টাঙ্গাইল শাড়ি কেমন লাগে?
এক কথায় উত্তর হবে সুন্দর, অনেক ভালো লাগে। ‘আই লাভ টাংগাইল শাড়িস’।
ভালোবাসার ও ভালোলাগার এই টাঙ্গাইল শাড়ির ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। করোনার এই উন্মাতাল সময়ে অনেকেই যেমন পারিবারিক এই ব্যবসার হাল ধরেছেন অনলাইনের মাধ্যমে তেমনি অনলাইন কেনাকাটায় মানুষের আগ্রহ বাড়ার পাশাপাশি ই-কমার্স অর্জন করেছে মানুষের আস্থাও। এই ই-কমার্স বা অনলাইনের বদৌলতে যারা টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি করছেন বা কিনছেন তাদের কি একটুও জানতে ইচ্ছে করে না যে, যাদের শ্রমে ঘামে একটির পর একটি সূতার বুননে পূর্ণতা পায় একটি শাড়ি, যে শাড়ি সুন্দর রুচিশীল করে উপস্থাপন করে আপনাকে, ফুটিয়ে তোলে আপনার ব্যক্তিত্ব, সেই শাড়ি যারা তৈরি করেন তারা কেমন আছেন বা কেমন আছে সেই তাঁতপল্লী? করোনায় স্থবির এলাকায় কেমন কাটলো বানে ভাসা ঈদ?
চলুন জানার চেষ্টা করি অল্প একটু। আমি টাঙ্গাইলের ছেলে, আরও প্রিসাইজ করে বললে টাঙ্গাইলের যে এলাকা মূলত শাড়ি তৈরির আঁতুরঘর সেই বল্লা-রামপুর এলাকায় আমার বাড়ি। কিছু ব্যক্তিগত দুঃখগাথা ভাগাভাগি করি আপনাদের সঙ্গে। হ্যাঁ, ব্যক্তিগতই তো। টাঙ্গাইল শাড়ি যারা তৈরি করেন তারাই তো আমার আপনজন।
মানুষের দুরবস্থা বা দুদর্শা কত প্রকার হতে পারে? সহজভাবে চিন্তা করলে আর্থিক, শারীরিক বা মানসিক এই শব্দগুলোই মাথায় আসে। বিজ্ঞ পণ্ডিতজন আরও বিস্তারিত বলতে পারবেন। আমি সে আলোচনায় যাব না। করোনা ও করোনা পরবর্তী বন্যার আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি বা কষ্টের কথাই আমার আজকের আলোচ্য বিষয়। আমাদের এলাকার অর্থনীতি মূলত শাড়ি নির্ভর। কেউ শাড়ি বানায়, কেউ বিক্রি করে আবার কেউ বা তাঁতের যন্ত্রাংশ ও বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে বাজারে। এই যেমন কেউ মাকু, ম্যারা বা অন্যান্য জিনিস বিক্রি করে আবার কেউবা দামী সূতা, পলিস্টার বা রঙ বিক্রি করেন। আবার যারা ভ্যান বা রিকশা চালান তারাও কিন্তু মূলত সূতা, কাপড় বা তাঁতের অন্যান্য জিনিসপত্রই বহন করে তাদের ভ্যান বা রিকশায়। থেমে নেই আমাদের এলাকার মা বোনেরা। তাঁতনির্ভর অর্থনীতিতে তাদেরও রয়েছে সমান অবদান। প্রায় সব বাড়ির সব মেয়েরা চরকায় সূতা কেটে দু’চার পয়সা আয় করেন বিপদে সংসারের কাজে লাগানোর জন্য।
আবার যারা ছাত্রী, স্কুল বা কলেজে পড়াশোনা করে তারাও অবসরে শাড়ির নকশা কেটে বা আচুলি বেঁধে বন্ধুদের সাথে পিকনিক করার পয়সাটা যোগাড় করতে পারে। ঘুরে ফিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সব কিছুই ঐ তাঁত ও শাড়ি রিলেটেড।
পরিসংখ্যান যেহেতু পড়েছি, তাই বলি তাঁত বা শাড়ি হচ্ছে আমাদের এলাকার সেন্ট্রাল টেনডেন্সি বা কেন্দ্রীয় প্রবণতা। টাঙ্গাইল শাড়ির বাজারটা মূলত দুই ঈদ ও এক পূজার সময়। আর সারা বছর বিক্রি চলে নামে মাত্র। গত ঈদ ছিল করোনা নামক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। যেখানে জীবন বাঁচানোই দায় সেখানে মানুষ শাড়ি কিনবেই বা কিভাবে! ফলে বিপুল সংখ্যক শাড়ি প্রায় প্রত্যেক তাঁতীর বাড়িতেই জমে আছে। এর আর্থিক ক্ষতি তাঁতীরা ও এলাকার মানুষ ভোগ করছে গত কয়েক মাস ধরেই। করোনাকালীন লকডাউনে মানুষের আর্থিক সমস্যা ছিল, মানসিকভাবে ছিল বিপর্যস্ত কিন্তু শারীরিক ভোগান্তি ছিল না। অন্তত বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকার উপায় ছিল। কিন্তু গোঁদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত হাজির বন্যায় সে উপায়ও নেই। