ঢাকা: করোনা পরিস্থিতি বর্তমানে কত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে তার বিভিন্ন তথ্য প্রতিনিয়তই সামনে আসছে। সংক্রমণ ও মৃত্যু গত এক মাস ধরে উচ্চমাত্রায় অবস্থান করছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে ভয়াবহতা কমিয়ে আনতে তারা বিভিন্ন গাইডলাইন দিচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই, অনেক মানুষের কাছেই যেন এ সবকিছু উপেক্ষিত।
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা করোনা পরিস্থিতি বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিনিয়তই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতেও অধিকাংশ স্থানে, অধিকাংশ সময়, অধিকাংশের কাছে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। করোনার হাত থেকে রক্ষার মূল কথা জনসমাগম এড়িয়ে চলা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা। মানুষের মধ্যে সচেতনতা আছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেভাবে চলছে না। ঘরোয় জনসমাগম হোক আর গণপরিবহন হোক শতকরা ৪০ ভাগের উপরে মানুষের কোনো মাস্কই থাকে না। আর বাকি ৬০ ভাগের অর্ধেকই মাস্ক দিয়ে নাক, মুখ না ঢেকে থুতনির নিচে নামিয়ে রাখেন, যা কোনো কাজে আসছে না। অর্থাৎ ৭০ ভাগ মানুষের কাছেই মাস্ক উপেক্ষিত।
গত রোববার (১৮ জুলাই) মতিঝিল থেকে একটি দোতলা বিআরটিসি বাসে ওঠার পর দেখা গেলো, পাশাপাশি দুই সিটের একটি করে ফাঁকা রয়েছে। বাসটি পুরানা পল্টন মোড় আসতে আসতেই সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত আর কোনো সিট ফাঁকা থাকলো না। আমার পাশের ফাঁকা সিটেও একজন এসে বসলেন। এর পর দুজন দাঁড়িযেও গেলেন। অথচ স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী ফাঁকা ফাঁকা করে বসানোর জন্য দুই সিটে একজন করে বসার শর্তে গণপরিবহন চালুর অনুমতি দেওয়া হয়। এর জন্য অতিরিক্ত ভাড়াও নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। বাসের কন্ডাক্টরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মানুষ উঠলে আমি কী করবো? বিষয়টি নিয়ে আরও একজন দুই-একটি কথা বললেও অন্য যাত্রীদের এ বিষয়ে কোনো কথা ছিল না।
এর আগে একদিন বাসে দুই ব্যক্তির উত্তেজিত বাক-বিতণ্ডা হয়। এক যাত্রী উঠে আরেকজনের পাশের সিট বসতে গেলে তিনি নিষেধ করলে শুরু হয় উত্তেজনা। ঘটনাটি ছিল আমার পেছনের সিটেই। যে ব্যক্তিটি বসতে গিয়েছিলেন বসতে না পেরে তিনি উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে হাত উঁচু করে বলে বসলেন, আল্লাহ যদি মারে তাহলে কি আপনে বাঁচতে পারবেন? তাকে আমি বললাম, আল্লাহ তো অসচেতন, অসতর্ক থাকতে বলেননি। লোকটি আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে সামনের দিকে চলে গেলেন।
অর্ধেক যাত্রী নিয়ে পরিবহন চলার মধ্যেই গত এপ্রিলে একদিন প্রেসক্লাব থেকে ধানমন্ডি যাচ্ছি বাসের একজন যাত্রী আরেকজন যাত্রীকে ডেকে তার পাশে সিটে বসালেন। এরপর ওই লোককে (যিনি ডেকে বসালেন) অনেক কথা বলতে শুনলাম। তার মাস্ক থুতনির নিচে নামানো। তার বক্তব্য ছিলো এরকম—আমাদের দেশের ওপর সৃস্টিকর্তার অনেক রহমত আছে। এ কারণে আমাদের দেশে করোনায় খুব কম মানুষই মারা গেছে। লোকটি ইউরোপের কয়েকটি দেশের নাম ও পরিস্থিতি বলে গেলেন। এ সময় তার বলার মধ্যে একটা আক্রোশ বেরিয়ে আসছিল।
