ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিচারের আশা কি তাহলে ছেড়েই দিতে হবে!

মোঃ আল-আমিন খান চৌধুরী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২
বিচারের আশা কি তাহলে ছেড়েই দিতে হবে!

গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ বাসায় নির্মমভাবে খুন হন তরুণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। ছিনতাই, হত্যা, গুম যখন বাংলাদেশের প্রতিদিনের স্বাভাবিক ব্যাপার, সেখানে বাসার বাইরে গেলে সে আবার ফিরে আসবে এই নিশ্চয়তা এখন আর কেউ দিতে পারে না।

বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকা শহরের মানুষ যে কোন সময় যে গুম হয়ে যেতে পারে এই বিশ্বাস নিয়েই প্রতিদিনের জীবন পার করছে। কিন্তু সবার একটু বিশ্বাস ছিল যে, হয়ত বাসার মধ্যে থাকলে, নিজের জীবনটা বুঝি বাঁচানো যাবে। সেই বিশ্বাসের জায়গাটা ও আজ টালমাটাল। এই হল বিগত ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তব উদাহরণ। বিগত ১০ বছর কেন, বিগত শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভাল বললেই দোষের কি! সৃষ্টিকর্তা মুখ দিয়েছেন, যে কোন ভাবে ব্যাবহার করলেই হয়। চোখ বন্ধ করে অনর্গল মিথ্যা কথা বললেই ঠেকায় কে?

আত্মসম্মান আর চক্ষু লজ্জা বিসর্জন দিলে, মিথ্যা কথা আর চাপাবাজি করতে চোখ বন্ধ ও রাখতে হয় না। শুধু কষ্ট লাগে সেই মানুষগুলোর কথা ভেবে যাদের কে প্রিয়জন হারানোর তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। হ্যাঁ আমি বলছি, ছোট্ট নিষ্পাপ মেঘের কথা, সাগর-রুনির অসহায় বৃদ্ধা মায়েদের কথা, যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে বুকে শোকের পাথর চেপে আছেন। এখন নিজ সন্তানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য তাদেরকে অনশনের প্রস্তুতি নিতে হয়।

এই হত্যাকাণ্ডের পরে কেন জানি পুলিশ আর সাংবাদিকদের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠছি। দেশে কি একজন সৎ, সাহসী এবং বিবেকবান একজন পুলিশ বা সাংবাদিক নেই, যারা এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য বা আসল খুনির পরিচয় প্রকাশ করে দিতে পারে। প্রতিদিনই আশায় থাকি আজকে পেপার খুললে মনে হয়, খুনের আসল ঘটনা জানতে পারব। কোথায় কি, প্রতিদিনই শুধু হতাশার পরিমাণটাই বাড়ছে। এবার দেখি কিভাবে আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর পুলিশ মিলে একটার পর একটা নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছেন। ঘটনার পরে মাননীয় মন্ত্রী বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনি ধরা পরে যাবে। সবার সাথে আমি ও আশা করেছিলাম এইবার অন্ততপক্ষে খুনি ধরা পরবে। সাংবাদিকরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে যার ফলে খুনের ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হবে না। খুনিরা এইবার পালাবার কোন পথ পাবে না। দুঃখের ব্যাপার হল, বরাবরের মত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মন্ত্রী তার সুর পরিবর্তন করে বললেন, ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়া ছিল একটা কৌশল। আমি বুঝি না, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলা কি কোন রাজনৈতিক কৌশল না স্রেফ ভণ্ডামি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নৈতিকতার কোন অস্তিত্ব আছে বলে আমার জানা নেই।

ঘটনার পরের দিন দু-একজন সাংবাদিকের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে মনে হয়েছিল, খুনের আসল রহস্য সবার কাছে স্পষ্ট। এখন পর্যন্ত আমার বিশ্বাস, খুনের রহস্য অনেক সাংবাদিক-পুলিশের কাছেই স্পষ্ট।   তাহলে প্রশ্ন হল, কেন তাহলে প্রকাশ করা হল না ? কেনই বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনি ধরা পড়ল না ? কেনই বা মাননীয় মন্ত্রীকে মিডিয়ার সামনে একের পর এক স্ট্যান্ডবাজি করতে হচ্ছে ?

