তবে বিচিত্র কাজকর্মের ব্যাপারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের দেশকে টেক্কা দেওয়া মুশকিল। ঠিক কী কারণ জানি না আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের দেশকে হেয় করে খবর প্রকাশ করতে খুব পছন্দ করে।
তবে কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য ডানে-বামে ঢালাওভাবে ডিজিটাল আইনে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এতো তুচ্ছ কারণে একজনকে গ্রেপ্তার করে ফেলা যায় সেটা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। আমি যখন প্রথমবার ডিজিটাল আইনটা দেখেছিলাম তখনই আমার মনে হয়েছিল এটি খুবই বিপদজনক একটা আইন, কারণ এটা ব্যবহার করে যখন ইচ্ছা যাকে খুশি তাকে গ্রেপ্তার করে ফেলা যাবে। ঠিক কতোটুকু বলা হলে একটা বক্তব্য কুরুচিপূর্ণ এবং কতোটুকু বলা হলে সেটি গ্রহণযোগ্য সেগুলো কোথাও লেখা নেই তাই একজনকে গ্রেপ্তার করা হবে কী হবে না সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের ভেতর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও আছে, যৌন হয়রানি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পার পেয়ে যান কিন্তু কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জন্য একজনকে গ্রেপ্তার হয়ে হাজতে থাকতে হয় আমি সেই হিসাবটা মিলাতে পারি না। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তার ভেতরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার একজন প্রাক্তন ছাত্রও আছে। আমি যতদূর জানি আমার এই প্রাক্তন ছাত্রটি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিল, হঠাৎ করে সে কী কারণে গ্রেপ্তার হয়েছে আমি জানি না। এগুলো জানতে হলে সোশ্যাল মিডিয়া ঘাটাঘাটি করতে হয় কিন্তু আমি নীতিগতভাবে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকি তাই সবকিছু জানতে পারি না। শুধু অনুভব করতে পারি কোথায় জানি অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
তবে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের দেশের মানুষের ভেতরে একটা মৌলিক পরিবর্তন করে ফেলেছে। একটা সময় ছিল যখন মানুষজন অশালীন কিংবা কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতো না। কীভাবে কীভাবে জানি সেই অবস্থাটা পাল্টে গেছে। এখন একজন অবলীলায় সোশ্যাল নেটওয়ার্কে অশ্রাব্য অশালীন কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশ করে ফেলে এবং সাথে সাথে অন্যরা সেটাতে “লাইক” এবং “শেয়ার” নামে অতি বিচিত্র আরো দুটো প্রক্রিয়া ঘটিয়ে তাকে উৎসাহ দেয়। মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বল অংশটুকুতে সুড়সুড়ি দিয়ে তাকে পাল্টে দেয়া হয়, সে আর স্বাভাবিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। একসময় মানুষ লেখালেখি করত এখন “স্ট্যাটাস” দেয়। যে কথাটি বললে মানুষ বেশী “লাইক” দেবে ঘুরেফিরে সেই কথাটিই বলে। শুধু যে নিয়ন্ত্রনহীন অশ্রাব্য অশ্লীলতা সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘটছে তা নয়, সম্ভ্রান্ত খবরের কাগজে খবর এর পেছনে “কমেন্ট” দেওয়ার বেলাতেও মানুষের কোন বাছবিচার নেই। সংবাদপত্রগুলো দায়িত্বহীনের মত পাঠকদের অমার্জিত কথা বলার সুযোগ করে দেয়। আমি সযত্নে সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, তারপরেও হঠাৎ চোখ পড়ে গেলে শিউরে উঠি, গা ঘিন ঘিন করতে থাকে। আমাদের দেশের মানুষ কেমন করে এতো অমার্জিত, এতো অভব্য হয়ে গেল?
বিষয়টি জটিল। করোনার যন্ত্রণা শেষ হয়ে গেলে আমাদের একটা নুতন আন্দোলন শুরু করতে হবে যেখানে সবাইকে বোঝাতে হবে, অমার্জিত, অভব্য, অশালীন কথা বলে আরো কিছু অশালীন মানুষের বাহাবা পাওয়াটি আধুনিকতা নয়, সুন্দর করে মিষ্টি কথা বলা হচ্ছে সত্যিকারে আধুনিকতা।
২.