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলাই প্রায় পানির নিচে। কয়েকদিন আগে আবার টাঙ্গাইল সদর উপজেলার নওগাঁ গ্রামে এলানজানী নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত বিশ গ্রাম। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী। ঘরের চাল, গাছের ডাল সব জায়গায় রাম-রাজত্ব করছে আগ্রাসী বন্যার পানি। সাধারণ কাঠের তাঁত থেকে শুরু করে দামী তাঁত বা পাওয়ার লুমগুলো এখন পানির নিচে। অসহায় তাঁতীদের চেয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায় আসলে নেই। অনেকেই ভেবেছিলো করোনার কারণে রোজার ঈদে বিক্রি করতে না পারলেও স্টকের শাড়িগুলো কোরবানির ঈদে বিক্রি করবে। কিন্তু বিক্রি তো দূরের কথা শাড়িগুলো বাঁচানোই দায় এখন।
মূলত টাঙ্গাইলের পরিবেশ বা অনুকূল আবহাওয়ার জন্য তাঁতীরা থিতু হয় এই অঞ্চলে। এখন এই বর্ষায় বিরূপ আর্দ্র পরিবেশে রাখা স্টকের কাপড়গুলোর গুণগত মান কতটুকু ঠিক থাকবে তা বলার উপায় নেই।
স্টকের এই শাড়িগুলো রাখবে কোথায়? ফ্যাক্টরি ঘর, থাকার ঘর, রান্না ঘর সব জায়গায় জল থৈ থৈ। এমন অবস্থা যে অনেকেই বাড়ি ঘর, দামী মেশিনারিজ পানির নিচে ফেলে জীবন বাঁচাতে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। খাবার পানির সংকটের পাশাপাশি নেই প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার উপযুক্ত স্থান। অমানবিক, নির্মম দম বন্ধ করা পরিবেশ চারপাশে।
চাকা ঘুরলে যেমন গাড়ির ইনকাম হয়, তেমনি খটখট শব্দ হলেই আমাদের এলাকা ভালো থাকে। কেউ পায় শাড়ি বোনার মজুরী আবার কেউ পায় ঐ শাড়ি বিক্রি করে মুনাফা। করোনা-বন্যার থাবায় প্রায় পাঁচ মাস যদি মাকু না চলে তবে বাঁচবে কিভাবে তাঁত শ্রমিক ও শাড়ি ব্যবসায়ীরা!
আর্থিক অবস্থা কতটুকু ভয়াবহ তার ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। আমাদের ছোট্ট গ্রামে তিনটি পাড়া। আমাদের পাড়ায় প্রতি ঈদে বড় ছোট মিলিয়ে ২৮-৩০টি গরু কোরবানি করা হয়, সাথে কিছু ছাগল বা খাসিও থাকে। কিন্তু করোনা ও বন্যা এলাকার অর্থনীতি এমনভাবে বিনষ্ট করেছে যে এবার আমাদের পাড়ায় মাত্র ৬/৭টি গরু কোরবানি হয়েছে সব মিলিয়ে। অনেকের সার্মথ্য থাকলেও একটি গরু কোরবানি করার মতো ভিটেটুকুও পানির ওপর নেই। বসে খেলে নাকি রাজার ধনও ফুরায়। আর সাধারণ মানুষের কয় টাকাই বা সঞ্চয় থাকে! করোনা এবং বন্যা, সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ মাস যাবৎ এক অবর্ণনীয় পরিস্থির মুখোমুখি আমার এলাকার মানুষ।
বন্যা হয়তো সাময়িক, যা ক্ষতি করার করে চলে যাবে কয়েকদিন পর। কিন্তু করোনা সমস্যার সমাধান না হলে সচল হবে না এই এলাকার অর্থনীতি। তাছাড়া দেশের এই বৃহৎ কুটির শিল্প বাঁচাতে সূতা ও রঙের মূল্য সহনীয় মাত্রায় রাখার পাশাপাশি বিদেশি শাড়ির অন্যায্য প্রবেশ ঠেকাতে সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরকার করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য ৪% সুদে ঋণ সেবা চালু করেছে। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই রকম স্বল্প সুদে টাঙ্গাইলের তাঁতীদের ঋণ সুবিধা দিলে আবার ঘুরে দাঁড়াবে দেশের বৃহৎ এই কুটির শিল্প খাত। দেশের মানুষ স্বল্প মূল্যে পাবে নান্দনিক শাড়ি। বাঁচবে তাঁতীরা, হাসি ফুটবে লক্ষ পরিবারের মুখে।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা