বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠনগুলো এখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। এবং তাও করছে বর্তমান সরকারের অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে! খুব স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র আন্দোলনকারী এ সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক শক্তি অতোটা ব্যাপক কিংবা বিস্তৃত নয় সারা দেশব্যাপী।
কারণ, ওই সংগঠনগুলোতে নেই কাচা অর্থের হাতছানি। কিংবা পাইপ দিয়ে আঘাত করে কিংবা পিস্তল উঁচিয়ে ছাত্র হত্যার অভিযোগ। ওই সংগঠনগুলোর ছাত্রনেতাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উত্তীর্ণ হতে হয়। তাইতো, এ সংগঠনগুলোর একটা ন্যূনতম দায়বোধ বর্তায়। আর এ দায়বোধ থেকেই শুরু হয়েছে আন্দোলন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র নিহত হয়েছেন। জোবায়ের নামের ওই ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্ররা জোটবদ্ধ হয়েছেন। বলতে গেলে শিক্ষার অধিকার কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার নিয়ে যেসব ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলন-সংগ্রাম করে সেসব সংগঠনের ছায়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে লাগাতার আন্দোলন।
নির্বাচনী ধারায় যে ক’বার ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে প্রধান যে দুটো দল, তা ঘুরে ফিরে ওই আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপিই। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতায় আসার পর দলগুলোর নেতা-পাতি নেতারা শক্তিমান হয়ে ওঠেন। ব্যবসায়-বাণিজ্যে তারা ফুলে-ফেপে ওঠেন।
আর ওই ধারায়ই এই একটা শ্রেণী যেন বেপরোয়া হয়ে উঠে। ছাত্রত্বের নাম নিয়ে দুটো পার্টি’রই ছাত্র, এমনকি ছাত্রীরাও যেন উন্মাদ হয়ে যান ক্ষমতার ছোঁয়া পেয়ে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইডেন কলেজে যা সংঘটিত হয়েছিলো তা কি কোনো সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক? কিভাবে লীগধারী ছাত্রীরা তাদের বিগ বসদের দ্বারা ব্যবহৃত হতেন, এবং জোর করে ব্যবহার করাতেন অন্য ছাত্রীদের ওই বসদের আনন্দ-ফুর্তির জন্যে, তা নতুন করে বলার হয়তো প্রয়োজন নেই। কিন্তু পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক নয়।
কারণ, সাতক্ষীরায় জেলা ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে সেই জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক একজন নৃত্যশিল্পীকে নিয়ে যা ঘটিয়েছেন, তাতে আমাদের শুধু মনে করিয়ে দিয়েছে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রলীগ নেতার ফুর্তির সেঞ্চুরি পালনের সেই বিভৎস চিত্রগুলোকে।
এভাবেই একের পর এক বিভৎসতার চিত্র যেন প্রলম্বিত করছেন লীগ নামের ছাত্র-সন্ত্রাসীরা। কি প্রবল-পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছেন তারা! এই লীগ নামধারী ছাত্র-সন্ত্রাসীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন চালায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চলেন তাদের কথায়। জোবায়ের হত্যার পর যেখানে হাজার হাজার ছাত্র ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের লীগ নামধারী ছাত্রদের দায়ী করছেন, সেখানে ভিসি ছাত্রলীগের মাঝে পবিত্রতার গন্ধ পান! কি এক অদ্ভুত দলীয় ধান্ধায় যেন এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন অন্ধ হয়ে গেছে! একটা প্রাণের নির্মম খসে যাওয়ায়ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান (ভিসি) খুব একটা ভাবনায় পড়েন না!
লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার সঙ্গে আলাপকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষাকে ব্যবসার উপাদান কিংবা পণ্য হিসেবে হিসেবে ব্যবহৃত হতে না দিতে দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা আবারও উল্লেখ করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চাইছেন। এবং ইতিমধ্যে শিক্ষায় এসেছেও যুগান্তকারী পরিবর্তন।
কিন্তু এই পরিবর্তনের সময়ে মনিপুর স্কুলের চিত্র হলো অন্য রকম। এলাকার সাংসদ আওয়ামী লীগের সাংসদ কিংবা তার বশংবদরা ওই শিক্ষালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের কাছ থকে উপার্জন করেন লাখো-কোটি টাকা। স্কুলের কিশোর ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক সময় প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু মওকা পেলে তারাই আবার রাস্তায় আসে। তাইতো সাংসদ কামালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিলেন ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবকরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই একই অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যতোই চাটুকার শিক্ষক কিংবা গুণ্ডা ছাত্রনেতাদের পোষা হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কি রুখা যায়? তাইতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রজোট কিছুটা হলেও ছিনিয়ে এনেছে অধিকার। অথচ সেখানেও আমরা দেখেছি, লীগ নামধারী ছাত্র-সন্ত্রাসী আর লীগের তল্পীবাহক শিক্ষকদের কি নির্মম গুণ্ডামি।
কি অদ্ভুত দেশ আমাদের, যেখানে ভিকারুন নিসার শিক্ষক পরিমলের মতো শিক্ষকরা ছাত্রী নির্যাতন করেন, তাও কলেজের প্রধান তার পক্ষ নেন! বিশ্ববিদ্যালয়ে জোবায়ের নিহত হন, তাও ভিসি’র কোনো করুণা পান না! ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও বলেন, জোবায়ের তাদের কর্মী নন। আবার একইভাবে তারাই আবার বলেন, এ হত্যার দায় ছাত্রলীগের নয়!
অথচ সাধারণ ছাত্র, আন্দোলনকারী ছাত্র সবাই জানেন, এ দায় কার? হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কারা? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেনের আসনের অধিকার নিয়ে লড়াই করছেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। সেখানে গত তিন বছরে তারা নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মেতে উঠেছেন অন্তত ৪৪ বার। চবি’র এই দ্বন্দ্বের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সভাপতি-সম্পাদক বলছেন, তদন্ত চলছে!
শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, শিক্ষালয়গুলো সন্ত্রাসমুক্ত করতে হবে, যে কোনো ভাবেই হোক শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু ফিরে আসছে না। তাই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, কি এমন শক্তি যেখানে শিক্ষামন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে?
বলা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই এ সরকারের সবচেয়ে সফল মন্ত্রণালয়। অথচ এই মন্ত্রণালয়ের অধীন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুলগুলোতে চালানো হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বাণিজ্য, ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি। আমাদেরতো মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অসামান্য সাফল্যকে সরকারেরই কিংবা আওয়ামী লীগেরই একটা গ্রুপ ভালো চোখে দেখে না। তাইতো শিক্ষালয়গুলোতে চলছে নৈরাজ্য।
আর তা না হলে মনিপুরের ঘটনার পর শিক্ষামন্ত্রী কেনই বা বলেন, অনেক কিছুতেই আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে? প্রধানমন্ত্রী যে কোনো কিছু করতে পারেন। তিনি একবার গোস্বা করে ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে সরে গিয়ে কি তিনি দেশের অভিভাবকের পদটি ছাড়তে পেরেছিলেন? না পারেননি।