বেশ কিছুদিন আগে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম স্কুলের ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষা নিয়ে। আমাদের দেশের পুরো লেখাপড়াটাই হয়ে গেছে পরীক্ষা কেন্দ্রিক অথচ পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যেখানে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হয় ১৬ বছর বয়সে। আমাদের ছেলেমেয়েদের আমরা পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিয়ে জর্জরিত করে রাখি কিন্তু দিন শেষে আমরা যখন যাচাই করতে যাই তারা কতোটুকু শিখেছে তখন দেখতে পাই মূল বিষয়গুলোই তারা ঠিকভাবে শেখেনি। সেই লেখায় আমি অনেকটা কৌতুকের সাথে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পরীক্ষা নিয়ে লেখাপড়া করিয়ে যদি আমরা তাদের ঠিকভাবে শেখাতে না পেরে থাকি তাহলে পরীক্ষা ছাড়া লেখাপড়া করিয়ে দেখলে কেমন হয়? খুব তো খারাপ কিছু হওয়ার কথা নয়, অন্ততপক্ষে ছেলে মেয়েদের জীবন তো একটুখানি আনন্দময় হবে! বলাই বাহুল্য আমার বক্তব্য মোটেও বাস্তবমুখী ছিল না, কেউ সেটা সিরিয়াসলি নেবে আমি আশা করিনি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না নেওয়ার একটা প্রস্তাব বহুদিন থেকে আলোচনা করা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত সেটা বাস্তবায়ন করা গেছে কীনা আমি সেটা এখনো জানি না।
আমি মোটেই এভাবে চাইনি, তারপরেও কোনো পরীক্ষা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা বছর কাটিয়ে দেবে—আমার সেই অবাস্তব প্রস্তাবটি হঠাৎ করে সত্যি সত্যি ঘটে যাবার একটি সম্ভাবনা (কিংবা আশংকা) তৈরি হয়েছে। করোনার কারণে দেশ এখনো আবদ্ধ, লকডাউন তুলে দেবার পর বেছে বেছে কিছু এলাকাকে রেড-জোন ঘোষণা করে আবার সেগুলো আবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। অনেক কিছু খুলে গেছে কিন্তু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ৬ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ। সত্যি সত্যি ৬ আগস্টের ভেতর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ফেলার মত অবস্থা হলে আমাদের আনন্দের সীমা থাকবে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে অবস্থা, ৬ আগস্ট সত্যি সত্যি আমরা সব স্কুল কলেজ খুলে দিতে পারব কিনা কেউ সেটা এখনো জানে না। কাজেই এমনটি হতেও পারে যে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিতে নিতে আরো সময় লেগে যাবে, দেখা যাবে তখন পরীক্ষা নেওয়ার মতো সময় হাতে নেই। তখন অন্য কোনোভাবে তাদের যাচাই করে উপরের ক্লাসে তুলে দেওয়াটাই সম্ভবত একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে।
আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছি কিন্তু শিক্ষকদের সাথে এখনো যোগাযোগ আছে। মাঝে মাঝেই তাদের কাছ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা অনলাইন লেখাপড়ায় খুব উৎসাহী নয়। তাদের নানা ধরনের যুক্তি আছে, কিছু দায়সারা কিছু সত্যি। বড় শহরে ইন্টারনেট সার্ভিস কাজ চলে যাবার মতো হলেও মফস্বলে সেটা সেরকম নির্ভরযোগ্য নয়। আমার একজন ছাত্রের (পরবর্তীতে সহকর্মী) বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ নেই বলে সে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ২.৫ কিলোমিটারের ফাইবার টেনে নিয়ে গেছে! সবাই তার মত করিৎকর্মা হবে সেটি আশা করা যায় না। কাজেই ছাত্রছাত্রীরা যদি সেটা নিয়ে অভিযোগ করে কিংবা খরচের অজুহাত দেয় সেটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী সংসদে বলেছেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হচ্ছে। আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে সেটার জন্য অপেক্ষা করছি। রাষ্ট্রীয় একটা সমাধান করা হলে তখন ছাত্র-ছাত্রীদের সেটা ব্যবহার করতে আগ্রহী করা যায়। জোর করে কিছু একটা চাপিয়ে দেওয়া হলে সেটা সব সময় কাজ করে না!
