জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখবো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ থাকাকালে বা তাঁর অবর্তমানে জাতীয় চার নেতা-সর্বজনশ্রদ্ধেয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান-বারবার জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় সমগ্র বিশ্বে যে কারাগারকে মনে করা হয় সবচেয়ে নিরাপদ স্থান সেই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়; তার পর থেকে জাতীয় চার নেতা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অপূর্ব দক্ষতার সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার পরিচালনা করেন ও বিজয়ের লালসূর্যটি ছিনিয়ে আনেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই ২৯ মার্চ রওনা করে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আমাদের আগেই সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং ১ এপ্রিল ভারতে পৌঁছান। পরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিল্লী গমন করেন এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ’৬৯-এর অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু লন্ডন যান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারত সরকারের ভূমিকা নিয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা শ্রীফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর-মিস্টার নাথ-সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ’৭১-এর শুরুতেই বঙ্গবন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন আমরা কোথায় গেলে সাহায্য পাবো। ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের চারজনকে-শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে-বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠালেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে। সেখানে জাতীয় চার নেতাও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেন, ‘পড়ো, মুখস্থ করো। ’ আমরা মুখস্থ করলাম একটি ঠিকানা, ‘সানি ভিলা, ২১, রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। ’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখানেই হবে তোমাদের জায়গা। ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। আমি নিশ্চিত ওরা আক্রমণ করবে। আক্রান্ত হলে এটাই হবে তোমাদের ঠিকানা। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করবে। ’
জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারকে তিনি আগেই কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডাক্তার আবু হেনাকে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন। সেই পথেই ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব, মণি ভাই এবং আমাকে আবু হেনা সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা ৪ এপ্রিল কলকাতা পৌঁছে রাজেন্দ্র রোডের সানি ভিলায় অবস্থান করি। আর ৮ নং থিয়েটার রোডে অবস্থান করতেন জাতীয় চার নেতা। কলকাতায় মুজিব বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে থাকার সুবাদে নেতৃবৃন্দের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে ’৭১-এর ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ-রাষ্ট্রপতি তথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তাজউদ্দীন আহমদ। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী হন।
১৭ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ দূরদর্শীতার সাথে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সকলের সাথে পরামর্শ করে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। আমরা চারজন মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে বর্ডারে বর্ডারে ঘুরেছি, রণাঙ্গনে ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছি। একসঙ্গে কাজ করেছি। আমার ক্যাম্প ছিল ব্যারাকপুর, মণি ভাই’র আগরতলা, সিরাজ ভাই’র শিলিগুড়ি, আর রাজ্জাক ভাই’র মেঘালয়। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল ।
মেজার জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে দেরাদুনে ছিল আমাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা দুর্গাপ্রসাদ ধর তথা ডিপি ধর আমাদের কাজের সমন্বয় করতেন। এছাড়াও সমন্বয়ক হিসেবে ছিলেন মেজর জেনারেল সরকার। এই দুজনসহ শ্রীফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জী তথা মিস্টার নাথ-এই তিনজন আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। সশ্রস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে মুজিব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ গ্রহণ করাতাম এই বলে যে, ‘প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতক্ষণ তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশেকে আমরা হানাদার মুক্ত করতে না পারবো, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না। ’ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আমরা মেঝেতে শয্যা পেতেছি। নিজদের মধ্যে খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছি। পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছি। জাতীয় চার নেতা নিজদের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করেছেন। তাজউদ্দীন ভাই নিজের কাপড় নিজে ধুতেন। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না। জাতীয় নেতৃবৃন্দের সে-সব ত্যাগ-তিতিক্ষা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
