রোগ-শোকের চেয়েও করোনার বড় ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। বিশ্বজুড়ে অনেক দেশই করোনার প্রভাব হয়তো কিছুটা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে, বাংলাদেশও তাই।
দেশে সব কিছুর দাম অনেক আগে থেকেই বাড়তি। এখানে রুটিন করে কয়েক দিন পরপর ভোজ্যতেল ও গ্যাসের দাম বাড়ে। একই রাস্তায় দৌড়াতে থাকে বিদ্যুতের দাম। এসব যেন পাগলা ঘোড়া, যার লাগাম কারও হাতে নেই! সবাই শুধু কথা বলেন, কাঠামোগত বিশ্লেষণ করে এ থেকে উত্তরণের পথ বের করার সদিচ্ছা কারো নেই।
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ঘোষণা করা হয় বলে আমজনতা একটা হিসাব রাখতে পারে। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলেও তা থেকে যায় ব্যক্তিপর্যায়ে। সামষ্টিক হিসাব মাঝে-মধ্যে গণমাধ্যমে এলেও সেদিকে খুব একটা চোখ ফেলেন না কর্তারা।
করোনায় মানুষের জীবিকা কমে গেছে, চাকরি হারিয়েছে, অনেক শিল্প ধ্বংস হয়েছে বা ধ্বংসপ্রায়। এতকিছুর পরও মানুষ ব্যক্তি উদ্যোগে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। করোনাপরবর্তী সময়ে তারা সেই চোট কাটিয়ে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। তাই ডাল-ভাতের মধ্যে জীবনকে অনেকটাই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে সাধারণ মানুষ।
সেই ভাতও কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ১৭ কোটি মানুষকে অবাক করে দেন সরকারের একজন মন্ত্রী। যিনি কি না মানুষের খাদ্য উৎপাদন ও বণ্টনের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে। সাধারণ মানুষের যেহেতু বলার কিংবা যাওয়ার জায়গা নেই, তাই বেশি দামে চাল-ডাল কেনার সামর্থ্য না থাকলে খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
এতকিছুর পর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যখন অনেকটাই কমে এসেছে, তখন তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে সব কিছুর মূল্য বাড়ানো হলো। তেলের দামের প্রভাব যে কোন পণ্যে কত পরিমাণ পড়বে, সেই হিসাব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেউ করে দিতে হয়তো পারবেন না। কেননা, যে দেশে বিনা কারণে সব কিছুর দাম বাড়ে, সেখানে পাশের দেশ কিংবা বিশ্ববাজারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে সব কিছুর মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া খুব সোজা। এখন সেটাই হচ্ছে, আগামীতেও হবে।
দেশের মানুষের নানা সংকটে সব নীতিই যখন ফেল মারতে বসেছে, এমন সময় মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে উপরমহল থেকে একখানা নোটিশ জারি করা হলো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে বলা হলো, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এখন সবাই আয় করেন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ২ লাখ ১৮ হাজার ৬০০ টাকার বেশি।
ওই নোটিশ দিয়ে তারা হয়তো উপকার পেতে পারেন, অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য-রাজনীতি বিষয়ক চুক্তির হেরফের করতে পারেন। কিন্তু পাবলিককে তো কম আয় করেও বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। তাদের অনেকের জীবনমান কমে যাচ্ছে।
এমন সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জাতির সামনে নতুন তথ্য তুলে ধরলেন। দেশের মন্ত্রীরা মাঝে-মধ্যেই নতুন তথ্যের আবিষ্কারক হয়ে যান। কিন্তু এবারের তথ্যটা সবকিছুর থেকে আলাদা। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মাথাপিছু আয় বড়েছে। আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শনৈ শনৈ বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাত পোহালেই আয় বাড়ছে বাংলাদেশের, আমরা টেরই পাচ্ছি না। আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি। ’ (সূত্র: বাংলানিউজ, ৭ নভেম্বর ২০২১)
‘অজান্তে বড়লোক’ হয়ে যাওয়ার দেশে থেকেও মানুষ এখন ‘হতাশাগ্রস্ত’। চাকরি-জীবিকা নিয়ে চিন্তিত। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের কষ্টের কথা বলেন। পোস্ট দেন, নিউজের নিচে বিরূপ মন্তব্য করেন। মন্ত্রীদের এসব মুখরোচক কথায় তাদের জীবনের হতাশা কাটে না, বরং অনেকাংশে বেড়ে যায়। এতকিছুর পরও সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে পারে না। আবার তাদের প্রতিবাদ করতেও দেওয়া হয় না। তাই মুখ বুঁজে সব সয়ে যান তারা।
এক ব্যবসায়ী গায়ে আগুন দিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলেন, যার বদৌলতে মধ্যপ্রাচ্যে এসেছিল আরব বসন্ত। মেগাসিটি নামক ঢাকায় কয়েক দিনের ব্যবধানে দুজন মোটরসাইকেলে আগুন দিয়ে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন। মানুষের বাদ-প্রতিবাদের পরও আমরা ‘বড়লোক’ হচ্ছি, এটাই হয়তো আশার কথা।
একাত্তর সালে পূর্ব বাংলায় (এখনকার বাংলাদেশ) ৫০ পয়সায় এক কেজি চাল বা আটা, ১২ টাকায় এক মণ পেঁয়াজ, ৬০-৭০ টাকায় একটা গরু পাওয়া যেত। সেই হিসাবে ৫০ বছরের ব্যবধানে এখন আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কতগুণ বেড়েছে, বাজারে গেলেই বোঝা যায়। এখন ঢাকার বাজরে ৬০ টাকায় এক কেজি চাল, ৪০ টাকায় আটা, ৭০-৮০ টাকায় পেঁয়াজ, ১৩০ টাকায় টমেটো কিনতে হয়। ঢাকার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন অনেক শাক-সবজির দাম বিশ্বের এক নম্বর ব্যয়বহুল দেশ সিঙ্গাপুরের চেয়েও বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে জীবনমান উন্নয়নের গল্প দিয়ে কেউ না-খেয়ে থাকেন না বলে প্রচার করা হয়। সেই প্রচারণার পেছনের কারিগরের ভূমিকায় রাখা হয় সরকারের উন্নয়ন। দেশের মানুষ হয়তো সেই উন্নয়নের মধ্যেই আছে। তাই অধিক দামে পণ্য কিনে জীবিকা চালাচ্ছে আর ‘বড়লোক’ হচ্ছে। আগামীতে দেশের মানুষ আরও বড়লোক হবে, সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজ
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০২১