কারণ একটাই হতে পারে, হত্যার সাথে প্রভাবশালী কেউ জড়িত । দেশে অনেক কিছুর অভাব থাকলে ও প্রভাবশালীদের কোন অভাব নেই। প্রভাবশালীদের নাম আসলেই পুলিশ অনেক সতর্ক হয়ে যায়। না গিয়ে কোন উপায় ও নেই। যেমন, প্রতিদিন অসংখ্য সাধারণ মানুষ পুলিশী নির্যাতনের শিকার হলেও পুলিশ কে জবাবদিহি করতে হয় না। এমনকি সাধারণ পথচারীকে ধরে তার বুকের উপর বুটের লাথি দিয়ে বিরোধী দলের কর্মী বলে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু কোন প্রভাবশালী তো দূরের কথা, প্রভাবশালীদের ভাগ্নের গায়ে হাত তোলার যে কি শাস্তি, পুলিশ এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে । তাই পুলিশ সাধারণ মানুষের জন্য পুলিশ যতটাই নিষ্ঠুর, প্রভাবশালীদের জন্য ততটাই উপকারী। অবশ্য পাপ যেমন বাপকে ও ছাড়ে না, সেটা পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, পুলিশ সদস্য অমুক প্রভাবশালীর হাতে লাঞ্ছিত ।

যাই হোক, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে যখন প্রভাবশালী কারো নাম চলে এসেছে, পুলিশ স্বভাবতই রিস্ক না নিয়ে নামটি মন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন । কিন্তু প্রভাবশালী লোকটি কত প্রভাবশালী যে, তাকে বাঁচানোর জন্য পুলিশকে প্রতিদিন নতুন নতুন নাটক লিখতে হচ্ছে। পত্রিকার সর্বশেষ সংবাদ অনুসারে, পুলিশ এটাকে সাধারণ চুরির ঘটনা বলে প্রমাণের চেষ্টা করছে । এই খুনের একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী মেঘের বক্তব্য অনুসারে খুনি ছিল দুইজন এবং খুনিদেরকে রুনি নুডুলস রান্না করে খাইয়েছিল। দুইজন রোগা চোর সবার চোখ ফাকি দিয়ে জানালার গ্রিল কেটে ঘরে প্রবেশ করেছিল। এরপর রুনি তাদেরকে সাদর-সম্ভাষণ জানিয়ে নুডুলস রান্না করে নিজ হাতে আপ্যায়ন করেছিল। এমন হাস্যকর যুক্তি কি একজন পাগল ও বিশ্বাস করবে ? যেসব গোয়েন্দারা এইসব উদ্ভট তদন্ত করে, তাদেরকে কি জনগণের কষ্টের করের টাকায় পোষার কোন দরকার আছে ? বাংলাদেশের যেসব গোয়েন্দারা বিরোধী দলের নেতাদের পেটের খবর বের করে ফেলে, তারা এমন হাস্যকর তদন্ত করবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এই ঘটনায় যে প্রভাবশালী জড়িত তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বশেষ উক্তি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মামলাটি তদারক করছেন । দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তাকে নিতে হয়। এই হত্যা মামলার তদারকির দায়িত্ব কেবলমাত্র এবং কেবলমাত্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। যদি তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে পদত্যাগ করতে পারেন। সবকিছুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিরক্ত করা কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর নয়। আওয়ামীলীগের মত বড় একটি দলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালানোর মত অনেক যোগ্য নেতার অভাব থাকার কথা নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তদারকির খবরটা শুনে সাগর –রুনির হত্যার বিচারের আশা করতে পারছি না। এর কারণ হল, সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রী কিছু মামলার তদারকি করেছেন। মামলাগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করি। কেনই বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মামলাগুলো তদারকি করতে হল। প্রথম মামলাটি হল, যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যা মামলা। প্রধানমন্ত্রী এই মামলাটির তদারকি করেছেন, কারণ এই মামলায় বাদী পক্ষ একজন সরকার দলীয় সাংসদকে অভিযুক্ত করেছিলেন। মামলার সর্বশেষ খবর হল, পুলিশ অভিযুক্ত সাংসদকে মামলা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। তারপর দেখি নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যা মামলা। এখানে ও সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভাই কে বাদী পক্ষ অভিযুক্ত করেছিলেন। মামালার সর্বশেষ খবর হল, পুলিশ মন্ত্রীর ভাইকে বাদ দিয়ে চার্জশীট তৈরি করেছেন বা দিয়েছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যেসব মামলায় কোন প্রভাবশালী জড়িত, তাদেরকে বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দেয়া হয় । এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, সাগর-রুনি হত্যার সাথে কোন প্রভাবশালী জড়িত। হয়ত পুলিশ এবং মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন কোন চাঞ্চল্যকর ঘটনার জন্য সময় ক্ষেপণ করছেন, যাতে আগের মত সাগর-রুনির ঘটনাটি চাপা পরে যাবে।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কারণ কি হতে পারে। আমার মনে হয় ঘটনাটি এই রকম হতে পারে। মেঘের দুটি বক্তব্য আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। এক, খুনি ছিল দুই জন এবং খুনিরা এই বাসায় নাস্তা করেছে। দুই, খুনিদেরকে সে পিকনিকে দেখেছে। তার মানে খুনিরা সাগর বা রুনি অথবা দুজনেরই পূর্বপরিচিত । হয়ত ঘনিষ্ঠ বা ঘনিষ্ঠ নয়। কিন্তু তাদের যে পরিচিত ছিল এই ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। সাগর-রুনি যে ডাকাতি বা চুরির কারণে খুন হয়নি তা উপরের আলোচনা বা বাসা থেকে হারানো জিনিসপত্রের লিস্ট দেখেই বোঝা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিস হারিয়েছে সেটা হল, তাদের ল্যাপটপ । তাহলে কি ল্যাপটপে এমন কিছু ছিল, যার জন্যই তারা খুন হন।

