ঢাকা, রবিবার, ৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ জুন ২০২৪, ১৫ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

নরসিংদী নির্বাচন: ভোটারদের ক্ষোভের প্রকাশ

আ হ ম ফয়সল, মুক্ত সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১২
নরসিংদী নির্বাচন: ভোটারদের ক্ষোভের প্রকাশ

নির্বাচন এলেই যেন ডাক পড়ে দেখতে যাবার। সেটা জাতীয় হোক আর স্থানীয় হোক।

সময় সুযোগ পেলে সঙ্গী হতেও আপত্তি থাকে না। ১৯ জানুয়ারি ২০১২ নরসিংদী পৌরসভার উপ-নির্বাচন হবে। যেতেও হবে নরসিংদী। এজন্য আগের দিন কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততাকে চাপা রাখি। বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ-বামাসপ এর হয়ে নিজেরসহ পাঁচ জনের পর্যবেক্ষণ পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ফরম পূরণ, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, এসএসসি সার্টিফিকেটের ফটোকপি ও ছবি একত্রিকরণের ভোগান্তি শেষ করে গেলাম শেরে বাংলা নগরস্থ নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে। নরসিংদী যাবার ভোগান্তি শুরু হয়তোবা এখান থেকেই। পদে পদেই ছিল ভোগান্তি। ধরেই নিয়েছি ভোগান্তি থেকেই শেখা এবং তা থেকেই প্রতিমুহূর্ত শিখছি।

নির্বাচন কমিশন থেকে পর্যবেক্ষণ আইডি কার্ড সংগ্রহের ঝক্কি-ঝামেলা শেষ করে পরদিন ১৯ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টায় বামাসপ প্রেসিডেন্ট এএইচএম নোমানের নেতৃত্বে নরসিংদী পৌরসভার উপ-নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য রওনা করি। সাথে ছিলেন বামাসপ সহ-সভাপতি ড. গোলাম রহমান ভূইয়া। উত্তরা হয়ে কালীগঞ্জের খানা-খন্দের সড়ক দিয়ে ড্রাইভার মোতাছিন মাইক্রোবাসে করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। নরসিংদী শহরে প্রবেশ করতেই একটি ভোট কেন্দ্র চোখে পড়ল। সালিদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এটি। এখানে পুরুষ ও মহিলা ভোট কেন্দ্র রয়েছে। মহিলা ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. শাহজাদা খসরু আমাদের তার কেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখালেন। ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার সহজতম প্রক্রিয়াটি তুলে ধরলেন আমাদের কাছে।

এই কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে যাবার পথে মুর্শিদা নামে এক ভোটারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ভোট দিতে কোন অসুবিধা হয়েছে, কেমন লেগেছে? এক কথায় তার উত্তর, ‘খুব ভালো’। কেন্দ্রের প্রতিটি বুথে ২টি করে সিসিটিভি ক্যামেরা ল্যাপটপে চালু রয়েছে। যা ইভিএম এর পাশাপাশি নিরাপত্তার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কেন্দ্রের বাইরে এসে পরিচয় হলো নির্বাচন কমিশনের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট ইকবাল জাহিদ ও হারুণ অর রশিদের সাথে। তারা জানালেন নরসিংদী নির্বাচনে ৭০ জন টেকনিক্যাল এক্সপার্টের অংশগ্রহণে প্রায় ৪৫০টি ল্যাপটপ ব্যবহার হচ্ছে। প্রতিটি বুথের কর্মকান্ড রেকডিং এর জন্য এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভোটারদের মধ্যে আশ্বস্ততা তৈরি করতে কাজে লাগবে। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন প্রকল্প থেকে এনে এই ল্যাপটপ ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ ভাবে আমরা বাসাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ব্রাক্ষ্মন্দী কে কে এম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, বৌয়াকুড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বৌয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করি। ভোটারদের মধ্যে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট প্রদানের অভিজ্ঞতা না থাকলেও ভোট দেয়ার পর তাদের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্ততা দেখা গেছে। নির্বাচনী এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তব্যরত র‌্যাব, পুলিশ, আনসার সদস্যদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। নরসিংদী পৌরসভার উপ-নির্বাচনের সংবাদ সরাসরি প্রচার করার জন্য অধিকাংশ বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো তাদের প্রচারযন্ত্র নিয়ে নরসিংদী হাজির হয়েছিল। যা সত্যিকার অর্থে এই নির্বাচনের গুরুত্ব আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিল।

