হায় আঁশ! সোনালী আঁশ! আগে কি জানতাম তুমিই হবে শ্রমিকের মৃত্যু ফাঁস! প্রিয় পাঠক, আমরা এবং আমাদের পূর্বের কয়েক প্রজন্ম পাট নিয়ে রচনা না লিখে প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হতে পেরেছে, এমন কাউকে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট এ অঞ্চলের মাটিতে জন্ম নেওয়া এক দুর্ভাগা রাজকন্যার নাম ‘পাট’।
কম-বেশি আমরা সবাই জানি, জলবায়ুর কারণে পৃথিবীর সব স্থানে সব ফল-ফসল ফলে না। প্রকৃতির কল্যাণে আমাদের এ অঞ্চলে পাট নামের এক আশীর্বাদের ফসল ফলে। গড়ে ওঠে পাটকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং ভারী শিল্প। পাটের কদরই পাটকে ‘সোনালী আঁশ’ উপাধি এনে দেয়। সোনার মতোই ভূমিকা রাখে অর্থনৈতিক গতি সঞ্চারে। এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম পাটকল স্থাপিত হয় কলকাতায়, ১৮৮৫ সালে। একজন বিদেশি যার নাম জর্জ অকল্যান্ড এবং একজন বাঙালি যার নাম শ্যামসুন্দর সেন। দুজনের যৌথ মালিকানায় কলকাতার হুগলি নদীর তীরে ‘রিশড়া’ নামক স্থানে প্রথম পাটকল স্থাপিত হয়।
এ পাটকলটি স্থাপিত হওয়ার পূর্বে এ অঞ্চলের কৃষকরা পাট দিয়ে ব্যবহার্য কিছু সামগ্রী তৈরি করতো এবং তাঁতীরা তৈরি করতো মোটা কাপড়। কিন্তু ১৮৮৫ সালে পাটকল স্থাপনের ফলে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আসে। ধীরে ধীরে পাট এবং পাটজাত দ্রব্য আরও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফলে পাটের চাহিদা ও উৎপাদন দুটোই বেড়ে যায়। এ অঞ্চলের কৃষির দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় পাট। স্কটল্যান্ডের মিলগুলো বিকল্প কাঁচামাল হিসেবে পাটকে ব্যবহার করলে কাঁচা পাট রপ্তানির বাজার চাঙ্গা হয় ১৮৩১ সালের পর থেকেই। ১৮৩৮ সালে স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডির মিলগুলো বিপুল পরিমাণ ব্যাগ তৈরির কাজে পাট ব্যবহার শুরু করে। ফলে এ অঞ্চল থেকে কাঁচা পাট রপ্তানির বাজার তখন থেকেই তৈরি পাঁকাপোক্ত হয়ে যায়। তবে এ অঞ্চলে পাটকল স্থাপিত হয় অনেক পরে, ১৮৮৫-তে। পাট সম্বন্ধে গবেষণা বলছে, ১৮৯৫-১৯১২ সালের মধ্যে পৃথিবীময় পাটের চাহিদা তিনশ’ গুণ বেড়ে যায়। অতএব পাট সে সময়ে এ অঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বময় বিচরণ আরম্ভ করে। ফলে পাটকল স্থাপনের ধুম পড়ে যায় এ অঞ্চলে। উল্লেখ্য, তদানীন্তন ভারতে পাটকল স্থাপন ও পাট ব্যবসায় মারোয়াড়িদের অংশগ্রহণ ছিল বিপুল সংখ্যক।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে পাট এবং পাটকলের মধ্যে রাষ্ট্রের সীমানা প্রাচীর ওঠে। কেননা পাটকলগুলো স্থাপিত হয়েছে ভারতে, কিন্তু ৮০% পাট উৎপাদিত হয় পাকিস্তানে। এমন বাস্তবতায় পাটকল এবং পাটের মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়। কিন্তু আমদানি-রপ্তানি বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে বিদেশি রাষ্ট্র ঘোষণা করলে স্বাক্ষরিত চুক্তি ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালের পরে আর বহাল রাখা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে তদানীন্তন পাকিস্তানে পাটকল স্থাপন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ৮০% পাট পাকিস্তানে উৎপাদন হয় বলতে বোঝানো হয়েছে বাংলাদেশকে, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানেই সিংহভাগ পাট উৎপাদন হয়। ফলে পাটকল স্থাপিত হয় পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশে। নারায়ণগঞ্জে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৯৫১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম পাটকল স্থাপিত হয়, যার নাম ‘বাওয়া জুট মিলস্ লি.’। একই বছরে স্থাপিত হয় দ্বিতীয় জুট মিলস্, যার নাম ‘ভিক্টোরী জুট মিলস্’। তৃতীয় জুট মিলস্ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বনন্দিত ‘আদমজী জুট মিলস্’। