ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কুসিক নির্বাচনের মানসাংক

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১২
কুসিক নির্বাচনের মানসাংক

এই লেখা যখন অনলাইনে প্রকাশ হবে, তখন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। পৈতৃক বসতির জেলা শহর হিসেবে নয়, দেশের আরেকটি জেলা শহরের সিটি কাউন্সিল নির্বাচনের যোগ-বিয়োগ, পূরণ-ভাগ আর মানসাংকের ভিত্তিতেই এই লেখা।

তবে আগে স্বীকার করে নেওয়া উচিত এই লেখা অবচেতনভাবে হলেও পক্ষপাতদুষ্ট হবার ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকে যাবে। কারণ একজন প্রার্থীর সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। পক্ষপাতের কোনো নমুনা-নিশানা যদি থাকে, আমি আগাম ক্ষমাপ্রার্থী।

কুমিল্লা শহরের সঙ্গে আমার প্রেম-ভালোবাসার শারীরিক মাতামাতি মাত্র নয় মাসের। নয়  মাসে যেখানে সন্তানের জন্ম হয়, সেখানে সুদীর্ঘ আবেগের ঘন প্রলেপ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত নয়। কুমিল্লা শহর আমাকে সেরা কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয়-জানা শোনার সুযোগ করে দিয়েছে। এই শহরের নামি-দামি ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকেই আমি দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোই।

সাংবাদিকতার সামান্য সূচনা হয়েছিলো অধ্যাপক ওহাবের ‘রূপসী বাংলা’ র মাধ্যমে। এই শহরেই কবিতার হাতেখড়ি কবি রশীদ মাহবুব ও আহমেদ বাবলুর উজ্জ্বল উৎসাহে। এই শহরেই মিলেছে ফরিদ মুজহার, হাসান ফিরোজ, ফখরুল হুদা হেলাল, আলাউদ্দিন তালুকদারের দেখা। এই শহরেই জন্ম ও বেড়ে উঠেছে প্রিয়তম বন্ধু কবি রেজা সেলিম, অনুজপ্রতিম নাঈমুল ইসলাম খান, ডা. আহমেদ শরীফ শুভ, সাংবাদিক রাশেদ চৌধুরী ও সাইফুল আমিন প্রমুখ।

নিত্য যোগাযোগের কারণে কুমিল্লার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্হিতির হালফিল খবরাখবর জানি। কুমিল্লা জন্ম দিয়েছে অনেক কৃতী রাজনীতিবিদ। আমার গ্রাম্য নির্বাচনী এলাকার সাংসদ ছিলেন জহিরুল কাইয়ুম, কাজী জাফর। হালের সাংসদ চিফ হুইপ মুজিবুল হক মুজিব আওয়ামী জোয়ারে নির্বাচিত হলেও জনপ্রিয় নন। তিনি অনেক নেতিবাচক রাজনীতির জনক ও পৃষ্ঠপোষক। চিওড়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আশরাফ সাহেবকে ব্যক্তিগত অপছন্দের সূত্রে প্রায় নাংগা করে ঢাকা-চাটগাঁ মহাসড়কে ঘুরিয়েছিলেন। কুমিল্লার আওয়ামী সংগঠক ও নেতা অধ্যক্ষ আফজল খানের সাথে উদীয়মান বাহারের মন কষাকষি উস্কে দিয়ে বিবাদ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। দুই আওয়ামী নেতা দীর্ঘদিন সেই আগুনে পুড়ে আওয়ামী সংগঠনটিকে কুমিল্লায় বিকাশে মনযোগী হতে পারেননি। দুই আওয়ামী নেতার কাদা ছোড়াছুড়ির অভিমানের মাঝখানে কুমিল্লার রাজনীতিতে উদয় হয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত খাকি আকবর হোসেন। মন্ত্রিত্ব হাসিলের সুবাদে আকবর হোসেন কুমিল্লার রাজনীতিতে স-আত্মীয় জাঁকিয়ে বসেছিলেন। মামাতো ভাই সাক্কু সেই সূত্রেই কুমিল্লার রাজনীতিতে প্রভাবশালী। কুমিল্লার রাজনৈতিক শক্তি যতটা না আওয়ামী তার চেয়ে বেশি বিএনপি,  যদিও কুমিল্লার সংখ্যাধিক্য সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক আওয়ামী ঘরানার।