দেশ স্বাধীনের পর ’৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে আমি এবং রাজ্জাক ভাই বিজয়ীর বেশে প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করি। ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার ফিরে এলে জাতীয় চার নেতাকে আমরা বীরোচিত সংবর্ধনা জানাই। আর ৯ মাস ১৪ দিন কারারুদ্ধ থাকার পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ের পরিপূর্ণতায় জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি। পরদিন ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা বিষয়ে সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং; সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী; তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী; ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যোগাযোগ মন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হবার। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকেছি শেষদিন পর্যন্ত।
ছাত্র জীবন থেকে জাতীয় চার নেতাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি। তাঁদের আদর-স্নেহ পেয়েছি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেদিন জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, আমরা সেদিন নিঃস্ব হয়েছি। যাঁর জন্ম না হলে এ দেশ স্বাধীন হতো না, তাঁকে বাংলার মাটিতে এভাবে জীবন দিতে হবে এটা কেউ কখনো ভাবেনি। খুনিরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ যেন কোনদিন রাষ্ট্রপরিচালনায় না আসতে পারে। সে জন্য তারা শিশু রাসেলকে প্রাণভিক্ষা দেয়নি। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীচক্র দেশকে নেতৃত্ব শূন্য করতে প্রথমে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে এবং পরে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তখন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে অবস্থান করছিলেন। দেশে থাকলে তাদেরও হত্যা করা হতো। ’৮১-এর ১৭ মে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দেশে ফিরে রক্তে ভেজা আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং এই কালপর্বে খুনিচক্র থেমে থাকেনি। তাকে সর্বমোট ২১ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর জাতীয় চার নেতাসহ আমরা ছিলাম গৃহবন্দী। খুনিচক্রের হোতা মোশতাক জাতীয় নেতা মনসুর আলীকে বঙ্গভবনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৫ আগস্টের পরদিন খুনিরা আমার বাসভবন থেকে আমাকে তুলে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। ২৩ আগস্ট পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি জনাব ই এ চৌধুরীর মাধ্যমে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধেয় নেতা জিল্লুর রহমান এবং আমাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। সেখানে খুনি মোশতাক আমাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে নানারকম প্রস্তাব দিলে আমরা খুনির সে-সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। আগস্টের ২২ তারিখ জাতীয় চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল হত্যা করার জন্য। ঘাতকের দল শেষ পর্যন্ত হত্যা করেনি। পরে নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। গৃহবন্দী অবস্থা থেকে একই দিনে আমাকে, জিল্লুর রহমান ও আবদুর রাজ্জাককে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ৬ দিন বন্দী রেখে আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে খুনিচক্র আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে চোখ ও হাত-পা চেয়ারের সাথে বেঁধে নির্যাতন করে। পরে অর্ধমৃত অবস্থায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রেখে আসে। সিটি এসপি আবদুস সালাম ডাক্তার এনে আমার চিকিৎসা করান। পরে জিল্লুর রহমান ও প্রিয়নেতা রাজ্জাক ভাইকে কুমিল্লা কারাগারে আর আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে প্রেরণ করে। যেদিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়, সেদিন আমি ময়মনসিংহ কারাগারে কনডেম সেলে-ফাঁসির আসামীকে যেখানে রাখা হয়-বন্দী। তখন আমাদের দুঃসহ জীবন! সহকারাবন্দী ছিলেন ‘দি পিপল’ পত্রিকার এডিটর জনাব আবিদুর রহমান-যিনি ইতিমধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। ময়মনসিংহ কারাগারের জেল সুপার ছিলেন শ্রী নির্মলেন্দু রায়। কারাগারে আমরা যারা বন্দী তাদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। বঙ্গবন্ধু যখন বারবার কারাগারে বন্দী ছিলেন, নির্মলেন্দু রায় তখন কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু তাকে খুব স্নেহ করতেন। সেদিন গভীর রাতে নির্মলেন্দু রায় আমার সেলে এসে বলেন, ‘ঢাকা কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা কারাগারের চতুর্দিক পুলিশ দ্বারা বেষ্টন করে রেখেছি, জেল পুলিশ ঘিরে রেখেছে। এসপি সাহেব এসেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে। ’ এসপি এমআর ফারুক আমাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, আমি বলেছিলাম, এভাবে তো যাওয়ার নিয়ম নেই। আমি এখান থেকে যাব না। জাতীয় চার নেতা হত্যাকা-ের দুঃসংবাদটি শুনে মন বেদনাভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতীয় চার নেতার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে কতো অবদান! বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেওয়ার পর মার্চের ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখ হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম সহসভাপতি, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অন্যতম সহসভাপতি এবং এএইচএম কামারুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আমরা ’৬৬-এর ৭ জুন হরতাল পালন করি। হরতাল পালন শেষে এক বিশাল জনসভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৬ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সুন্দর বক্তৃতা করেন। