অনুজপ্রতিম ফজলুল বারী ‘রাজনৈতিক লাশ’ উপহারদাতা পুলিশের বিচার চেয়েছেন। মেধাবী বারীর সাথে দ্বিমত পোষনেই এই লেখা।
পুলিশ হচ্ছে হুকুমের গোলাম। সরকার বা নীতি নির্ধারকরা সিদ্ধান্ত দেন। পুলিশের উপর মহলে সেই সিদ্ধান্ত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। থিয়োরি অ্যান্ড প্র্যাকটিসের নিয়মে প্র্যাকটিস কখনো কখনো ব্যাকরণের বাইরে যেতে বাধ্য। আমি পুলিশের পক্ষের নই। পুলিশি এই আচরণের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। গণতান্ত্রিক শাসনে পুলিশের হওয়া উচিত জনগণের বন্ধু। স্বৈরাচারী এরশাদ বহু আগেই পতিত। কিন্তু পুলিশের আচরণে, আক্রমণে ও ব্যবহারে স্বৈরাচারী জমানার আলামতই দেখা যাচ্ছে।
অন্য যে কোনও ধরনের রেজিমেন্টেড ট্রেনিংয়ের মতো পুলিশের ট্রেনিংয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে উপরের নির্দেশ মানা শেখানো হয়। সরকার সৎ হলে পুলিশও সৎ হয়। সরকারে জবাবদিহিতা থাকলে পুলিশের চেইন অব কমান্ডে জবাবদিহিতা হঠাৎ এসেই উপস্হিত হয়। সরকার ভিন্নমতের প্রতি উদার দৃষ্টিভংগি নিলে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কখনোই মারমুখি হয়ে ওঠে না। পতিত এরশাদের জমানায় খুব ভোরে রাস্তায় মোতায়েন পুলিশকে সকালের নির্ধারিত নাস্তা দেওয়া হতো মধ্যদুপুরে। অবশ্য তার আগে ক্ষুধার্ত পুলিশকে পাঠনো হতো অ্যাকশনে। শুনি এখনো সেই ‘সংস্কৃতি’ চালু আছে। সবকালে রাজপথের আন্দোলনের পরিকল্পনাকারীরা ‘আন্দোলন গতিবান’ করার স্বার্থে পুলিশকে উস্কে দেয় চোরাগুপ্তা আন-প্রভোকট হামলায়। গায়ে-পড়ে পুলিশের সাথে অকারণ ঝগড়া আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংগ। রাজনীতির কামিয়াবির স্বার্থে দু’একটা লাশের বড়ো প্রয়োজন দেখা দেয় রাজনীতিবিদদের কাছে। পুলিশ রাজনীতিবিদদের মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছার অবলম্বন মাত্র!
সমাজের অন্য দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো পুলিশও দূর্নীতিমুক্ত নয়। বরং ‘আদায়ের ক্ষেত্রে’ পুলিশি আচরণ আগ্রাসী ও মারমুখি বলেই রাজস্ব বোর্ড, কাস্টমস, সওজ, হাসপাতাল ইত্যাকার নিরব-নিভৃত বড়মাপের দুর্নীতি নজর এড়িয়ে যায়। শুনি পুলিশের এইসব ‘আদায়’ সমাজ-রাজনীতি ও প্রশাসনের সম্মানজনক পদে বাটোয়ারার সম্মানীতে নিবেদিত। টাকার দুর্গন্ধ কেবল পুলিশের ইউনিফর্মে লাগে! অন্য বেনিফিশিয়ারিরা ফকফকে সার্ফ আলট্রাধৌত! অথচ পুলিশের পোস্টিং-প্রমোশনের নগদ নারায়ণ সমাজের উঁচুতলায় জমা পড়ে। কাঠখড় পুড়িয়ে পুলিশ দাগী আসামি গ্রেপ্তার করেও ধরে রাখতে পারে না রাজনৈতিক সুপারিশ ও ফোনের ধমকে। রাজনৈতিক প্রভুরা যদি ঘুষ নিয়ে আসামি ছেড়ে দেবার তদবিরি নির্দেশে নামতে পারেন, তাহলে গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কেন ঘুষ নিয়ে আসামি ছাড়ার ‘অধিকার` পাবে না?
স্বাধীনতার পর থেকে শাসকগোষ্ঠি একেক জমানায় একেক পুলিশ কর্মকর্তাকে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণায় ‘দানব’ বানিয়েছে জনগণের কাছে। রাজনীতিবিদেরা ‘রকিবুল, আশরাফ ও কোহিনুর মিয়া’ সৃষ্টি করেন। আবার চাপের মূখে এদের পরিত্যাগে সামান্য দ্বিধাবোধ করেন না। ‘রাজায় রাজায় ঝগড়া হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ’ স্বৈরাচারী ও গণতান্ত্রিক শাসনের কোনো তফাৎ কী আমরা দেখি? পুলিশকে সব সরকার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেন। প্রতিপক্ষ দমনে এখনো পুলিশ রাজনীতিবিদদের প্রিয় আস্হা। কিন্তু পুলিশের সাথে সাংসদ- মন্ত্রী ও হবু মন্ত্রীদের ব্যবহারে থাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। ক্ষমতায় থাকাকালে পুলিশকে ইচ্ছাবিরুদ্ধ ব্যব হার করা হয় বলেই পুলিশ ক্ষমতাহীন এইসব নেতাদের চান্স মতো বেধড়ক পিটিয়ে সুদে-আসলে রাগ উসুল করে।
পুলিশি অ্যাকশন অবশ্যই নিন্দনীয়। স্বাধীন সভ্য দেশে পুলিশের গুলিতে মানুষের মৃত্যু কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, নিন্দারও অতীত। পুলিশতো ভিনদেশের বাসিন্দা নন। আমাদের ভাই-সন্তান-আত্মীয়রাই পুলিশে চাকুরি নেন রাজনৈতিক প্রভুদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে। পুলিশের দামী পদে চাকুরির প্রস্তাব পেলে ক’জন অভিভাবক প্রত্যাখান করবেন? গুলিতে সাধারণ মানুষ হত্যার জন্যে দায়ী পুলিশের সাথে গুলি চালানোর হুকুমের সাথে জড়িত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সিদ্ধান্তকারীদেরও জবাবদিহি করতে হবে। প্রয়োজনে বিচারের মুখোমুখি। কিন্তু কেবল পুলিশকে একা গালি দিয়ে প্রতিপক্ষ মারার এই অপসংস্কৃতি বন্ধ করা যাবে না।
পুলিশকে স্বায়ত্বশাসন দেয়া কী খুবই অসম্ভব ও জটিল কোনো কাজ? নাকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই? অভিজ্ঞতা বলে সব রাজনৈতিক দলই পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোয় সর্বসম্মত!
ইমেলঃ [email protected]