চিফ হুইপ মুজিবের তীব্র বিরোধিতায় তুমুল জনপ্রিয় বাহার উদ্দিন মেয়র হতে ব্যর্থ হলেও শেষাবধি সাংসদ নির্বাচিত হতে পেরেছেন। প্রতিশোধের পালায় বাহারের অবস্থান এখন সুবিধাজনক। সদরের সাংসদ হবার  ‘অ্যাডভান্টেজে’ বাহার জেলার অন্যসব সাংসদকে একহাত নিচ্ছেন রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মাচারে। ছয়-সাত সাংসদ মিলে-মিশেও বাহারকে সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছেও বাহারের বিরুদ্ধে নারীসুলভ নালিশে গেছেন সাংসদরা। মেয়র প্রার্থী অধ্যক্ষ আফজল খানের মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদও সাংসদ বাহারের দাপটে কোনঠাসা। অভিজ্ঞতা থেকে বাহার জানেন, ক্ষমতাবিহীন রাজনীতিবিদদের দৌড় বাড়ির উঠোন পর্যন্ত। লজিকের বাইরে কিছুই করার নেই। আওয়ামী প্রার্থী আফজল খানের বিজয় দলীয় বিজয় হলেও চূড়ান্ত বিচারে এই বিজয় হবে সাংসদ বাহারের জন্যে অশনি সংকেত। কারণ আফজল খানের বিজয় হবে চিফ হুইপ মুজিব, লোটাস কামাল, মতিন খসরুসহ আরো তিন সাংসদের কুমিল্লার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির পুনঃদখল। স্বাভাবিক নিয়মেই সাংসদ বাহারের সেটা কাম্য হতে পারে না। হয়ওনি নিশ্চয়!

উল্টোদিকে সাবেক মন্ত্রী আকবরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সাবেক মেয়র বিএনপির মনিরুল সাক্কু কুমিল্লায় রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং টাকা পয়সা বানানোর বালু মহাল দখল ও টেন্ডারবাজিতে মত্ত হলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বঞ্চিত করেননি। অতি সিংহভাগ নিজে খেলেও অন্যদের কিঞ্চিৎ হলেও দিয়েছিলেন! ব্যক্তিগত সৌজন্যমূলক ব্যবহারের সুবাদে সাক্কু জনগণের কাছেও পছন্দের। অন্ততঃ আফজল খান ও বাহারের মতো হালের দুর্ব্যবহারকারীর তুলনায় সাক্কু ধোয়া তুলশি। উপরন্তু ক্ষমতাসীন সাক্কু বিরোধী নেতা ও সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী বাহারের প্রতি ছিলেন বিনম্র ও ভদ্র। সাংসদ বাহার সাক্কুর সেই ভদ্রতার প্রতিদান দিয়েছেন সাক্কুকে পুনরায় রাজনীতির মাঠে নামতে দিয়ে। সাক্কুর প্রত্যাবর্তন মূলতঃ বাহারের ব্যক্তিগত উৎসাহ ও সহানুভূতি। পাশাপাশি কাজ করেছে বাহারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। বাহার এখন কুমিল্লার রাজনীতির জয়নাল হাজারী। বাহারের ইশারা ছাড়া কিছুই হয় না কুমিল্লায়। অন্যদিকে কোনঠাসা আওয়ামী রাজনীতির প্রার্থী অধ্যক্ষ আফজল খানের অতীতের অহংকারী ব্যবহার তাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়।

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যতোই দলীয় মার্কা-সমর্থন আর রাজনীতির কথা বলা হোক না কেন, কুমিল্লার এবারের এই ভোটাভূটি মূলতঃ সদরের সাংসদ বাহার আর চিফ হুইপ মুজিবের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও অহংবোধের লড়াই। অনুমান হয়, আওয়ামী সাংসদ বাহারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিএনপি থেকে ‘লোক দেখানো’ পদত্যাগকারী সাক্কুর বিজয় খুবই অপ্রত্যাশিত হবে না। নিজের ঘরের বিবাদে প্রতিবেশীর লাভ নতুন ও অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা নয়। এক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম হবে এমনটা ধারণা করি না।

ইমেল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।