থ এগিয়ে নেওয়া এবং প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করা যাবে। প্রুশিয়ার রাজা প্রথম ফ্রেডরিক উইলিয়ামের বিখ্যাত উক্তিকে ভাষান্তরিত করে বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রপ্রধানরা বেশ ভালোভাবেই বলেন, ‘একটি মহামারি নিতান্তই মহামারি কিন্তু যুদ্ধকে সময়সূচি অনুপাতে থাকতেই হবে। ’ 

যাহোক, আমাদের কি পুরো বিষয়টির জন্য বিবেকবর্জিত রাজনীতিবিদ, অতিলোভী প্রতিরক্ষা কর্পোরেশন এবং দায়িত্বহীন অর্থ জালিয়াতদের দোষারোপ করা উচিত হবে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি এই মতের সাথে একমত পোষণ করি না। চলমান মহামারি অহরহ মানব চরিত্রের অশোভন দিকগুলোকেই তুলে ধরে, শুধুমাত্র বিমূর্তভাবে ‘তাদের’-ই নয়, খুবই সুনির্দিষ্টভাবে ‘আমাদের’-ও। এসব রাজনীতিবিদ, কর্পোরেশনসমূহ এবং ব্যাংকগুলো দায়িত্বহীন, বিবেকবর্জিত এবং অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে, যেমনটি বিদ্যমান সামাজিক চাহিদা দ্বারা অনুমোদিত।

‘আজ তুমি মারা গেলে, কাল মরবো আমি’
মানুষের সচেতনতার (অথবা বরং অবচেতন অবস্থা) জন্য নেতিবাচক দৃশ্যপটকে প্রত‍্যাখ‍্যান করাটা একটি স্বাভাবিক বিষয়। আমরা এমনকি এ ধরণের দৃশ‍্যপট আমাদেরকে এবং আমাদের প্রিয়জনকে প্রত‍্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে বিবেচনা করতে অপেক্ষাকৃত কম আগ্রহী। এটি সেই সব দেশ এবং মহাদেশের জন্য বিশেষভাবে সত‍্য যারা শান্তিতে রয়েছে এবং বহু প্রজন্ম ধরে নিশ্চিত ঝুঁকির অনুপস্থিতিতে ব‍্যক্তিগত নিরাপত্তার মধ্যে আছে। এভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে বিশেষভাবে ইউরোপীয় দেশগুলোতে এই মহামারির প্রতি ছেলেমানুষীপূর্ণ আচরণের অসংখ‍্য ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে, যেখানে আমরা বেপরোয়া অপ্রস্তুতি এবং কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত সরাসরি নির্দেশনা এবং প্রস্তাবসমূহ অনুসরণ করার অনিচ্ছা প্রত‍্যক্ষ করেছি। তারা তাদের ব্যবসা বাণিজ‍্য চালিয়ে গেলো, ভ্রমণ চালিয়ে গেলো এবং দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করলো, ‘দি প্লেগ’ নামক উপন‍্যাসে আলবেয়ার কামো যেমনটি লিখেছিলেন। ‘কিভাবে তারা তাদের চিন্তাকে প্লেগের মতো কোন কিছুর দিকে দিলো যা ভবিষ্যৎকে থামিয়ে দিয়েছে, ভ্রমণকে বাতিল করেছে এবং দৃষ্টিভঙ্গির মিথষ্ক্রিয়াকে স্থবির করে দিয়েছে। তারা কল্পনায় নিজেদের মুক্ত ভাবলো এবং বাস্তবে যতক্ষণ পর্যন্ত মহামারি আছে, ততক্ষণ কেউই মুক্ত হতে পারবে না। ’

শিশুসূলভ আশাবাদীদের সেবায় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের একটি পুরো দল, যারা পরিস্থিতিকে নাটকীয় না করে তোলার তাগিদ দেয়। তারা আমাদের অবহিত করে যে, এই নতুন ভাইরাসজনিত কারণে পুরো মহামারির সময় জুড়ে যতজন মানুষ মারা গেছে, সেই সংখ্যা প্রতিদিন সারা পৃথিবীতে যত মানুষ যক্ষার কারণে মারা যায় তার তুল‍্য। তারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, করোনা ভাইরাস যতজন মানুষের মৃত‍্যু ঘটাতে পেরেছে, এমনকি সাধারণ ফ্লু প্রতিদিন তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত‍্যুর কারণ। তারা আমাদের বলে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিন ১০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটায়, আর তাই বলে কেউ গাড়ি নিষিদ্ধকরণের কথা ভাবছে না।

