শোকে পাথর করে দিয়ে চলে গেলেন বললে ভুল বলা হবে, তাদেরকে জোর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে কিংবা যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আর কখনোই ফিরবেন না।
হত্যাকাণ্ড যেভাবেই হোক ঘটেছে। অকালে ঝরে গেছে দু’টি তাজা প্রাণ। অথচ আমাদেরকে এদের দেবার অনেক কিছুই ছিলো। কিন্তু অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা পরদিন সকালের সূর্য দেখতে দিলো না তাদের।
দ্রুত ঘটনা জানার পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সাথে সাথে ঘটনাস্থলে ছুটে গেছেন পুলিশসহ দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা, সরকার ও বিরোধী দলের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ। বিভিন্ন মিডিয়ায় ঘটা করে বক্তব্যও দিয়েছেন। সরকার বিরোধীদের কেউ বললেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত, কেউ বললেন সরকারের দুঃশাসনের ফল, কেউবা বললেন, দেশ বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে।
সরকারের দায়িত্বশীলদের কেউ বললেন, সমাজকে অস্থিতিশীল করতেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, কেউ বললেন, ৪৮ ঘণ্টার ভেতরে খুনিদের খুঁজে বের করা হবে, খোদ প্রধানমন্ত্রী খুনিদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিলেন। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন বলছেন, খুনের আলামত নষ্ট হয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতোমধ্যেই ঘটনাটি নিয়ে রাজনীতিও শুরু হয়ে গেছে। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির এই পরিচিত পটভূমিতে সরকার বড়জোর বলবে- খুনি যেই হোক না কেন রক্ষা পাবে না। তাদের উপযুক্ত শাস্তি হবে। বিরোধী দল বলবে, সরকার মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, পদত্যাগ করা উচিত!
কিন্তু আমরা যারা সাংবাদিকতা করি তারা কি বলবো? শোকবার্তা পাঠাবো, পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা, কালোব্যাজ ধারণ করবো, বিচারের দাবিতে হয়তো দু’এক দিন বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করবো। এরপর? এরপর কি আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো? নাকি কলম চালিয়ে যেতে হবে ঘাতকদের বিরুদ্ধে? যদি কলম চালাতেই হয় তবে আমাদের স্বাভাবিক জীবনের গ্যারান্টি কী? আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারাণ্টী কে দেবে?
এইতো কদিন আগেও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি ক্রমাগত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কে জানে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি সরকারের ক্ষোভ এমন হত্যাকাণ্ডে ঘাতকদের উৎসাহিত করেছে কিনা ? গণমাধ্যমকর্মীরাও মানুষ। দেশের সচেতন নাগরিক। মানুষ হিসেবে তারাও সমালোচনার উর্ধ্বে নন। কোনও দায়ের জন্য যদি তিনি সমালোচিত হন কিংবা বিচারের মুখোমুখি হন তবে আমাদের কলমও ওই দায়ের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠবে। কিন্তু সত্য-সুন্দর আর ন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায়-অবিচার-অসঙ্গতি তুলে ধরতে গিয়ে যদি অন্যায় সমালোচনার মুখোমুখি হন কোনও গনমাধ্যমকর্মী তবে কি আমাদের করার কিছুই নেই? সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের দ্বিধাবিভক্তি, কুৎসা রটনা আমাদের কলম শক্তিকে কি সামন্যতমও বিচলিত করেনি?
যা হোক- কী কারণে, কারা সাগর-রুকে হত্যা করলো- এমন প্রশ্নই আপাতত সারাদেশে। তবে কি পেশাগত কারণে তাদেরকে হত্যা করা হলো? যদি তাই হয় তবে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তার দায় কার ওপর বর্তাবে?
কিন্তু মেঘ? মেঘের কি অপরাধ? শিশু মেঘতো এখনও রঙিন প্রজাপতির পাখায় ভর করে ঘুরে বেড়ায় মেঘেদের দেশে। অকৃত্রিম ভালোবাসায় যারা ছায়া দিতো মেঘের মাথায় তারা চলে গেছেন না ফেরার দেশে- মেঘ তাও বুঝে না। তবে কেন মেঘের জীবন মেঘাচ্ছন্ন করে দিলো ঘাতকের দল?
কর্মজীবন শেষে সরকারের সামান্য একজন পিয়নেরও থাকে বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন- পেনশনসহ অন্যান্য সুবিধা। একজন সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। প্রাপ্তির প্রত্যাশা কেবল সম্মান। তবে এই সম্মাননা যদি হয় সাগর-রুনির মতো পরিণতি- তাহলে রাষ্ট্র বা তার নাগরিকদের কাছে আর কিছুই প্রত্যাশা থাকেনা নিরস্ত্র কলম সৈনিকদের! অথচ তাদেরকে বলা হয় রাষ্ট্রের ‘পঞ্চম স্তম্ভ’! যে রাষ্ট্রে কলম সৈনিকদের পথে-ঘাটে এমনকি নিরাপদ আশ্রয় নিজ বাসায়ও এমন অসহায় আর নির্মম মৃত্যুর মুখে পড়তে হয়- সেই রাষ্ট্রের কর্ণধার আর বাসিন্দারা দ্রুত জাগ্রত হোন- নাহলে সামনে এমন পরিণতি আমাদের সবাইকেই ভোগ করতে হতে পারে।
খায়রুল আলম বাদল: সংবাদকর্মী, কিশোরগঞ্জ
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১২