নিত্য পেশা পরিবর্তনের ঝামেলা ও বৈচিত্র্যে বিভিন্ন দেশ-প্রতিবেশে যাবার ও থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশ যথার্থ শিক্ষকের মতো হাতে কলমে জীবন-যাপনের বিভিন্ন সামাজিক রীতি নীতি, পারস্পরিক সম্মানবোধের জ্ঞান দিয়েছে।
সাংবাদিকতার গুরু ওবায়দুল হক কামাল আটাত্তরে নসিহত করেছিলেন, নতুন কোনো শহরে গেলে হাল হকিকত জানার সেরা উপায় হচ্ছে স্থানীয় চায়ের দোকানের আড্ডা আর স্থানীয় সংবাদপত্র। থিওরিটার যথার্থতা বহুবার পেয়েছি। বিদেশে আমাদের মতো অফুরান আড্ডার চায়ের দোকান নেই। সামাজিক হালফেল জানার সেরা উপায় আলাপচারিতা ও মেলামেশা।
অব্যাহত ক্লান্তিকর আকাশ যাত্রার জীবনে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতেও বেশ কবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার সাপ্লাইয়ারের এক্সপোর্ট ম্যানেজার রুবেন পেরেরা ছিলেন চৌকস, নিপাট, পরিশ্রমী ও মার্জিত। ব্যবসায়ীক সম্পর্কের গন্ডি পেরিয়ে আমরা দু’জন ছুটির দিনে-কাজের অবসরে শ্রীলঙ্কা ঘুরেছি তারুণ্যের চিন্তা-ভাবনাহীন আবেগে। পেরেরা গিন্নী ও পাঁচ বছর বয়সী ছেলে অরণের সঙ্গেও মিতালি হয়েছিল। ষাট দশকেই দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি শিক্ষা-দীক্ষায়-শিল্প বাণিজ্যে ছিল অগ্রসরতম। ভারত-পাকিস্তান তখনো উন্নয়নের ড্রইং রুমে।
পেরেরার কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিলেন তামিল শ্রীভারণ শিবারত্মম। স্কুল জীবনে পেরেরার সহপাঠী।
কাকতলীয়ভাবে দু’জনেই একই মহল্লার। একসঙ্গে ক্রিকেটের মাঠ দাবড়িয়েছিলেন দু’জন পঁয়ষট্টি-সত্তরে। পরস্পরের হাত ধরে কলেজের উঠার প্রাক্কালেই শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক গৃহযুদ্ধ বাধে। দীর্ঘ ও পুরোনো লঙ্কান-তামিল অসন্তোষ উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক মাতব্বরেরা দু’পক্ষকে ঠেলে দেন সশস্ত্র যুদ্ধে। এক পক্ষ বই-খাতা-লাঙ্গল-কাস্তের বদলে তুলে নিলেন অস্তিত্ব রক্ষার রাইফেল। অন্যপক্ষ নিজেদের রাজনৈতিক দাপট নিশ্চিন্তে কৃষকের ছনের খুপড়ির ওপর চালিয়ে দিলেন সামরিক ট্যাঙ্ক। হত্যা আর পাল্টা হত্যার অব্যাহত প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয় লঙ্কান-তামিল অবিশ্বাস। ন্যায়-অন্যায়, যুক্তি-তর্ক ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে নিজেদের রাজনৈতিক-গোত্রীয় ও পারিবারিক আধিপত্য বিস্তার আর অস্তিত্ব রক্ষার
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
করুণ এই উৎসের সকরুণ ক্রমবিকাশ সবারই জানা। তামিল আত্মঘাতী সেনারা শ্রীলঙ্কার জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন। আর লঙ্কান সেনারা পুরো তামিল জাতিকে পাকা ত্রিশ বছর রেখেছিল দৌড়ের মধ্যে। দু’পক্ষের কেউই পরস্পরকে সামান্য মানুষের মর্যাদায় ভাবেনি! সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন ভুলেছিল শ্রীলঙ্কা। তাদের গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশে এসে স্থায়ী হয়েছে। শ্রীলঙ্কা সুস্বাদু চায়ের বাজারে ঢুকেছে কেনিয়া-ভারত। উন্নত একটি জাতি সরসরে নেমে গিয়েছিল দারিদ্র্যের কাতারে। তেল-জলে না মেশা চরিত্র ভর করেছিল লঙ্কান আর তামিলদের চিন্তায়-মননে-বিশ্বাসে।
দুই প্রতিবেশী রুবেন আর শ্রীভারণ একই অফিসে একই সময়ে হাজির হতেন ভিন্ন বাহনে। কোনো দাফতরিক প্রয়োজনে রুবেনের কামরায় এলে শ্রীভারণের প্রত্যাবর্তনের পর সেই কামরায় তল্লাশিতে বোমার খোঁজ নেওয়া হতো। শত হোক শ্রীভারণ তামিল! যদি তিনি তামিল সুইসাইড বোম্বার হন। শ্রীভারণ ভয়ে রুবেনের সঙ্গে কোনো আলাপের বিস্তারিতে যেতেন না এই আশঙ্কায় যদি রুবেন শ্রীলঙ্কান গোয়েন্দা বাহিনীর ইনফরমার হন? কিংবা তামিল হবার অপরাধে যদি শ্রীভারণকে উল্টাপাল্টা অভিযোগে পুলিশের হাতে তুলে দেন? সেনাবাহিনী লেলিয়ে বিপদে ফেলেন? পারস্পরিক অবিশ্বাসে কেবল কৈশোরের দুই বন্ধু পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হন না, তাদের সন্তানেরাও পরিণত হন আজীবনের শত্রুতে। পাশাপাশি থেকেও তারা কেউ কারো নন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। কি দারুণ মানসিক কষ্টে থাকেন শ্রীলঙ্কানদের এই প্রজন্ম! মধ্যিখানে রাজনৈতিক নেতাদের বেকার সন্তানেরা হাঁকান ফেরারি। প্রাইভেট জেট।
বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আজ পারস্পরিক অবিশ্বাসের দ্রুত বর্ধনশীল ফলন। আওয়ামী সরকারের সমালোচনায় রাজাকার কিংবা পাকি দালাল। বিএনপির সামান্য সমালোচনায় ‘হিন্দু-ভারতীয় গুণ্ডা! দুই দলের সমর্থকদের অন্তরে লুকানো থাকে ‘সতীন’ ঘায়েলের চাপাতি-বন্ধুক। সুযোগ পেলেই দ্বিধাহীন প্রয়োগ! আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই অবিশ্বাস তৈরিতে বেশ আমুদ পাচ্ছেন। কুমড়ো কাটা ভাগের জাতি আজ অনেক অনৈক্যে।
‘রাজনৈতিক কৌশলে ও কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে হাজারো রুবেন পেরেরা আর শ্রীভারণ শিবারত্মম। গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাটা কেন জানি না গলায় চেপে বসে।
ইমেল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, ফ্রিবুয়ারি ১১, ২০১২