একদিন এক যাত্রী আমার পাশের সিটে এসে বসলেন। তার মাস্ক থুতনির নিচে নামানো। আমি তাকে মাস্কটা ঠিক করে পরতে বললে তিনি অনেকটা চাপা বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মাস্ক মুখে তুললেন।
গত বছর জুলাইয়ে যখন আমাদের দেশে করোনার প্রথম ঢেউ প্রতিদিন ৪০/৫০ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছিল তখন গণপরিবহনে নির্দেশনা ছিল হ্যান্ডস্যানিটাইজার রাখা ও যাত্রী ওঠানোর সময় তাদের হাতে দেওয়া। বাড্ডা এলাকায় বাস থামিয়ে পুলিশ সদস্যরা নরজদারি করছিলেন নির্দেশনা মানা হচ্ছে কিনা। পুলিশ সদস্য সরে যাওয়ার পরই একজন যাত্রী বলে উঠলেন, যত সব.... করোনা বলে কিছু নেই। এরকম মানুষ প্রতিদিনই মারা যায়। এতদিন সরকার হিসাব করতো না, এখন হিসাব দেখাচ্ছে।
সাংবাদিকদের মধ্যেও কারো কারো করোনা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব দেখা যায়। অতি সম্প্রতি এক সাংবাদিকের মুখের নিচে মাস্ক নামানো দেখে আমি তাকে মাস্ক পরতে বলেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, আমি ভ্যাকসিনেটেড। অথচ টিকা নেওয়ার পরও অনেকের আক্রান্ত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। আমার পরিচিতদের মধ্যে একজন রাজনৈতিক নেতা এবং একজন সাংবাদিক দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্ত হয়েছেন। জনস্বাস্থ্য বিষেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। তবে ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তি আক্রান্ত হলেও জটিলতার ঝুকি থাকে না। কিন্তু তিনি অন্যকে অবশ্যই আক্রান্ত করতে পারেন।
এ রকম আরেকটি ঘটনা, একজন সাংবাদিক আমাকে দুই মাস্ক পরা দেখে অনেকটা হাস্যচ্ছলে কটাক্ষ করছিলেন। তখন তার মুখে মাস্ক ছিলো না। অথচ ওই ব্যক্তি দুই বার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। গত বছর করোনা আক্রান্ত থেকে নেগেটিভ হওয়ার পর প্রায়ই তাকে মাস্ক ছাড়া দেখেছি। এমন কি তাকে বলতে শুনেছি, আমার ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গেছে। এ বছর এপ্রিলে তিনি দ্বিতীয় বার করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তার অবস্থা বেশ জটিল হয়ে পড়েছিল, সেটা তিনিই আমাকে জানিয়েছিলেন।
করোনার এই উচ্চমাত্রায় সংক্রমণ পরিস্থিতিতেও আরেকটি বিড়ম্বনা রাজনৈতিক দলের সভা, সমাবেশগুলোতে (বর্তমানে ঘরোয়া)। সেখানে পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলানো (হ্যান্ডসেক) পূর্বের যে সাধারণ অভ্যাস এখনও প্রায় সেটাই প্রচলিত। দেখা মাত্রই অধিকাংশ একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। প্রায়ই এই ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। এরকম একজন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে আমি তাকে বলেছিলাম, হ্যান্ডসেক করা ঠিক হবে না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে বোঝাতে চাইলেন সৃষ্টিকর্তার ওপরে ভরসা রাখলে কোনো সমস্যা নেই। সাংবাদিক কমিউনিটিতেও এ হ্যান্ডসেক নিয়ে বিড়ম্বনা কম নয়। প্রতি নিয়তই হাত মেলানোর মুখোমুখি হয়ে এড়িয়ে যেতে হয়। অনেকে মনে হয় মনোক্ষুন্নও হন। এক সাংবাদিক বন্ধু প্রায়ই হাত এগিয়ে দিলে আমি অনেক দিনই তাকে বলেছি, হ্যান্ডসেক করছি না। তিনিও অতি স্বাভাবিকভাবে বলে ওঠেন—কিছু হবে না...। শুনলাম সম্প্রতি তিনি করোনা আক্রান্ত।
শামীম খান: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০২১
এসকে/এমজেএফ