ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিদেশে বাঙালির শহীদ মিনার

সাইফুলস্নাহ মাহমুদ দুলাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১২
বিদেশে বাঙালির শহীদ মিনার

বাংলা ভাষার কোনো সূর্যাস্ত নেই। তাই বাংলা ভাষার আলোচিত কিরণ এখন সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে।



১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণের সূচনা হয়েছিল, তা ক্রমশ সারাদেশ জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে। পরবর্তীতে নানান প্রেক্ষাপট ও প্রসারে শহীদ মিনারের বিকাশ ঘটছে বহিঃবিশ্বেও। বিশেষ করে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের পর ভাষার ঐতিহ্যের প্রতীক এবং মানবধিকারের অংশ হিসেবে গুরুত্ব বেড়েছে অনেক।

বাঙালির অহংকার একুশের এই সম্মানপ্রাপ্তির ঘটনায় প্রবাসী বাঙালিরা মাতৃভাষা এবং দেশপ্রেমকে আরো গাঢ়ভাবে উপলদ্ধি করে। প্রবাসীদের জন্য আনন্দের সংবাদ রক্তে শিহরণ জাগানো অমর একুশের সেই বিখ্যাত গান, `আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি` এর রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী যেমন লন্ডনে প্রবাসী, তেমনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম ভ্যাঙ্কুভারে প্রবাসী। অপরদিকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশাবিদ হামিদুর রহমানও চিরনিদ্রায় শায়িত মন্ট্রিয়লে।

বাঙালিরা এখন আর ঘরকুনো নয়। ছড়িয়ে আছে সারাবিশ্বে। যেখানে বাঙালি সেখানেই বাংলাভাষা, সেখানেই বাংলা সংস্কৃতি। আর সেই সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ ২১ ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস এবং শহীদ মিনার। সেই শহীদ মিনার বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে, ভারতে, অস্ট্রেলিয়ায়, মধ্যপ্রাচ্যে, জাপানে, জার্মানে, প্যারিসে। আমার প্রস্তাব, পৃথিবীর সব দেশে অন্তত একটি করে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হোক। অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগেই প্রবাসে ২১ শে একাডেমী গঠন করেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন শহীদ মিনারের।

দেশের বাইরে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয় উত্তর লন্ডনে। সেখানকার `বাংলাদেশি কালচারাল অ্যান্ড হিস্ট্রি ইন ওল্ডহ্যাম` ১৯৯০ সালে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর শহীদ মিনার স্থাপনের কাজ শেষ করে ইতিহাস সৃষ্টি করে।

লন্ডনে তিন তিনটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে, অন্য দু’টি হচ্ছে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে এবং লুটন শহরে। শহীদ মিনার দু’টি স্থাপিত হয় যথাক্রমে ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ২০০৪ সালের ৮ আগস্ট। (তথ্য সূত্র: বিলেতের মাটিতে একুশে ফেব্রুয়ারি ও বাংলা ভাষার প্রসার। তারেক চৌধুরী, দৈনিক আমার দেশ, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১০, ঢাকা। )

প্রবাসী বাঙালিরা ভাষা ও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই প্রতি একুশের প্রথম প্রহরে ঢল নামায় শহীদ মিনারের পাদদেশে। এছাড়াও এখানে বৈশাখী মেলা, কবিতা পাঠ, পথনাটকও অনুষ্ঠিত হয়। (তথ্য সূত্র: বিলাতে তৃতীয় বাংলার বইমেলা: শামীম আজাদ। দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০১০, ঢাকা)

আরেকটি স্থায়ী ও পূর্নাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মিত হয় টোকিও শহরের প্রাণকেন্দ্র নিশিকুচি পার্কে। এ পার্কে শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম।