যখন চূড়ান্তভাবে সাধারণ মানুষ এই সমস্যার সত‍্যিকারের মাত্রা উপলব্ধি করতে চোখ ফেরাতে বাধ‍্য হলো, তারা স্বার্থপর এবং বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতিবিদদের চেয়ে ভালো আচরণ করলো না। অবশ্যই এই মহামারি ইতোমধ‍্যে মানব সংহতি, বেসামরিক উদ্যোগ এবং সত্যিকারের বীরত্বের প্রমাণ দিয়েছে।

তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ দক্ষিণ ইতালিতে উত্তেজিত সক্রিয়তাবাদীরা দেশের বঞ্চিত উত্তরাঞ্চলীয় লোকজনকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেছে এবং কোন কোন এলাকায় তাদের এই অনাগ্রহের কারণে তারা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে দিয়েছে। ইউক্রেনের পলতোভা অঞ্চলে, স্থানীয় অধিবাসীরা উহান থেকে আসা স্বদেশীয় নাগরিক ভরা বাসগুলোর দিকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে। আফ্রিকা মহাদেশে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে এই ভয়ে আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশে সাধারণ জনগণ উহান থেকে আসা স্বদেশবাসীর সাহায‍্যের আবেদনের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কেন্দ্রীয় সরকার এই ভাইরাসের সম্ভাব‍্য বহনকারীদেরকে সামরিক বাসে বহন করতে বাধ‍্য হয়েছিল। ওয়েস্টারডামের একটি প্রমোদতরীর ক্ষেত্রেও একই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল। যাত্রীদের চাপে জাহাজটিকে দুই সপ্তাহ ধরে থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ফিলিপাইন এবং জাপানের বন্দরগুলোতে ভিড়তে দেওয়া হয়নি, যতক্ষণ না যাত্রীরা কম্বোডিয়ার শিয়ানৌকভিল বন্দরে নোঙর করেছে। প্রকৃত ঘটনা সত্বেও এসবই হয়েছিল যাতে এই ভাইরাসে সংক্রমিত একজন লোকও জাহাজে না পাওয়া যায়।

ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ইঙ্গিত দেয় যে, যে কোনো মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার তারাই, যারা ব‍্যতিক্রমহীনভাবে জরুরি অবস্থার আগে থেকেই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, জাতিগত, ধর্মীয় গোষ্ঠীভুক্ত। এসব গোষ্ঠী প্রচলিত সামাজিক বন্ধন বিলুপ্তি, মানসম্মত চিকিৎসা সেবার অভাব, বর্ধিষ্ণু বেকারত্ব এবং অন্য সব সমস্যার কারণে হুমকির সবচেয়ে উপযোগী। এই গোষ্ঠীগুলোকে প্রায়শই যেকোন দুর্যোগের পরিণতির জন্য দোষারোপ করা হয়। যেমন- ১৩৪৮-১৩৫১-এর ‘ব্ল‍্যাক ডেথ’ মহামারির সময়ে ইহুদি দাঙ্গা যেটা ইউরোপের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। চূড়ান্ত পরিস্থিতির অধীনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেরুকরণ ত্বরান্বিত হয় এবং একটি সাধারণ হুমকির মুখে অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক সংযোগ অর্জন করাটা চরম কঠিন হয়ে পড়ে।

এই বিষয়টিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে গেলে এভাবে উপসংহার টানাটা সমীচীন হবে যে, বৈশ্বিক মহামারির ঘটনায় সবচেয়ে কম সুরক্ষিত এবং সবচেয়ে কম সম্পদশালী রাষ্ট্র বা অঞ্চলগুলোই সবচেয়ে বেশি উপযোগী হবে। এটি একটি ঘটনা যখন ভাইরাসটা ছড়িয়েছে স্বচ্ছল ইউরোপ বা কার্যকরভাবে ব‍্যবস্থাপনায় সক্ষম চীনজুড়ে। এটি একেবারেই ভিন্ন ঘটনা হতো যদি, এই ভাইরাসটির কেন্দ্রবিন্দু হতো আফগানিস্তান, সিরিয়ার ইদলিব, দক্ষিণ সুদান বা গাজা উপত্যকা। বৈশ্বিক মহামারি আক্রান্ত এলাকাসমূহে, যেখানে বিধ্বস্ত পরিকাঠামো, রাজনৈতিক প্রগতিবাদীতা, চরমপন্থার উত্তপ্ত পরিস্থিতি এবং সশস্ত্র আক্রমণের স্থায়ী প্রকাশ থাকে, তা তাদেরকে যে পরিণতির দিকে নিয়ে যায় সেটি কল্পনা করা কঠিন।