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তাজউদ্দীন আহমদ দক্ষ সংগঠক। কামারুজ্জামান সাহেব এমএনএ হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী তুলে ধরতেন। ’৬৮তে কারাগারে থাকা অবস্থায় তাজউদ্দীন ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনঃনির্বাচিত হন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে বন্দী ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখন দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মরহুম আহমেদুল কবীরের বাসভবনে উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব সংক্ষেপে উঅঈ-এর সভা চলছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আমি যখন ১১ দফা কর্মসূচী ব্যাখ্যা করছি তখন ন্যাপ নেতা মাহমুদুল হক কাসুরি ১১ দফা কর্মসূচী সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘তোমরা ১১ দফা কর্মসূচীতে শেখ মুজিবের ৬ দফা হুবহু যুক্ত করেছো। সুতরাং, তোমাদের ১১ দফা সমর্থনে প্রশ্ন আসবে। ’ তার এই বক্তব্যের পর বলেছিলাম, আমরা বাঙালীরা কিভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় তা জানি। আপনারা সমর্থন না করলেও এই ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রিয়নেতা শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্ত করবো। এই কথার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমায় বুকে টেনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তোমাদের পাশে থাকবে। ’ ’৭০-এর নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কামারুজ্জামান সাহেব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আমিও মাত্র ২৭ বছর বয়সে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে কে কোন পদে পদায়িত হবেন বঙ্গবন্ধু তা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।
’৭১-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু নিজে জাতীয় পরিষদ নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা, তাজউদ্দীন আহমদ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা এবং কামারুজ্জামান সাহেব সচিব; চীফ হুইপ পদে জনাব ইউসুফ আলী এবং হুইপ পদে যথাক্রমে জনাব আবদুল মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম নির্বাচিত হন। আর প্রাদেশিক পরিষদে নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে মনসুর আলী হবেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। এ জন্য মনসুর আলী সাহেবকে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সেট-আপ করা ছিল। কিন্তু ’৭১-এর ১ মার্চ পূর্বঘোষিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক একতরফাভাবে স্থগিত হলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় সর্বব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন। সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণার পর অসহযোগ সর্বাত্মক রূফ লাভ করে। বিশ্বে এমন অসহযোগ কখনো দেখেনি কেউ! বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড অসহযোগের প্রতিটি দিন সুচারুরূপে পরিচালনা করেছেন।
বছর ঘুরে যখন ‘জেলহত্যা দিবস’ ফিরে আসে তখন আমার জীবনের কিছু ঘটনা আমাকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। ’৭৫-এর ১১ জুলাই আমার বড়ো ভাইয়ের মৃত্যু হয়। ১৫ আগস্টের পর আমি তখন ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী। একদিন হঠাৎ আমার পরিবার-আমার স্ত্রী ও ৭ বছর বয়সী মেয়ে তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে-সাক্ষাৎ করতে আসে। ওইদিন খবর পাই, আমাদের বাড়ির কাছে যে বাজার আছে, সেই বাজারে আমার সেজো ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ-সম্প্রতি মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে-সে ভোলায় গিয়ে তাকে হত্যা করার ব্যবস্থা করেছিল। আমার মা তখন জীবিত। তিন ছেলের একজন জেলে, আর দু’ছেলে বেঁচে নেই। মায়ের সেই করুণ দিনগুলির কথা মনে পড়ে, আবেগাপ্লুত হই-খুউব খারাপ লাগে। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাকে ৭ বার কারানির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। আমার বৃদ্ধা মা আমাকে একনজর দেখতে ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল কারাগারে গিয়েছেন। আমার মাথায় হাত রেখে মুখের দিকে তাকিয়ে দোয়া করেছেন আর নীরবে চোখের পানি ফেলেছেন। কি কষ্ট করেই না মা কারাগারে আমাকে দেখতে যেতেন। কারারুদ্ধ থাকাকালে অপরিসীম কষ্ট করেছেন আমার স্ত্রী। আমার স্ত্রীর নামে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায়নি। যখনই শুনেছে তোফায়েল আহমেদের স্ত্রী, তখনই বলেছে, ‘না, বাড়ি ভাড়া দেওয়া সম্ভব হবে না। ’
কলাবাগানে আমার ভাগ্নি জামাইয়ের নামে গোপনে বাড়ি ভাড়া করে আমার স্ত্রী সেখানে দেড় বছর কাটিয়েছেন। আমরা যারা কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছি আমাদের চেয়েও কষ্ট করেছেন পরিবারের স্বজনেরা। যারা কারাবন্দী থাকেন তাদের পরিবার-পরিজন যে কী কঠিন কষ্টে দিনাতিপাত করেন তা বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুটোর পাতায় পাতায় আবেগমথিত ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। আমার ছোট্ট মেয়েটি যখন জেলখানায় আমাকে দেখতে যেতো, তখন সে বারবার জিজ্ঞেস করতো, ‘আব্বু তুমি কবে বাড়ি যাবে। ’ সে আমার সাথে থাকতে চাইতো। কারণ সে-তো বুঝতো না। আমি তার উত্তর দিতে পারতাম না। আমাকে কখনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়নি। ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, রাজশাহী, কাশিমপুর আবার কুষ্টিয়া কারগারে আটক রেখেছে। বন্দীজীবনে অনেক কষ্ট করেছি। তবুও বেঁচে আছি। কিন্তু যারা বেঁচে থাকলে জাতি উপকৃত হতো সেই জাতীয় নেতাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। যা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে।
ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। বঙ্গবন্ধুর দুটি স্বপ্ন ছিল, একটি স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বাধীনতার স্বপ্ন তিনি পুরণ করেছেন। স্বপ্নের বাংলাদেশকে তিনি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আমার দৃঢ়বিশ^াস, জেলহত্যা দিবসের শোককে শক্তিতে পরিণত করে জাতির জনক ও জাতীয় চার নেতার আরাধ্য স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অচিরেই আমরা দেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবো।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