২০০৫-এর বৈশাখী মেলা থেকে ফিরে এসে লিখেছিলাম, `টোকিওতে শহীদ মিনার হচ্ছে`। লিখেছিলাম, বৈশাখী মেলায় অতিথি হয়ে আসার কথা ছিলো টোকিওর মেয়র পিনতারো ইশিহানা, কিন্তু অনিবার্য কারণে তিনি না আসায় তার বদলে এলেন ডেপুটি মেয়র মি. তসিমা, তাঁকে প্রতীকী শহীদ মিনার তুলে দেন স্থপতি মাসুম ইকবাল। তখন দাবি জানানো হয় নিশিকুচি পার্কে বা দূতাবাসের সামনে অথবা অন্য কোথাও একটি শহীদ মিনার স্থাপনের। আমি তখন আমার বক্তব্যে বলেছিলাম, জাপানে শহীদ মিনার হলে, আমি এসে ফুল দিয়ে যাবো। (দ্র্র. দৈনিক ভোরের কাগজ, ১২ জুন ২০০৫, ঢাকা এবং ত্রৈমাসিক পরিক্রমা, জুলাই-আগস্ট ২০০৫, সুইডেন)

প্রবাসীদের পক্ষে এ দাবি নিয়ে পরদিন শাইখ সিরাজ দেখা করেন টোকিওর মেয়রের সঙ্গে। মেয়র বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে বলেন, যদি দু`দেশের সরকার এবং ইউনেস্কো উদ্যোগ নেয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। পরে এই সংবাদটি আদিত্য শাহীন ১৭ এপ্রিল ২০০৫-এ চ্যানেল আই-এ তুলে ধরেন।

এই ঘটনার তিনমাস পর নিশিকুচি পার্কে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রি বেগম খালেদা জিয়া ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কাকতালীয়ভাবে ও সৌভাগ্যক্রমে টোকিও আন্তর্জাতিক বই মেলা অংশ নেয়ার জন্য সেই সময় আমিও টোকিওতে। দূতাবাস থেকে দাওয়াত পেলাম। সোজা চলে গেলাম। হাতের কাছে ফুল-পুষ্প নেই। তবুও আবেগে আপ্লুত হয়ে নিজের কোট থেকে ফিতা ফুলের বেইজ খুলে আমিই প্রথম পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করলাম।

(দ্র. প্রবাসে প্রতি মাসেই বাঙালিদের উৎসব/ গ্রন্থ:কানাডায় যাবেন, কেনো যাবেন/ লেখক, প্রকাশক: সূচীপত্র, প্রকাশকাল: ২১ শের বইমেলা ২০১১ ঢাকা, পৃষ্ঠা ৪৯)।

ভারতে রয়েছ ৩টি শহীদ মিনার। দু`টি পশ্চিম বঙ্গের হলদিয়া এবং চন্দন নগরে। অন্যটি শিলচরে। শিলচরের শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে ১৯৬১ সালে সেখানকার শহীদদের স্মরণে।

এবার কলকাতায় উপ-দূতাবাসে প্রাঙ্গণে নির্মিত হচ্ছে শহীদ মিনার। কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে প্রায় দেড় লাখ রুপি ব্যয়ে আর সিসি ও টাইলস দিয়ে তৈরি এ স্মারকটি তিন ফুট ভিত্তির ওপর ১১ ফুট উচ্চতায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত হচ্ছে। (তথ্যসূত্র: প্রাক্তন ডেপুটি হাইকমিশনার মাসুদ খন্দকার, মহা পরিচালক, পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়, উপ- দূতাবাস কলকাতা, ভারত,২৫ জানুয়ারি, ২০১১)

প্যারিসের মেয়র জ্যাকলিন রুই ও সমপ্রতি এক বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো জন্য অবিলম্বে ফ্রান্সে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রি দীপু মনি গত বছর জার্মানি সফরে গেলে প্রবাসী বাঙালিরাও শহীদ মিনার স্থাপনের বিষয়টি অবগত করেন।

পৃথিবীর বড় দু`টো দেশ আমেরিকা এবং কানাডায় এখনো কোনো স্থায়ী শহীদ মিনার গড়ে ওঠেনি। তবে লস এঞ্জেলস এর স্যাডো ক্রিয়েশন সেন্টারের সামনে খেলার মাঠে শহীদ মিনারের আদলে ব্রোঞ্জের ১২ ফুট প্রস্থের এবং ১৮ ফুট উঁচু একটি পস্নাক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি কপোর্রেশন।

