ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ভারতকে আমি ‘না’ বলছি, আপনি?

শাখাওয়াৎ নয়ন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১২

বিদেশে থাকি আট বছর। দেশে থাকাকালীন একটা পত্রিকা পড়তাম, ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন কয়েকটা পত্রিকা পড়ি।

ফেইসবুকে, ব্লগে চোখ রাখি। কারণ একটাই। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য মনটা কাঁদে। কয়েকদিন হল ইউটিউবের একটি লিংক ফেইসবুকে ভাইরাল ভিডিওতে (যে সব ভিডিও দ্রুততম সময়ে সর্বাধিক প্রদর্শিত হয়) রূপ নিয়েছে। ভিডিওটি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক একজন বাংলাদেশিকে পাশবিক নির্যাতনের।

সাধারনত: সহিংসতা, খুনাখুনি, রক্তারক্তি জাতীয় ভিডিও কিংবা ফটো দেখি না। আমার ভীষণ খারাপ লাগে। সেই খারাপ লাগা কয়েকদিন পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু গতকাল কবি, ঔপন্যাসিক ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টনের ফেইসবুক স্ট্যাটাস পড়ে আমার টনক নড়ল। তারপর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সাংবাদিক জাকিয়া আহমেদের ফেইসবুকে দেখলাম ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান। শেষ পর্যন্ত ছোট ভাই রোমেলের ফেইসবুক থেকে ভিডিওটি দেখলাম। না, পুরো ভিডিওটি দেখতে পারিনি। কিভাবে দেখবো? কোনো সভ্য মানুষ এতটা নীচে নামতে পারে। বাকরুদ্ধ, নির্বাক কেটে গেল অনেকক্ষণ।

এমনিতেই দেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নানা রকম খবরে মনটা বিষিয়ে থাকে। তার ওপরে ভারতীয়দের নানা রকম বৈষম্য, অন্যায়, নব্য উপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, সীমান্তে ইতর প্রাণীর মত বাংলাদেশিদের হত্যা, পুশ ইন-পুশ ব্যাক, ফারাক্কা, তিস্তার পানি ডাকাতি, টিপাইমুখের বাঁধ আরো কত কী। সবদিক থেকেই যেন বাংলাদেশকে হাতের পুতুল এবং বাংলাদেশের মানুষকে পশু গণ্য করা হয়। ইচ্ছে হলেই গুলি করে, মানুষ মেরে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে, মানুষকে নগ্ন করে ভয়ঙ্কর পাশবিক নির্যাতন করে, তালপট্টি দখল করে নেয়াসহ এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যাতে ভারতকে বন্ধু রাষ্ট্র মনে হতে পারে। এত কিছুর পরেও যারা ভারতকে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশি দেশ মনে করার যুক্তি একটাই ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা। ’ তাদের জন্য বলতে চাই, আমরা যেমন স্বাধীনতা চেয়েছি, ভারতও তেমনি পাকিস্তানের বিভক্তি চেয়েছে।

সুতরাং ১৯৭১ সালে উভয়েরই স্বার্থ ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, তারাও কম পায়নি। বিগত ৪০ বছরে ভারত বাংলাদেশের ওপর যেভাবে জেঁকে বসেছে, তাতে ভারত ক্রমবর্ধমানভাবে লাভবান হচ্ছে। দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ভয়াবহ। বাংলাদেশ ভারতের লাভের বাজারে পরিণত হয়েছে। ঔপনিবেশিকতা ছাড়া এতখানি লাভের বাজার পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ।

