আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও নিশ্চিতকরণে অপরাধ ও অপরাধীদের বিচারের বা আইনের মুখোমুখি জরুরি ও অনিবার্য। অপরাধী যখন জানে-বোঝে অন্যায় করে পার পাওয়া যায় না, তখন অপরাধের আগে একবারের জন্যেও হলে অপরাধী সম্ভাব্য পরিনাম ভাবনায় মাতে।
একাত্তরের যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে আজ পুরো বাংলাদেশ জেগে উঠৈছে আবার। গণদাবির প্রেক্ষাপটে পালের গোদা ক’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ও তাদের শুভানুধ্যায়ী’ রাজনৈতিক মহল ট্রাইব্যুন্যালের বৈধতা, স্বচ্ছতা ও মান নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলে ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত। যদিও তদন্ত ও নথিপত্রের বিশ্লেষণ শেষে ট্রাইব্যুনাল মামলার কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আদৌ কি কোনো আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? কিংবা সুযোগ ? দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধীদের সুদীর্ঘ দিন পরে হলেও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশীতিপর বৃদ্ধ অপরাধীদের এখনো খোঁজা হচ্ছে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্যে। এইসব যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা ও বিচারের মাপকাঠি ও পরিমণ্ডল ঠিকঠাক করে দিয়েছে জাতিসংঘ কিংবা জাতিসংঘ স্বীকৃত কোনো সংস্থা। এইসব বিচারের জন্যে গৃহীত হয়েছে জাতিসংঘের সর্বসম্মত রেজ্যুলেশন বা প্রস্তাব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।
একাত্তরে পাক হানাদাররা যখন পাখির মতো নিরীহ মানুষ হত্যার উল্লাসে মেতেছিল তখন বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মঞ্চস্থ হচ্ছিল অন্য নাটক। ভেটো দেবার অধিকারী দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় রাজনীতির প্ররোচনায় ও আন্তর্জাতিক ‘কোল্ড ওয়ারের’ মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘে কোনো প্রস্তাব পাস হতে দেয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে ও খোদ জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণহত্যা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল এবং দুনিয়া জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয় ছিল কোল্ড ওয়ার যুগের অন্য পরাশক্তি রাশিয়া। আর বাংলাদেশের সার্বিক মিত্রের ভূমিকায় ছিল পাকিস্তানের শত্রু প্রতিবেশী এবং পরাশক্তি রাশিয়ার সামরিক-রাজনৈতিক মিত্র ভারত। বিশ্ব রাজনীতির দাবার ঘুঁটিতে চাপা পড়ে যায় দুনিয়ার ঘৃণ্যতম এই জেনোসাইড। ফলে, জাতিসংঘের মতো সর্বজনগ্রাহ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সর্বসম্মত নিন্দা প্রস্তাব বা যুদ্ধাপরাধের বিচারের সিদ্ধান্ত হয়নি। জাতিসংঘের একটা সিদ্ধান্ত এসেছিল একাত্তরের শেষ দিকে কিংবা বাহাত্তরের প্রথম দিকে ভারতে আটক পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত নিতে। সেই প্রস্তাবে যুদ্ধাপরাধীদের দেশি সহযোগী রাজাকার-আল বদরদের বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না। ছিল কেবল পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রত্যাবর্তন ও জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের বিচার ও অধিকার। স্বদেশি রাজাকার রা জেনেভা কনভেনশনের আওতাধীন হয়নি, হবার কথাও ছিল না। স্বদেশি রাজাকার রা আইনের মানদণ্ডে ছিঁচকে বা দাগী স্বদেশি অপরাধী মাত্র।
স্বাভাবিক নিয়মেই যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দেশি সহযোগীদের বিচার দেশের প্রচলিত আইনেই হবার কথা। প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছিল। শীর্ষ স্হানীয় অপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল। কারারুদ্ধ হয়েছিল কুখ্যাত ও চিহ্নিতরা। অনেকের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণ। যুদ্ধবিধস্ত দেশ নির্মাণের স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্য নির্মাণের পরিণামদর্শী ভাবনায় জাতিক জনক বঙ্গবন্ধু সামান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনেছিলেন। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখল ও পাল্টা দখলের ঘৃণ্য রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীরা বিনা ঘোষণায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যেতে থাকে রাজনৈতিক বিবেচনায়। মামলাগুলো বাতিল কিংবা ঝুলে যেতে থাকে। যুদ্ধাপরাধী অপশক্তি সরকারি গেজেট নোটিফিকেশনের ভুল ব্যাখ্যায় রাজনীতির মাঠে নেমে পড়ে। জনগণ ভাবে, সবই সাধারণ ক্ষমতার আওতায় হয়েছে। কিন্তু সাধারণ ক্ষমার সকল ঘোষণায় বলা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে এখন অব্দি কোনো মামলা রুজু হয়নি কেবল তারাই এই ঘোষণার/ক্ষমার আওতাধীন হবে। সেই ক্ষমা ঘোষণার অপব্যাখ্যায় ছিঁচকে অপরাধীদের পাশাপাশি বাঘা বাঘা যুদ্ধাপরাধীরা খালাস পেয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে। সরাসরি সামরিক কমব্যাটে জড়িতরাই এই কনভেনশনের আওতাধীন হয়। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী রাজকার আল বদরেরা ছিল দুর্বৃত্ত। সন্ত্রাসী। লুটেরা। খুনি। এদের বিচারে, আইনের মুখোমুখিকরণে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তা থাকে না। নেইও। তবুও সরকার কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এমনটা করেছেন জানি না। হয়তো বিশ্বকে ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিতে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। কিন্তু চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। সরকারি উদারতার সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বৈধতার পাশাপাশি এর গুণগত মানের প্রশ্ন তোলে বারবার। গরুকে জিজ্ঞেস করে, কি হাল চাষ করা হয়?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধীরা একটা ‘আপার হ্যান্ড’ পাচ্ছে কারণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যাবলী এখন অব্দি কার্যকর প্রমাণ হিসেবে আদালতে গৃহীত হয় না। যদি আইনটিকে যুগোপযোগী করা হতো তাহলে এই খুনিদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণে তদন্তের পর তদন্তের প্রয়োজন হতো না। একাত্তরে প্রকাশিত তথ্যাদিই যথেষ্ট বিবেচিত হতো।
পালের গোদা যে ক’জন গ্রেফতার হয়েছে তাদের প্রচলিত আইনের অধীনে বিশেষ আদালত কিংবা দ্রুত বিচার আদালত গঠন করে সাজা দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তনশীল। যত দেরি হবে, ততোই বিচারের নিশ্চয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একাত্তর যারা দেখেছি, তারা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সিম্পলি ঝুলিয়ে দিলেই চলে।
ইমেলঃ [email protected]