কেন্দ্র পরিদর্শনের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে আমাদের পর্যবেক্ষক দলের প্রধান এএইচএম নোমানকে সরাসরি সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে। এ ধরনের একটি সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের কর্মকর্তারা ফোন করে জানালেন নির্ধারিত কেন্দ্রে যাবার জন্য। সংবাদ শুরু হয়ে যাবে, দ্রুত পৌঁছাতে হবে, গাড়িতে করে কেন্দ্র খোঁজার পালা। পথচারী একজনকে জিজ্ঞেস করলে একজন বলে এদিক, আরেকজন বলে ওদিক। পরে এক পথচারীর (ভোটার) নির্দেশনায় কেন্দ্রে গেলাম। যেয়ে দেখি সেই কেন্দ্রে মাছরাঙ্গার কোন সাংবাদিক বা টিভি ক্যামেরা নেই। এই কেন্দ্রে এসেই জানতে পারলাম কেন্দ্রের নাম নিয়ে জটিলতা। নিরাপত্তা কর্মীরা বললেন, অনেকেরই এই ভুল হচ্ছে। আমরা যে কেন্দ্রে গিয়েছি সেটির নাম ‘বৌয়াকুড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’, যেতে হবে ‘বৌয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে’। বৌয়াকুড় আর বৌয়াপুরের বিভ্রাট শেষ করে দ্রুত রওনা দিলাম, পৌঁছালামও। ততক্ষণে সংবাদ শুরু হয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে আমন্ত্রণকারী এই চ্যানেলটি অন্য একটি কেন্দ্রে সাক্ষাকারটি গ্রহণ করে এবং সরাসরি তা প্রচারও করেছে। এরই মধ্যে আমরা মধ্যা‎েহ্নর খাবারও সেরে নেই। আমাদের সাথে এসে যোগ দেন স্থানীয় সংগঠনের কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন। আমাদের অনেক ভোগান্তির মধ্যেও উপভোগ করি গণতন্ত্রের এ অভিযাত্রায় নিজেদের অংশগ্রহণ।

আমরা যখন ঢাকায় রওনা দিই তখন ঘড়িতে ৫টা ছুই-ছুই। নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দিয়ে আসতেই আমাদের গাড়িটি থেমে গেল। সামনে কি পেছনে, আর যেন যাবার সুযোগ নেই। লোকে লোকারণ্য, উচ্ছসিত মানুষের ঢল। স্লোগানে-স্লোগানে মুখর গোটা এলাকা। এ যেন মানুষের বন্যা। যার ভার বহন করতে পারছিল না আমাদের গাড়িটি। হাত নেড়ে, করতালি দিয়ে আমাদেরকে সবাই অভিনন্দিত করছেন। তখন হাজারো মানুষের কন্ঠে বিভিন্ন ধরনের কান ফাটানো স্লোগান- ‘লোকমানের খুনীদের ফাঁসি চাই,’ ‘মন্ত্রী রাজুর জায়গা নাই’ ইত্যাদি-ইত্যাদি। সারাদিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে আমরা দেখলাম ভোটারদের উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। তবে কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের মধ্যে চাপা ভীতি, কোথায় কি ঘটে যায়। এ কারণে ভোটের উৎসবমুখর পরিবেশটি লক্ষ্য করা যায়নি। নির্বাচন চলাকালে নরসিংদী পৌর এলাকাটি আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল ভীতিকর, থমথমে। কিন্তু ভোটাররা নিরাপদে স্বচ্ছন্দে ভোট দিতে পেরেছে। ফলাফলে তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে বলে তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। খুশিতে তারা আত্মহারা। জয়ের আনন্দে নারী-পুরুষ সবাই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে আর তাদের চোখ-মুখের উচ্ছ্বাস বলে দিচ্ছে ‘তারা লোকমান হত্যায় ক্ষুব্ধ, ব্যথিত, তবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী’।

বাংলাদেশ সময় ১০১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১২

ইমেইল: [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।