যা কল্পনা করা সহজ, তা হলো, যদিও ইউরোপের জনপ্রিয় ডানপন্থীরা বা মধ‍্যপ্রাচ‍্যের চরমপন্থীরা এই পরিস্থিতিকে তাদের নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে কাজে লাগাবে। বাস্তবে, তারা এই মহামারীকে ইতোমধ‍্যে ব‍্যবহার করছে, কারণ তাদের জন্য করোনা ভাইরাস সুনিশ্চিতভাবে একটি ভবিষ্যৎ, কোন ‘আপদ’ নয়, একটি নতুন সুযোগ অথবা একটি নতুন হুমকি। ইউরোপে এই মহামারি ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন এবং পোলান্ডের ডানপন্থী দলগুলো, যারা দাবি করছিলো সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেওয়া হোক এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন বন্ধ করে দেওয়া হোক, তাদের যুক্তিকে জোরালো করলো।

মধ্যপ্রাচ‍্যে একটি মত বেশ চালু হয়ে গিয়েছিল যে, করোনা ভাইরাস মুসলিমদের ওপর অত‍্যাচার চালানোর কারণে চীনাদের প্রতি শাস্তি হিসেবে নাজিল হয়েছে। রাশিয়ায় এই ভাইরাসটি তাদের পক্ষে কাজ করেছে, যারা পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্নতা সমর্থন করতো, পশ্চিমের অপরিবর্তনীয় পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করতো।

গণমাধ‍্যমের সামাজিক দায়িত্ব কী? মহামারির সীমাহীন অনুমান, অতিআশাবাদী প্রচারণা ভুল তথ‍্যের একটি উৎসে পরিণত হয়েছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বসমূহ বিকশিত হয়েছে। ভাইরাসটিকে প্রচার করা হচ্ছে গোপন গবেষণাগারে প্রস্তুত বলে এবং এর পরিবেশন হচ্ছে ক্ষমতাবান অন্ধকারের শক্তিদের দ্বারা, যারা হয় ওয়াশিংটন অথবা বেইজিং অথবা জেরুজালেম অথবা এমনকি মস্কোতে থাকে। রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের দ্বারা প্রসারিত মহামারির ভীতিটা অন্ধকারের শক্তির দ্বারা লালিত-পালিত হচ্ছে, কর্দমাক্ত জলাধারে আলোড়িত হচ্ছে, যেগুলো যেকোন জাতীয় আঁতাতের তলায় অনিবার্যভাবে থাকে। বিভিন্ন ভীতিকর গল্পের দাবির বিপরীতে যার যোগান নিশ্চিত করে অগুণতি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের হীন আবিষ্কার। যা পূর্ববর্তী মহামারিগুলোর তাক থেকে ছিনতাই হয়ে যায় শহরাঞ্চলীয় মানুষদের বিনোদন এবং লবণের প্রয়োজনে।

এক বৈশ্বিক মহামারি: দেহের নয় মনের
সাধারণ চ্যালেঞ্জের মুখে মানুষের সমন্বিত প্রয়াস-হোক সেটা বিশ্বজনীন মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ-সাধারণভাবে নিম্নগামী। জাতীয়তাবাদের নিয়মাবদ্ধ চর্চা এবং জাতীয়তার স্বাতন্ত্র্য, অভ্যন্তরীণ অথবা বাহ্যিক বিদেশাতঙ্ক বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করার দাম্ভিকতা, কৌশলগত স্বার্থের চেয়ে যুদ্ধকৌশলগত স্বার্থকে প্রাধান্য প্রদান-এসবই বিশ্ব রাজনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ, যা আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি যে, পরিণতির ভেতর দিয়ে ছাড়া তা অগ্রসর হয় না।

মাত্র দুই দশক আগে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ইচ্ছেটি ছিল অপেক্ষাকৃত প্রবল। যখনই এই শতাব্দীর শুরুতে ‘বার্ড ফ্লু’ ছড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সংঘটিত হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে ভাইরাসটি শনাক্তকরণে চীনা সহযোদ্ধদের সহায়তা করতে এগিয়ে এলো। ফলস্বরূপ, চরমভাবে মারাত্মক ‘বার্ড ফ্লু’র সংক্রমণ (মৃত‍্যুহার পৌঁছেছিল ৬০%) অংকুরেই বিনষ্ট হলো এবং মাত্র কয়েক’শ মানুষ এই মহামারির শিকারে পরিণত হলো। অবশ্যই, ওই সময়টি ছিল আশীর্বাদপুষ্ট সময় যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীনের সাথে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতায় কোন বাধা ছিলো না এবং গণপ্রজাতন্ত্রটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নির্মম শত্রু মন করতো না।