এত গেল দেশের কথা। অস্ট্রেলিয়াতে বিভিন্ন সময় ভারতীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। বিশেষ করে অধিকাংশ ভারতীয়দের বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা খুবই অদ্ভুত। তারা কেউ মনে করে আমাদের মাতৃভাষা হিন্দি, কেউ মনে করে উর্দু। দেখা হলে হিন্দিতে কথা বলা শুরু করে। ইংরেজিতে উত্তর দিলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, জিজ্ঞেস করে- কেন হিন্দিতে কথা বলছি না? নিজেদেরকে ‘কী জানি কি (!) গণ্য করে। ’ বাংলাদেশিদেরকে তুচ্ছজ্ঞান করার প্রবণতা পাকিস্তানিদের মধ্যেও দেখেছি। কিন্তু এমন হামবরা ভাব অস্ট্রেলিয়ান কিংবা অন্য কোনো জাতির মধ্যে কখনই দেখিনি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে ভারতের প্রতি যতখানি ইতিবাচক হয়েছিলাম, এতসব দেখে দেখে ততখানিই বীতশ্রদ্ধ হয়েছি। কেউ যদি এই লেখা পড়ে আমাকে কোনো রাজনৈতিক দলের লোক মনে করেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমি বিশ্বাস করি, ২০১২ সালের বাংলাদেশে আমার মত লাখো-কোটি তরুণ আছে। তারা কারো দালালী, কারো তাঁবেদারী পছন্দ করে না। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তারা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, ভারত-পাকিস্তান প্রীতি পছন্দ করে না। জঙ্গিবাদের বিনাশ চায়। দুর্নীতিসহ সকল রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরোধী। তারা একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী, প্রযুক্তিতে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায়। নিজের দেশকে নিয়ে তারা স্বপ্ন দেখে। তারা কেউ অবিভক্ত পাকিস্তানে কিংবা বৃটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করেনি। তারা স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী। এই নতুন প্রজন্মের স্বপ্নের ভাষা, প্রত্যাশা আপনাদের বুঝতে হবে। ’
 
নতুন প্রজন্ম মনে করে, নিজের দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সময় এসেছে। বাংলাদেশ এখন আর তৃতীয় বিশ্বের মহাসংকটাপন্ন, ভিখিরির দেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। মাথা পিছু আয় দ্রুত হারে বাড়ছে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য কমছে। তরুণ প্রজন্ম কম্পিউটার প্রশিক্ষিত হচ্ছে। আগামী দশ বছরে বাংলাদেশের প্রধান আয়ের খাত হবে কম্পিউটার প্রশিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের মেধা। আউটসোর্সিং ইতিমধ্যেই ঈর্ষণীয় সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে। ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেই বাংলাদেশ হতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উদাহরণ।
 
সুতরাং প্রতিবাদেরও সময় এসেছে। আমরা ভারতের তুলনায় সামরিক শক্তিতে দুর্বল হতে পারি কিন্তু মানসিক এবং মানবিক শক্তিতে দুর্বল নই। বিগত চল্লিশ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারগুলো ভারতীয় ব্যানার্জী, মুখার্জিদেরকে ‘জ্বি’ বলতে বলতে কিভাবে ‘না’ বলতে হয় তা ভুলে গেছে। ভারতীয়দের ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নেই। যেহেতু সব সরকারই ভারতের কম-বেশি তাঁবেদারি করে কিংবা করতে চায়, তাই যা কিছু করার দেশের সচেতন জনগণকেই করতে হবে। এই মুহুর্তে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে আওয়াজ তোলা হয়েছে, আমাদের সকলেরই তাতে সমর্থন জানানো, অংশগ্রহণ করা নাগরিক এবং নৈতিক দায়িত্ব। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উচিৎ বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয়দের পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক ফোরামে প্রতিবাদ করা। তারা এসব বিষয়ে নীরব কেন? আমি বুঝতে পারছি না।

আমরা হয়তো সকল ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। কিন্তু তাতে কী? আমরা যেভাবে পারি সেভাবেই প্রতিবাদ করব। এই মুহুর্তে অন্যতম উপায় হচ্ছে, ভারতীয় পণ্য বর্জণ করা। এই ব্যবস্থায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা হারাবে। আর তখন ওই ব্যবসায়ীরাই ভারতীয় সরকারকে বোঝাবে, বাংলাদেশীদের সাথে কী আচরণ করা উচিৎ? তিস্তার পানি দিবে কি দিবে না? টিপাইমুখে বাঁধ দিবে কিনা? সীমান্তে মানুষ মেরে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখবে কিনা? এই সভ্যযুগেও একজন মানুষকে উলঙ্গ করে নিষ্ঠুরতম পাশবিক নির্যাতন করবে কিনা?  

প্রিয় পাঠক, আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। এখানে বাংলাদেশ থেকে কোনো চাল আসে না। তাই এতদিন ভারতীয় চাল কিনে খেতাম। আজ আমি ভারতীয় চাল কিনি নাই, থাইল্যান্ডের চাল কিনেছি। আমি সকল ক্ষেত্রেই তাই করবো। আপনি?

বাংলাদেশ সময় : ১৮৫৪ ঘণ্টা, ২৮ ঘণ্টা, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।