এমনকি হতে পারেনা, সাগর বা রুনি কেউ কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করছিলেন, যা প্রকাশ পেলে প্রভাবশালী কারো মুখোশ সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যেত। প্রভাবশালীরা হয়ত সমাজের অনেকের কাছেই পরিচিত। তারা ঘটনাটিকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছে। এমন ও হতে পারে, তারা বেশ কিছুদিন ধরেই সাগর-রুনির সাথে এটা নিয়ে দর-কষাকষি করেছে। পিকনিকের দিন ও তাদের সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করতে গেছে।

ঘটনার দিন সাগরের নাইট শিফটে কাজ ছিল এবং সকালের আগে তার বাসায় ফেরার কথা ছিল না। তাহলে কেন সে বাসায় ফিরেছিল ? তাকে কি তার ঊর্ধ্বতন কেউ ছুটি দিয়ে বাসায় ফিরতে বলেছে ? নাকি বাসা থেকে সে কারো ফোন পেয়ে সে বাসায় ফিরে এসেছিল ? এমন ও হতে পারে খুনিরা তাদের বাসায় রুনির সাথেই আসে বা এই বিল্ডিং এর কারো পরিচিত তাদের মাধ্যমে ভিতরে প্রবেশ করে। যেহেতু তারা সাগর-রুনিদের পরিচিত, তাই রুনি তাদেরকে তাদের এপার্টমেন্টে প্রবেশ করতে দেয় এবং নাস্তা তৈরি করে খাওয়ায়। তারা হয়ত রুনির সাথেই আলোচনা করেছে এবং সাগরকে বাসায় ফিরে আসতে বলেছে। সাগর আসার পরে হয়ত তাদের সাথে আবার দরকষাকষির চেষ্টা করেছে, বা তাদের আলোচনার মাঝে উত্তেজিত হয়ে তাদেরকে খুন করেছে।

বাংলাদেশে যেসব সাংবাদিক এবং পুলিশ ক্রাইম নিয়ে কাজ করে তাদের কাছে এই খুনের রহস্য বের করা কঠিন কোন কাজ এটা আমার বিশ্বাস হয় না। এমন হতে পারে যে ইতিমধ্যে হত্যার রহস্য তাদের কাছে উন্মোচিত। কিন্তু প্রভাবশালীদের চাপের কারণে বা মিডিয়ার কারো সংশ্লিষ্টতার কারণে প্রকাশ করছেন না। সেদিন কোন একজন তরুণ সাংবাদিক বলেছিলেন, কাক যেহেতু কাকের মাংস খায় না, তাই এই ঘটনায় যদি মিডিয়ার কেউ জড়িত থাকে, তাহলে তা কখনই প্রকাশ পাবে না। কাক যে কাকের মাংস খায় না, সেটা আমারা কানিজ আলমাস আর অরুন চৌধুরীর কেলেঙ্কারির পর কয়েকটি প্রথম সারির পত্রিকার অবস্থান দেখেই বুঝেছি। কিন্তু প্রশ্ন হল, এখানে তো দুইজন তরুন মিডিয়া কর্মী খুন হয়েছেন, তাদের প্রতি কি সাংবাদিকদের কোন দায়িত্ববোধ নেই। সাংবাদিকতা পেশাই তো হল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা । শত বাঁধা অতিক্রম করে প্রভাবশালীদের কুকর্ম ফাঁস করে দেয়া। সাগর-রুনির হত্যা রহস্য বের করে অন্য কোন ক্রাইম রিপোর্ট বা ক্রাইম রিলেটেড অনুষ্ঠান করার কোন নৈতিক অধিকার কি সাংবাদিকরা রাখেন ? সাংবাদিকরা কি পারেন না খুনিদেরকে খুঁজে বের করতে ? আমার বিশ্বাস কেবলমাত্র সাংবাদিকদের শক্ত এবং নৈতিক অবস্থানই পারে সাগর-রুনির হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে। আর যেহেতু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়েছেন, তাই এই ঘটনা সত্যিই যদি ধামাচাপা দেয়া হয়, তাহলে ভেবে নিব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রভাবশালীদের রক্ষা করছেন । সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচারের অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (অন লিভ ফর হায়ার স্টাডিজ), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময় ১৭২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।