কানাডার টরন্টোয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মরণে স্থানীয় বাংলাদেশীদের উদ্যোগে গৃহীত প্রায় এক দশকের একটি অনুপম ভাষাসৌধ নির্মাণ প্রয়াস এখন চূড়ান্ত সফলতার দ্বারপ্রান্তে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারী স্কারবরো সিভিক সেন্টারের কাউন্সিল চেম্বারে অনুষ্ঠিত স্কারবরো কমিউনিটি কাউন্সিলের ১৩তম সভায় উপস্থিত সকল সিটি কাউন্সিলররা ঐকমত্যের ভিত্তিতে কানাডার ঐতিহাসিক দ্বিতীয় কনফেডারেশন পার্কে দেড় লক্ষ ডলার মূল্যের এই ভাষাসৌধ নির্মাণের প্রয়াসটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। এতে অন্টারিও মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধিত অলাভজনক বাংলাদেশীয়দের প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে মনুমেন্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি ইনক্’ সহসাই তাদের প্রাক্কলিত তহবিল উত্তোলন সম্পন্ন শেষে এই ভাষাসৌধ নির্মাণে সক্ষম হবে।

তবে উত্তর আমেরিকার অন্যান্য দেশে শহীদ দিবস কেন্দ্র করে অস্থায়ী শহীদ মিনার গড়ে তোল হয়। তার মধ্যে অন্যতম নিউইর্য়কের জাতিসংঘের সামনে মুক্তধারা কর্তৃক নির্মিত শহীদ মিনার। যেখানে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা থেকে `সান্ধ্য ফেরি` নামে প্রভাতফেরি শুরু হয়। এ বছর সেখানে ২১ শে স্মরণে একুশতম অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হবে। এখানে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপনের দাবি রয়েছে প্রবাসী বাঙালিদের। এবার  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রদেশে অর্ধশতাধিক অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপিত হবে।

নিউইর্য়কের এনটিভির বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, টেক্সাসে নির্মিত হচ্ছে- মিনি বাংলাদেশ। অর্থাৎ বাঙালিদের আবাসস্থল। সেখানে স্থায়ীভাবে নির্মিত হবে শহীদ মিনার এবং স্মৃতিসৌধ।

মধ্যপ্রাচ্যেও রয়েছে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার। তবে সেখানকার বাঙালিরা প্রতি ফেব্রুয়ারিতেই নিজ হাতে শহীদ মিনার স্থাপন করে শ্রদ্ধা জানায় শহীদদের প্রতি, তারপর নিজ হাতেই ভাঙে।

শহীদ দিবস থেকেই উৎপত্তি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। সেভাবেই শহীদ মিনার থেকেই বর্ধিত হয়েছে- ভাষা বিষয়ক মনুমেন্ট। সেই নতুন মাত্রা যুক্ত করে অরস্ট্রেলিয়ার সিডনির আশফিয়েন্ড হিরিডে পার্কে একুশে একাডেমী নির্মাণ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ ডে মনুমেন্ট (ওগখউ মনুমেন্ট) অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ। যা স্থাপিত হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ সালে।

আরো ভিন্ন মাত্রায় কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের সাথে শহরের বিয়ার পার্কে ২০০৯ এর ১১ জুলাই উদ্বোধন করা হয় ভাষার নান্দনিক মনুমেন্ট `লিঙ্গুয়া অ্যাকুয়াং। `(দ্র. অধুনালুপ্ত মাসিক পড়শী, ৯ম বর্ষ, ৬ সংখ্যা, আশ্বিন ১৪১৬, আমেরিকা)।
যা শুধু মাত্র বাংলা ভাষারই নয়, পৃথিবীর বিলুপ্ত এবং বেঁচে থাকা সকল ভাষার গৌরবোজ্জ্বল প্রতীক।

বাংলাদেশ সময়: ২২০৬ ঘণ্টা, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।