একটা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তিনি এসেছিলেন এবং তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী। সে হিসেবে দেশটির অভিভাবকত্ব তার ওপরই বর্তায়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠগুলোর ছাত্র-শিক্ষক তার কিংবা তার দলের নাম নিয়ে টেন্ডারবাজি করবে, তার দলের ছাত্রদেরকেই খুন করবেন, শ্লীলতাহানি করবেন অথচ তিনি অভিভাবকত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন, তাতো হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঠিকই তো লীগ নামধারীরা উচ্চাসনে বসে আছেন। মানুষ গড়ার অঙ্গীকারকারীরা মানুষ না গড়ে ছাত্র খুনের ঘটনাকে পাত্তা না দিয়ে গদি আঁকড়ে ধরা আর লাখো-কোটি টাকা কামাই করছেন। আর এরকম কর্মতৎপরতায় যখন লেগে থাকেন পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী আমাদের উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকরা, তখন বাংলাদেশ নামক দেশটার শিক্ষা ব্যবস্থাকে পণ্য না ভাবলেও শিক্ষকদের ভাবতে হয় অন্য কিছু।
কারণ, তারা এই শিক্ষা কিংবা শিক্ষালয়গুলোকেই বানিয়ে নিয়েছেন তাদের বৈভব বানানোর তীর্থস্থান হিসেবে।
কতিপয় শিক্ষক আর লীগ নামধারী ছাত্রদের এই হত্যা-ধর্ষণ কিংবা টেন্ডার-বাণিজ্য-সন্ত্রাসকে কেন্দ্র করে এমন এক অবস্থানে গিয়ে পৌঁছেছে শিক্ষা, যেখানে শিক্ষা আন্দোলনটাই যেন প্রশ্নবোধক হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কারণ, ছাত্র আন্দোলন মানে যেন এখন সন্ত্রাস কিংবা জ্বালাও-পোড়াও, ছাত্র নেতা মানে জ্বলন্ত এক অগ্নিপিণ্ড, যেখান থেকে শুধু বের হয় অস্ত্রের আগুন, হত্যার দিক নির্দেশনা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাতক্ষীরার ছাত্রলীগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি জেলা-উপজেলার বিভিন্ন কলেজগুলো নিয়ে রিপোর্ট উঠছে প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়। অন্তর্দ্বন্দ্ব, খুন-কোনো খবরই সুখকর নয়। প্রত্যেকটা খবরই যেন ছাত্র আন্দোলনকে করে তুলছে প্রশ্নবিদ্ধ।
ব্লগে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কমেন্টগুলো আমাদের আরও হতাশ করছে। তারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলছেন। তাদের এ দাবির যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু ব্লগার তরুণ-তরুণীরা শুধুমাত্র রাজনীতির একটি পিঠ দেখছেন। তারা দেখছেন, ছাত্রলীগ নামধারীদের সন্ত্রাস আর বিভৎসতার চিত্র। আর সেই চিত্র দেখেই মনে করছেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হয়ে গেলেই সব কিছু ঠিক-ঠাক হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষালয়গুলো চলবে শান্তির মধ্যে দিয়ে। স্বস্তি আসবে।
কিন্তু আদৌ কি তাই? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে না-কি ছাত্রলীগ তাদের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছিলো। কিন্তু থেমেছে কি তাদের কালো হাত? বরং এটা অন্ধকারে আরও বিস্তৃত হয়েছে। কারণ, বাণিজ্য থামেনি। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা থামেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে হল নিয়ন্ত্রণ, দোকান নিয়ন্ত্রণ এগুলোতো চলছেই। এগুলো চলবেও।
অর্থাৎ বাণিজ্য বন্ধ হয় না। আর সেজন্যে নামের রাজনীতি বন্ধ হলেও কাজের রাজনীতি (নিয়ন্ত্রণ) বন্ধ হয় না। উপরের আশির্বাদ সব সময় এদের সঙ্গী থাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, আজ যেখানেই চলছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন, সেখানেই কেউ না কেউ, কোনো না কোনো সংগঠন সে আন্দোলন দাঁড় করাচ্ছে, জমায়েত করছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের। এই দাঁড় করানোটাই শিক্ষার অধিকারের লড়াই।
ছাত্র আন্দোলন মানেই শিক্ষার আন্দোলন, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। সে হিসেবে একটা ছায়া থাকতে হবে ছাত্রদের। সে ছায়া সুস্থতার। সন্ত্রাসের নয়। সন্ত্রাসকে ঘৃণা করেই ওই সব ‘লীগ-দল-শিবির’ সন্ত্রাসীদের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে শিক্ষালয়গুলো। একটা সুস্থ সাংগঠনিক ভিতের প্রয়োজন তাই অস্বীকার করা যায় না। যেমন তা আমরা অস্বীকার করতে পারিনি ’৫২ থেকে শুরু করে একাত্তুর কিংবা স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলনেও।
আর সেজন্যেই সুস্থ ধারার ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনও ফুরাবে না কোনো কালেই।
ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
Faruk,[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১১২৬ ঘন্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১২