ইবোলা ভাইরাসজনিত মহামারির পর থেকে, অনেক বছর ধরে কর্তৃত্বপূর্ণ মহামারি বিশেষজ্ঞগণ বারবার মারাত্মক সংক্রামক রোগের মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে আসছেন। কিন্তু নতুন মহামারিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সহ অন্যসব আন্তর্জাতিক সংগঠনের দুর্বলতা এবং ভঙ্গুর অবস্থা দেখিয়ে দিলো, যারা আজকের দিনে বিশ্বাস করে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) হতে পারে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বৈশ্বিক সদরদপ্তর। সংস্থাটিকে প্রদত্ত সম্পদ মূল্যায়ন করে প্রায় কেউই বলবে না যে, এর কাছে একটি বড় হাসপাতালের চেয়ে বেশি বাৎসরিক বাজেট রয়েছে। এই সত্য মেনে নিয়েও, মারাত্মক রোগ মোকাবেলায় এই সংগঠনটির অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। গুটি বসন্ত দূর করা, পোলিও এবং ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে এই সংগঠনটির সাফল্য স্মরণ করুন।

পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের সমাজ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, সেগুলোকে আর কেউ যেকোন মহামারি এবং সংকট মোকাবেলার জন্য ভরসা করার মতো বলে দেখছে না। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেও করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তা স্ব স্ব দেশের রাজধানীতে, ব্রাসেলসে নয়। কিন্তু সমাজ নিজ নিজ সরকারের ওপরও আস্থা পোষণ করছে না। কারণ, তারা মনে করছে, সরকার তাদের কাছে সত্য গোপন করছে এবং এই মহামারিকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের দিক থেকে সরকারগুলো একে অপরকে বিশ্বাস করছে না এবং তা শুধুমাত্র সম্ভাব‍্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষেত্রেই নয়, সহযোগী ও অংশীদারদের ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে। ফলে, অবিশ্বাসের একটি দুষ্টচক্র ক্রিয়াশীল রয়েছে যা যে কোনো মহামারির জন্য আদর্শ এক পরিবেশ।

এটি মনে হচ্ছে যে, ২০২০ সালের নভেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিতব‍্য জি-২০ সম্মেলন আসন্ন বৈশ্বিক মন্দা এবং করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক অর্থনীতির নতুন চ‍্যালেঞ্জকে ঘিরেই হবে। কিন্তু নিজেদেরকে স্ব স্ব দেশে এই মহামারি ঠেকাতে এক অসহায় অবস্থায় ব‍্যাপৃত রেখে, মানবজাতি কি নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে? এটি মনে করার কি কোন মূল‍্য আছে যে, আসন্ন মাসগুলোতে বিস্ময়কর কোন ভ‍্যাক্সিন আবিষ্কৃত হবে অথবা করোনা ভাইরাস গ্রীষ্মকালে ছড়াবে না? আমাদের কি এই বৈশ্বিক মহামারি বিষয়ে আলোচনার জন্য জি-২০-এর জরুরি সভা আহ্বান করা উচিত? 

এটি মনে হচ্ছে যে, জনগণের দিক থেকে চরম চাপ প্রয়োগ ছাড়া সরকারসমূহ নিজেরা এমন কোন উদ্যোগ গ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করবে না। কারণ, তারা এখনও করোনা ভাইরাসকে ‘আপদ’ মনে করছে না, বরং এটিকে বিশ্ব রাজনীতির একটি বিশিষ্ট বিষয় মনে করছে। এ ধরনের একটি মনোভাব মানব জাতিকে অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিবে এবং চূড়ান্তভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এটি শুধু বিমূর্ত ‘তাদেরকেই’ মানে সরকার বা কর্পোরেশনকেই অন্তর্ভুক্ত করে না, বরং সুনির্দিষ্টভাবে বললে ‘আমাদেরকে’ও। আজ যদি না-ও হয়, এটি দশ কিংবা পঞ্চাশ বছরে ঘটবেই। যদি করোনা ভাইরাস থেকে না-ও হয়, এটি হবে জলবায়ু পরিবর্তন অথবা বিশ্বব‍্যাপী পারমাণবিক যুদ্ধের কারণে। নিজেদের রক্ষা করার তাগিদে, যা সকল প্রাণীকুলে সহজাতভাবে বিদ্যমান, চূড়ান্তভাবে জাগিয়ে তোলার জন্য মানবজাতির আর কোন্ সংকেত দরকার?

লেখকঃ ইতিহাসে পিএইচডি; মহাপরিচালক, রাশান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল (RIAC)।

মূল লেখার লিংক 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।