ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ জুন ২০২৪, ১৯ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

শেয়ার-সীমান্ত-যোগাযোগ এবং আমাদের `হাউ, হাই`

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১২
শেয়ার-সীমান্ত-যোগাযোগ এবং আমাদের `হাউ, হাই`

একটা উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্বপ্নের বিজ  রোপন করেছিলো। এ স্বপ্ন দেখিয়েছিলো আমাদের প্রচলিত সমাজটি।

এই সমাজটির কর্তাব্যক্তিরা কিংবা রাষ্ট্রের নিজস্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ওই বিশাল ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে কোনই শিক্ষা কিংবা উপদেশ দিতে পারেন নি। তাইতো দেশের প্রায় দেড়কোটি মানুষ আজ বলতে গেলে পথে বসেছে। পরিকল্পনাহীন এগিয়ে চলা কিংবা টাকা উপার্জনের একটা মওকা পেয়ে আমাদের মধ্যবিত্তদের একটা অংশ ছুটেছিলো শেয়ার মার্কেটের দিকে। সেই শেয়ার মার্কেট বলতে গেলে ধ্বংস হয়ে গেছে বাংলাদেশে। তারই সাথে সাথে যেন নিঃশেষ হচ্ছে একটি দেশের একটি বিরাট অংশ। এই অংশটি পথে বসছে। আবার এই সেক্টর থেকে এখন মুখ ফেরাচ্ছে লাখো মানুষ। সুতরাং আবারও বেকার, আবারও কষ্ট। এই কষ্ট কিংবা কোটি টাকা হারানোর কারণেই ঢাকার যুবরাজ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন চট্টগ্রামের আরেক ব্যবসায়ী। এখানে অস্বাভাবিকত্বের কিছু নেই। মানুষ তার দাঁড়ানোর জায়গা হারিয়ে ফেললে নিজেকে নিঃশেষ করতেই পারে। যুবরাজ তাই করেছেন।

শেয়ার মার্কেট সারা পৃথিবীতেই একধরনের জুয়ার মতো। যারা ঐ মার্কেটটাকে বোঝে, তারা হয়ত কিছু কিছু অর্জন করে।   শেয়ারবাজার থেকে অর্জন সারা বিশ্বে যেমন আছে, তেমনি আবার সারা পৃথিবীতেই আছে এই অর্জনের বিপরীত চিত্রও। নব্বই‘র দশকের মাঝামাঝি কিংবা তার দু-এক বছর পরে লন্ডনে দেখেছি, আমাদের বন্ধুদের অনেকেই শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করছে এবং সত্যি কথা বলতে কি তারা উপার্জনও করছে। অনেককেই তখন বলতে শুনেছি, সারা সপ্তাহ রেস্টুরেন্টে কাজ করে দু‘শ পাউন্ড রোজগার করার কোন্ও মানে হয় না, যেখানে একদিনেই শত পাউন্ড কামানো যায়। কিন্তু তারপরও সবাই তার কাজের ফাঁকেই এই শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতো এবং বানিয়েও নিতো পাউন্ড। কিন্তু পরিবর্তন আসে। সাধারণ মানুষের বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল না-বোঝার কারণেই হয়ত সে সময়ে আমার অনেক পরিচিতজন একসময় ধপাস করে পড়ে গেলো। কেউ কেউ ঋণের জালেও আটকা পড়ল। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদ কিংবা জাতীয় নেতাদের বাদানুবাদ চলতেই পারে, চলেছেও। কিন্তু  ইস্যু হয় নি, রাজপথে নামার। কারণ যারা যা কিছুই করেছে তখন, ন্যূনতম ধারণা নিয়ে পেপার-পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করেই করেছিলো। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপারটা সেভাবে নয়। তাড়াতাড়ি অর্থ তৈরির একটা জায়গা ভেবে এখানে সবাই শুধু টাকা ঢেলেছে, কিছু না জেনেই। তবে যারা জানার, তারা জেনেছে। আর সেজন্যেই এখানে শেয়ার মার্কেটটা লুট করা হয়েছে। যা পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে বিভিন্নভাবে নিউজ আইটেম হয়ে।

এই লুট-পাটে রাজনৈতিক ইনফ্লুয়েন্স যে সরাসরি কাজ করেছে তা বিভিন্নভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। আর সেকারণেই সরকার এর দায়ভার এড়াতে পারে না, পারবেও না। এবং সেকারণেই এই যে আত্মহনন চলছে, তারও দায়ভার তাদেরই নিতে হবে। প্রয়োজনে আত্মহননকারীদের পরিবারগুলোর জন্য কিছু করার জন্যের তাদের উদ্যোগী হওয়া উচিৎ। এ দায় কি নেবে সরকা, নাকি তাদেও কিছুই করার নেই? না-কি লুট-পাটকারীদের আস্কারা দেবে তারা, নাকি বলবে: তোমরা আর কত লুটতে চাও?

