ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বপ্নের কমিটি যেদিন হচ্ছে সেদিনই টিংকু অন্তিম শয়ানে

রফিকুল বাহার, অতিথি লেখক ও সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১২
স্বপ্নের কমিটি যেদিন হচ্ছে সেদিনই টিংকু অন্তিম শয়ানে

১. স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সমাবেশে আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিচ্ছেন সুদর্শন এক ছাত্রনেতা। বলার ভঙ্গি, উচ্চারণ ও কণ্ঠ এতোটাই মনকাড়া ছিল যে সবাই তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন।

একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে আমিও ছিলাম সেই সমাবেশে। বক্তৃতা শোনার পর খুব ইচ্ছা হচ্ছিল তার নাম জানার। জানা গেল তার নাম জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু। এভাবেই টিংকুকে চেনা শুরু হলো। স্বৈরাচার হটলো। দেশ এগুলো গণতন্ত্রের দিকে। ছাত্রনেতার সঙ্গে আরেক পরিচয় যুক্ত হলো টিংকুর---সেটি হলো তিনি ব্যবসায়ী। কেমন ব্যবসায়ী সেটিও জানার খুব ইচ্ছে হলো। একদিন জানলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের ভিপি ও টিংকু ভাইয়ের রাজনৈতিক সহকর্মী নাজিম উদ্দিনের কাছ থেকে।

ভিপি নাজিম উদ্দিন বললেন, ‘টিংকুর মতো বড় হৃদয়ের মানুষ হয় না। ’ জিজ্ঞেস করলাম, কেন? জবাবে নাজিম ভাই বললেন, ‘আমি একবার অর্থ সংকটে পড়ে তাকে কিছু টাকা ধার দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম। জানতাম তারও দুর্দিন। কিন্তু আমাকে কিছু বুঝতে দেননি। দুই দিন পর বিপুল অংকের টাকা ম্যানেজ করে আমার জন্য পাঠিয়ে দিল। আসলে টিংকু এরকমই। বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের জন্য তার ভালোবাসা ও মায়ার কোনো শেষ নেই। ’

২. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু নিজে খেতে ভালোবাসতেন, অন্যকে খাইয়েও আনন্দ পেতেন। খাদ্যপ্রিয় ও ভোজনরসিক সব বিশেষণই তার ক্ষেত্রে খাটে। হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতে বসে অর্ডার দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করতেন ‘খাদ্য’ কি খাবেন? খাবারকে তিনি খাদ্য বলতেন! টিংকু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে অথচ তার সাথে খাবার খাননি এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে। প্রতি বছর রাউজানের গ্রামের বাড়িতে বিশাল মেজবানের আয়োজন করতেন। তাতে যোগ দিতেন ঢাকা-চট্টগ্রামের সব শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কয়েক হাজার মানুষের সেই আয়োজনে কার্ড পাঠিয়ে দাওয়াত দেওয়া ছাড়াও জনে জনে ফোন করতেন টিংকু ভাই। খাওয়া ও আড্ডা দুই-ই চলতো তার কদলপুরের গ্রামের বাড়িতে। কদলপুরের গ্রামের বাড়ির উঠানে সামিয়ানা টাঙানো প্যান্ডেলের ভেতর বসে মেজবানের সুস্বাদু মাংস খাওয়াই কেবল শেষ নয়। সদরঘাট শেঠবাড়ির সেই বাসা, কিংবা চিটাগং ক্লাবের গেস্ট হাউস অথবা ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলেও টিংকু ভাইয়ের দাওয়াত খেতে হয়েছে। কখনো দল বেঁধে, কখনো শুধু দুজনে। সুস্বাদু সব খাবার খাইয়েও যেন সাধ মিটতো না টিংকু ভাইয়ের। উপহারও দিতে হবে। সামান্য সংবাদকর্মী হিসেবে জীবনে প্রথম দামী ব্র্যান্ডের ‘মোঁ ব্লা’ কলম ও মানিব্যাগ উপহার পেয়েছিলাম টিংকু ভাইয়ের কাছ থেকে। এতো দামী কলম ব্যবহার করতে দেখলে কেউ সন্দেহ করবেন সাংবাদিকের সততা নিয়ে সে বিবেচনাবোধ থেকে সেটি উপহার দিয়ে দিয়েছিলাম এক বিদেশি বন্ধুকে। মানিব্যাগটিও একই কারণে। ভালোবাসার এই ঋণ শোধ করার সামান্য উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমি। বাসায় রান্না করে তাকে ইলিশ মাছ খাওয়াবো বলে কথা দিয়েছিলাম দুই বছর আগে। কথা ছিল কাজে কিংবা ছুটিতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এলেই সেই খাওয়া হবে। কিন্তু তা আর হলো না, ‘দুঃখিত টিংকু ভাই’। ব্যবসায়িক কারণে টিংকু ভাই স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে নিয়ে থাকতেন ঢাকায়। চারজনের সুখী পরিবার। ছুটির দিন ঢাকায় থাকলে পুরো সময় কাটাতেন পরিবারের সঙ্গে, রাজসিক খাবার খেয়ে ও দুর্দান্ত সব মুভি দেখে।

৩. চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ষোলশহর চমশা হিলের বাসায় বসে বসে নির্বাচনী ফলাফল মনিটর করছিলেন জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু। সংবাদকর্মী হিসেবে প্রার্থীর কাছ থেকে ফল মিলিয়ে নেওয়ার জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় ফোন করলেই সেটি রিসিভ করতেন টিংকু। ফোন তুলে অপর প্রান্ত থেকে সংবাদকর্মীদের নিজের সংগ্রহে থাকা তথ্য জানিয়ে দিতেন। পরাজয়ের সেই রাতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পাশে ছিলেন তিনি। বিশাল হৃদয়ের টিংকুর আয় ছিল বিপুল। খরচও করতেন অঢেল। চিন্তাশক্তি ছিল প্রখর। কল্পনা করতেন বড় কিছু। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি প্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছিলেন একেবারেই নিচ থেকে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি চেয়েছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য হতে। বছর দুয়েক আগে মরণব্যাধি ধরা পড়ে তার শরীরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। চিকিৎসা করিয়েছেন সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের নামী হাসপাতালেও। সব মিলিয়ে ১০ কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছেন বলে শোনা যায়। আরো টাকা খরচ করার সামর্থ্য ছিল তার। কিন্তু মস্তিষ্কের মরণব্যাধি ক্যান্সার তার বিপুল সামর্থ্যকে বিলীন করে দিয়েছে।

শরীরে রোগ বাধার আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘সম্পাদক-সভাপতি হতে চাই না। আমি চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সদস্য হতে পারলেই খুশি হবো। চট্টগ্রামে থেকেই রাজনীতিটা করতে চাই। ’
 
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! তার সে-ই স্বপ্নের কমিটি যখন হবে হচ্ছে- তখন তিনি সবকিছুর ওপরে। চলে গেছেন পরপারে, সবাইকে ফেলে। অথচ বৃহস্পতিবার বিকেলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি গঠন হবে-তখন জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু থাকবেন না কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির আলোচনায়, তিনি যাত্রা শুরু করবেন অন্তিম শয়ানের দিকে। সৃষ্টিকর্তা কি নিষ্ঠুর নিয়তি নির্ধারণ করে রেখেছেন তাঁর জন্য!

রফিকুল বাহার: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও ব্যুরো চিফ, চট্টগ্রাম ব্যুরো, দৈনিক কালেরকণ্ঠ

বাংলাদেশ সময় ২০০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।