৩.
অনেকদিন থেকে লকডাউনে আটকা পড়ে আছি। প্রথমদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে সেরকম কাউকে চিনতাম না। এখন ধীরে ধীরে অনেক পরিচিত মানুষজনকে করোনায় আক্রান্ত হতে দেখছি, শুধু একজন নয় বেশিরভাগ সময়েই স্ত্রী-পুত্র সন্তানদের নিয়ে পুরো পরিবার। তবে আশার কথা তাদের বেশির ভাগের মাঝেই কোনো উপসর্গ নেই এবং দেখতে দেখতে সবাই ভালো হয়ে যাচ্ছেন। তবে তার ভেতরেও মাঝে মাঝে মন খারাপ করা খবরও পাই, প্রিয় এবং পরিচিত কেউ কেউ পৃথিবী থেকে বিদায় নিছেন। সেরকম একজন হচ্ছেন মেয়র কামরান। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি সিলেটে, একজন সিলেটে থাকবে আর মেয়র কামরানের সাথে পরিচয় থাকবে না সেটা তো হতে পারে না। তাই মেয়র কামরানের মৃত্যুটি আমাকে বিষন্ন করে তুলেছে। একটা ঘটনার কথা আমার মনে আছে, তখন বি.এন.পির আমল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরেরা হঠাৎ করে কাজ করা বন্ধ করে দিল, আর ঠিক তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একধরনের গোলমাল শুরু হয়েছে। তখন কথা নেই বার্তা নেই পুলিশ এসে গুলি করে আমাদের একজন ছাত্রকে মেরে ফেলল। স্বাভাবিকভাবেই সাথে সাথে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষোভে ফেটে পড়েছে, ক্ষিপ্ত ছাত্ররা এসে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, সব মিলিয়ে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা। পুরো ক্যাম্পাসে চরম উত্তেজনা, উত্তেজিত মানুষের চিৎকার, হইচই, ছোটাছুটি। তার মাঝখানে আমি আর আমার স্ত্রী ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম দুজন কম বয়সী মানুষ আমার পিছনে পিছনে হাঁটছে, আমি যেখানে যাই তারাও পিছু পিছু সেখানে যায়। আমি একসময় একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কারা? কী চান?” তাদের একজন বলল, “আমাদের মেয়র কামরান পাঠিয়েছেন। এরকম গোলমালের সময় যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। আমাদের পাঠিয়েছেন আপনার সাথে সাথে থাকার জন্য, যেন এই গোলমালের সুযোগ নিয়ে আপনাকে কেউ কিছু করতে না পারে। ” আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার জন্য তাঁর এই ভালোবাসার প্রতিদানটুকু আমি তাঁকে কেমন করে দেব?
একইভাবে কামাল লোহানীও চলে গেলেন। শেষবার শিল্পকলা একাডেমির একটা অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল। মনে হয় তখন তাঁর দৃষ্টি নিয়ে একটু সমস্যা, দূর থেকে আমাকে চিনতে পারেননি। মঞ্চে যখন পাশাপাশি বসেছি তখন চিনতে পেরে আপনজনের মত আমার খোঁজ খবর নিলেন। এতো বড় একজন মানুষ, যিনি নিজেই একটি কিংবদন্তি, একটি ইতিহাস, তার পাশে বসে আন্তরিকভাবে কথা বলা আমার মত একজন মানুষে জন্য কত বড় সৌভাগ্যের একটা ব্যাপার। তিনিও চলে গেলেন—মনে হচ্ছে মাথার উপর থেকে একটি একটি করে ছায়া সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিশাল একটা প্রান্তরে এখন আমরা একা একা দাঁড়িয়ে আছি।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩২ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০২০
এএটি