ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হলে দায় কার?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২০
অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হলে দায় কার?

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষত ফেসবুকে ক্রোয়েশীয় পুলিশের বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার এক বাংলাদেশি যুবকের ছবি নিয়ে তোলপাড় দেখা গেছে। ৩০ বছর বয়স্ক এ যুবকের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলা শহরের সুলতান মাহমুদপুরে। তিনি অবৈধপথে গ্রিস থেকে ইতালি যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ইতালি ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ স্লোভেনিয়ার গহিন জঙ্গলে সেখানকার আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাকে ক্রোয়েশিয় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আর ক্রোয়েশীয় পুলিশের বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি এখন বসনিয়ায় একটি হাসপাতালে জার্মানির একটি মানবিক সংগঠনের অধীনে চিকিৎসাধীন। 

পুলিশি নির্যাতনের শিকার যুবকের ক্ষত বিক্ষত মুখমণ্ডলের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে গত ২১ জুন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাসহ ইউরোপের কয়েকটি শহরে এর প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। ভিয়েনার রাস্তা দখল করে কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে হাজার হাজার নারী পুরুষ রাস্তায় নামে বাংলাদেশি যুবক রাসেদুজ্জামান রুয়েলের ওপর নির্মম নির্যাতনের ন্যায়বিচারের দাবিতে।

তাদের অনেকের হাতে ছিল ক্রোয়েশীয় পুলিশের নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি যুবক রাসেদুজ্জামান রুয়েলের ক্ষত বিক্ষত মুখের ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও ব্যানার। অনেকের হাতে ‘সেইম ইইউ’ বা ‘লজ্জা ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ লেখা সম্বলিত ফেস্টুন দেখা যায়।  

অবৈধ পথে অভিবাসী হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ওপর ইউরোপীয় দেশগুলোর এ ধরনের নির্যাতন নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ফ্লাউডের ঘটনায় ইউরোপসহ সারা বিশ্বে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে এসব বিচার বহির্ভূত নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাই প্রতিবাদীমুখর হওয়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে রুয়েলের ঘটনাটি সামনে চলে আসে।  

বাংলাদেশি যুবকের ওপর ক্রোয়েশীয় পুলিশের এ ধরনের অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদে শুধু অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় নয়; লন্ডনেও বিক্ষোভ হয়েছে। ইউরোপের অনেকগুলো সংবাদ মাধ্যম    গুরুত্ব সহকারে বিক্ষোভ ও পুলিশি নির্যাতনের খবরটি প্রচার করে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছবি দেখে দেশে থাকা তার বড় ভাই রকি আহত যুবক রাসেদুজ্জামান রুয়েল বলে নিশ্চিত করেন।  

হবিগঞ্জ শহরের সুলতান মাহমুদপুরের রাসেদুজ্জামান রুয়েল আড়াই বছর পূর্বে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন। বর্তমানে তিনি বসনিয়ার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

ইউরোপের মানবতাবাদী মানুষগুলো রাস্তায় নামলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এরকম একটি ঘটনার এখন পর্যন্ত প্রতিবাদ জানানো হয়েছে বলে কোনো সংবাদ দেখিনি। এমনকি বসনিয়ার কনসাল জেনারেলও বাংলাদেশি এ যুবকের এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ-খবর নেননি। হয়তো অবৈধ পথে এ যুবক ইতালি যাচ্ছিলেন বলে রাষ্ট্র তাকে ধারন করছে না। হয়তোবা এখানে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির ব্যাপারটি জড়িত।  

আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে আজ। করোনা বাধা হয়ে না দাঁড়ালে ২০/২২ বছরের মধ্যে উন্নত দেশের কাথারে থাকার কথা। সুতরাং আমাদের দেশ থেকে মানব পাচার হয় এটি বহির্বিশ্বে আমাদের একটা ভাবমূর্তির সংকট সৃষ্টি করবে বৈ কি।  

এ ঘটনার দায় কি শুধু উন্নত ভবিষৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া রুয়েলদেরই? রাষ্ট্রের কি এখানে কোনো দায় নেই? লেখাপড়ার বদৌলতে আমার ৮ বছরেরও বেশি সময় কেটেছে ইংল্যান্ডে। তখন ইউরোপের অনেকগুলো দেশ ভ্রমণের সুযোগ হয়। মেলামেশা হয় অনেক বৈধ অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীর সাথে। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ গমনের নানা লোমহর্ষক কাহিনী আমি তাদের কাছ থেকে শুনেছি। যদিও তারা মূলতঃ নিজেদের ও পরিবারের ভাগ্য নির্মাণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে পথে বিড়ম্বনা ও নানা নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক সাগর, নদী, মরুভূমি ও দুর্গম পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছান। প্রকারন্তরে তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বিরাট ভূমিকা রাখছেন। আজ বাংলাদেশের রাস্তাঘাট হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের ছেলে মেয়েরা বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছে তাদের রক্তঝরা পাঠানো অর্থে। মন্ত্রী আমলা শিক্ষকদের বেতন হচ্ছে তাদের ঘামের টাকায়। প্রবৃদ্ধির চাকা সামনের দিকে ঘোরাতে রেমিটেন্স আজ অন্যতম নিয়ামক। অপরদিকে ক্রান্তিকালে এদের জন্য কোনো প্রণোদনার দাবিও ওঠে না। আমাদের দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলো নিগ্রহের শিকার হওয়াটা তাদের জন্য স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।  

কিন্তু এসব যুবক প্রতারণার শিকার হয়ে বিদেশে যখন অবৈধ হয়ে পড়েন, নির্যাতনের শিকার হন, জেলে যান বা মারা যান তখন আমরা তাদের দায়দায়িত্ব নিতে চাই না। এতে আমাদের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। কিন্তু একটি বার কি আমরা নিজেদের কাছে প্রশ্ন রাখছি কেন প্রতিবছর হাজার হাজার যুবক অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকির কথা জেনেও এভাবে দেশ ছাড়ছেন? আর পথে পথে অমানবিক নির্যাতন বা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে জীবন বিসর্জন পর্যন্ত দিচ্ছেন? 

মানবপাচার কোনো স্থানীয়, জাতীয় বা আঞ্চলিক সমস্যা নয়; বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। সারাবিশ্বে মানবপাচারকারীদের রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। আমাদের দেশের পুলিশ বা গোয়েন্দাসংস্থাগুলো এদের চেনে না, ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। এদের নেটওয়ার্ক এতোই শক্তিশালী যে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র এদের কাছে অসহায়। এক মানবপাচারকারী তো শুধু নিজে সংসদ সদস্য হননি; স্ত্রীকেও সংসদ সদস্য বানিয়েছেন। তিনি কেবল মধ্যপ্রাচ্যের একটি ছোট্ট দেশ কুয়েতে মানবপাচারে জড়িত। কয়েক দফা রিমান্ড শেষে এখন কারাগারে। কুয়েতের আদালতে বিচার হবে তার। বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত তার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। দুদক অবশ্য তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে দেশ ছাড়তে নিষেধ করেছে। এ ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায় কুয়েতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের একটি ছোট্ট দেশে মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তি যদি এত শক্তিশালী হতে পারেন, এত ক্ষমতাবান হতে পারেন, ক্ষমতার জোরে জীবনে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী না হয়েও স্বামী-স্ত্রী দুজন সংসদ সদস্য হয়েছেন তাও আবার দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা থেকে। আর যারা ইউরোপের মতো দেশগুলোতে মানবপাচারে জড়িত তাদের শিকড় কতো গভীরে, তাদের নেটওয়ার্ক কতো শক্তিশালী!

লেখক: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।  
ইমেইলঃ [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।