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই, ওয়াহেদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী এবং গুল মোহাম্মদ আদমজী যৌথভাবে নারায়ণগঞ্জে ‘আদমজী জুট মিলস্’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫০ সালে মিলটি স্থাপিত হলেও উৎপাদন আরম্ভ করে ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর হতে। ২৯৭ একর জমির ওপর ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং লুম নিয়ে মিলটি উৎপাদন আরম্ভ করে। দ্রুততম সময়ে এ মিলটি ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়। এভাবেই সোনার বাংলার সোনালি আঁশের ইতিহাস সমৃদ্ধি লাভ করতে থাকে।
পরবর্তী সময়ে প্রচুর পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে। পাটকলগুলো তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে ব্যাপকভাবে। সোনার মতোই মূল্যবান হয়ে ওঠে পাট, অর্থাৎ সোনালী আঁশ। কিন্তু দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এখন লিখতে হবে এ রাজকন্যার শোকগাঁথা। ১৯৭১ সালে বীরবিক্রমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করলাম। সোনালী আঁশের আঁতুর ঘর বাংলাদেশ নতুন স্বপ্নে বিভোর হলো এ শিল্প নিয়ে।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার আগে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ১১ দফাতেও পাটশিল্পকে জাতীয়করণের দাবির উল্লেখ ছিল। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে ৭৭টি পাটকল জাতীয়করণ করে বিজেএমসির অধিভুক্ত করা হয়। কিন্তু দিন যেন রাত হতে থাকে, পাটকলগুলো লোকসান গুণতে শুরু করে। সরকার কিছু পাটকল বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়। বেসরকারি কলগুলো মুনাফা অর্জনে সক্ষম হলেও সরকারের আওয়তাধীন কলগুলো লোকসান শুধু অব্যাহত রাখে না, বরং বাড়িয়ে দেয় দ্রুত গতিতে। অবশেষে ২০০২ সালে বন্ধ হয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ পাটকল আদমজী।
পাটকল বন্ধের কৃষ্ণসূচনা করেছিল তদানীন্তন সামরিক শাসক এরশাদ। আজকের কথা বলাই বাহুল্য। দেশের সব পাটকল বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিদায় জানানো হচ্ছে। সরকারের বক্তব্য লোকসান গুণতে গুণতে রাষ্ট্র ক্লান্ত। চেষ্টাও করেছে রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ১৯৯০ সালে সমীক্ষা চালানো হয় বিদেশি পরামর্শকের সমন্বয়ে। বিশ্বব্যাংক পাটকল বন্ধের পরামর্শ দিয়েছে। অবশ্য একই সময়ে বিশ্বব্যাংক ভারতকে পাটকল স্থাপনের জন্য ঋণ সুবিধা দিয়েছে এবং আমাদের ঋণ দিয়েছে পাটকল বন্ধের জন্য।
সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী প্রচুর লোকসান গোণা হয়েছে এ খাতে, আর নয়। পাট ও পাটকল মহাকাব্যের বিয়োগান্তক সমাপ্তি ঘটে গত ২ জুলাই। ৩০ জুন উল্লেখ করে পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু কেন এমন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর কি রাষ্ট্র দিতে পারে দেশবাসীর কাছে? পাটশিল্পের চাহিদা কমে গেছে? নাকি আমরা অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির থাবায় ধ্বংস করেছি নিজেদের এই সোনালী শিল্পকে। প্রশ্ন রেখে গেলাম? শুধু প্রশ্ন রাখাই সমাধান নয়, তাই বলতে চাই সুষ্ঠু, সুন্দর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে আবারও সোনালী আঁশ থেকে আমরা সোনার মুদ্রা অর্জন করতে চাই। আধুনিক বিশ্বের বৈচিত্র্য চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এ শিল্পকে ঢেলে সাজিয়ে সুদিন ফেরানো হোক সোনালী আঁশের। সে প্রত্যাশা জাগ্রত থাক আমাদের মনে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২০
নিউজ ডেস্ক