২) সম্প্রতি বাংলাদেশের এলজিডিআরডি মন্ত্রী‘র কিছু কথাবার্তা আমাদের মনোযোগ কেড়েছে। মনে করিয়ে দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাবেক জোট সরকারের মন্ত্রীদের পুরনো কিছু কথাবার্ত। বিএনপি‘র মন্ত্রী ছিলেন একসময় আলতাফ হোসেন চৌধুরী। সেসময়েও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির এভাবেই অবনতি ঘটেছিলো। এরকমই এক নৃশংস ঘঠনায় এক শিশুর নির্মম মৃত্যুকে তিনি বলেছিলেন ‘‘আল্লার মাল আল্লায় নিছে তাতে আমাদের করার কি আছে!’’ ঠিক সেভাবেই আমাদের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ এখন বলছেন নতুন নতুন কথা। আমাদের মনে হচ্ছে আমরা যেন মহাজোট নয়, জোটসরকারের সময়টাই এখনও পাড়ি দিচ্ছি। তা না হলে কি মন্ত্রী ইংরেজিতে "অ্যাইক্সডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট" বলতে পারেন!

 বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক মহামারীর মতো। এদেশে বছরের ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় বিভিন্ন দুর্ঘটনা কিংবা দুর্যোগে। লাখো মানুষ বেঁচে থাকেন এই দুর্ঘটনার গ্লানি নিয়ে। এই  দুর্ঘটনাগুলোকে আসলে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যায় না। এগুলো মনুষ্য-সৃষ্ট। প্রকারান্তরে বলতে হয় এইসব দুঘটনার দায় সরকার এড়াতে পাওে না। দুর্ঘটনার দায় আওয়ামী লীগের হোক কিংবা বিএনপি‘র সরকারেরই হোক। সড়ক যোগাযোগের বেহাল অবস্থা দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে দিনের পর দিন। অদক্ষ বলা ভুল হবে, আনাড়ি লাইসেন্সবিহীন কিংবা ভুয়া লাইসেন্সধারী গাড়ি চালকদের ব্যাপারে নেই কোনও ভালো আইন। বরং নৌপরিবহনমন্ত্রী তার শ্রমিক-ভালোবাসার (মাসল-ম্যান পালনের) প্রয়োজনে এদের তেল দিয়ে কথাবার্তা বলেছেন। এতে করে বেপরোয়া হয়ে উঠছে প্রতিদিন ঐসব অদক্ষ-আনাড়ি চালক। সেজন্যেই বাড়ছে অ্যাক্সিডেন্ট। অথচ হত্যার এই দায় না নিয়ে মন্ত্রী বলছেন অ্যাক্সিডেন্ট অ্যাক্সিডেন্টই। এই মন্ত্রীর ইংল্যান্ডের নাগরিকত্বও আছে। ইংল্যান্ড সম্পর্কে তাকে অবহিত করার প্রয়োজন নেই। লাখো-কোটি গাড়ির এই দেশে একজন ড্রাইভার গাড়ি চালনার সনদ পেতে কত কাঠ-খড় পোড়াতে হয় তিনি তো নিশ্চয়ই জানেন। রোড-সেইফটি‘র ব্যাপারে প্রচুর নিয়ম-কানুন সব দেশেই মেনে চলে চালকরা। বছরে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড কামানো ফুটবল খেলোয়াড় বেহহ্যাম থেকে শুরু করে পদস্থ রাজনীতিকদেরও আদালতে জরিমানা গুনতে হয়েছে স্পিডিং করার দায়ে এই ব্রিটেনে। জেলদন্ড হয় অনেকেরই। আর জরিমানাতো নিত্যদিনের ব্যাপার। এখানেও দুর্ঘটনা আছে। কিন্তু  দুর্ঘঠনা রোধে আছে সরকারে নতুন নতুন উদ্যোগ। বাংলাদেশে এখন নামি-দামী গাড়ির ছড়াছড়ি। আমরা বিশ্বাস করি সরকারকে ট্যক্স পরিশোধ করার নিয়ম আছে ঐ গাড়ির মালিকদের। গাড়ি মালিকদের ট্যাক্স পরিশোধ একটা বড় জাতীয় আয়। শুধু সরকারকে সব ব্যাপারেই কেন বিদেশে দৌড়োদৌড়ি করতে হবে? রোড-ট্যাক্স দিয়েই বছরে বছরে সরকার কিছু কাজে হাত দিতে পারে। আর সেজন্যেই প্রয়োজন ট্যাক্স আদায়ে স্বচ্ছতা ও কঠোর নীতি প্রয়োগ।

৩) গত বছরের জানুয়ারীতে বিএসএফ-এর গুলিতে কিশোরী ফেলানীর নির্মম লাশ হওয়া এবং পরে ঝুলন্ত চিত্র প্রতিটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ফেলানী নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। দু‘দেশের কথা বিনিময়ও হয়েছে। কিন্তু মাত্র একটি বছর যেতে না যেতেই আরেক বাংলাদেশি হাবিবুরের উপর বিএসএপ-এর নির্যাতনের ভিডিও-চিত্র দেখে  আবারও মানবিক বিবেক স্থম্ভিত হয়ে গেলো। তারই পরপর রাশেদুলের হত্যার মধ্যি দিয়ে ভারত আবারও নৃশংসতাকে জানান দিলো। নির্যাতন আর লাশ--- খুব স্বাভাবিভাবেই দেশে-বিদেশের বাঙালিরা একে সরকারের এক চরম ব্যর্থতা হিসেবেই আখ্যায়িত করছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন বছরের মাথায় বিদেশ ভ্রমণে সেঞ্চুরি করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কিংবা পশ্চিমবঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রী  মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে গর্বের কথা-বার্তা উচ্চারণ করেন; অথচ সীমান্তের হত্যা-নির্যাতন বন্ধ করতে কেনই যেন বার বার ব্যর্থ হন? আমাদের স্থানীয় -সরকার-মন্ত্রী বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে সম্প্রতি ভারতীয় বিএসএফ-এর ঐসব অমানবিক নৃশংস আচরণকে যেভাবে জনগনের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে মনে হয়েছে মন্ত্রী এসব মানুষের হত্যা-নির্যাতন নিয়ে চরম উদাসীনও। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, "জাম্প নাও" তখন চাটুকার কর্তা ব্যক্তিটি কোথায়-কেন-কখন প্রশ্নটি না করেই নির্দেশদাতাকে বলে ওঠে "হাউ হাই"। সেভাবেই যেন আমাদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ভারতকে খুশি করতে  লাফ দিয়ে বলে উঠছেন হত্যা-নির্যাতন সে আর কি--- "এতে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়"। ভারতের হাইকমিশনারের মতোই যেন তারও সেই একই উচ্চারণ-- "বিএসএফতো ক্রিমিনালদেরই শিক্ষা দিয়েছে"। আর সেজন্যেই বিরোধী দল শুধু বিএনপি‘র রাজনীতি এটা নয়, সাধারণ মানুষের প্রশ্ন আসতেই পাওে, রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে বিদেশ ভ্রমণ করে কিসের এইসব কূটনৈতিক তৎপরতা?

৪) যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ৫  ফেব্রুয়ারি বলেছেন, দুর্ঘটনা নিয়ে সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন, তা আওয়ামী লীগের কিংবা সরকারের কথা নয়। এটা তার নিজস্ব কথা। আমরা মেনে নিলাম একথাটা তার মুখ থেকেই বেরিয়েছে, সেজন্যে এটা তারই কথা। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ দেশের ষোল কোটি মানুষের মতোই সাধারণ মানুষ নন। তিনি বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে জনসমক্ষে কোনভাবেই তিনি বেফাঁস মন্তব্য করতে পারেন না । যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ইস্যু কিংবা সীমান্ত ইস্যু‘র সাথে ষোল কোটি মানুষের আবেগ(অন্ধ আওয়ামী লীগার ছাড়া) যেখানে সরাসরি জড়িত, সেখানে এরকম উচ্চারণে তার দেশাত্ববোধ নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আমরা মনে করি সৈয়দ আশরাফ সরকারের কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। যদি সরকার তা মনে না করে, তাহলে সরকারের মুখপাত্রের বলা উচিৎ, সৈয়দ আশরাফের এ কথা বলা ঠিক হয় নি। কারণ সরকারের উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ যা-ই ভাবেন না কেন বাংলাদেশের চাটুকার রাজনীবিদ ছাড়া সৈয়দ আশরাফের এরকম উক্তিকে সাধুবাদ জানাতে পারে না কেউই।

ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৩ ঘণ্টা, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।