ঢাকা, রবিবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জুন ২০২৪, ২২ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

জুতো মেরে গরু দান

মনোয়ার রুবেল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১২
জুতো মেরে গরু দান

স্কুলে থাকতে বছরের পর বছর Circumstances কে পড়তাম কির-কুমেস-টেন্সেস। বেখেয়ালেই ভুল করেছি।

ভুল ধরা পড়ল অষ্টম শ্রেনীতে। স্যার শব্দটির উচ্চারণ শুনে বললেন, ‘আবার বল’। আমি বললাম, কির-কুমেস-টেন্সেস। স্যার গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আবার বল’। উচ্চারণগত কোনো সমস্যা বোধহয়। তাই ব্রিটিশদের মতো গলায় চাপ দিয়ে বললাম, খির-খুমেস-টেন্সেস। চারদিকে হাসির রোল পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিঠে শপাং শপাং বেত পড়ল। স্কুল জীবনে ভুল ধরা পড়লে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। স্যারের কৃপায় পিঠে বেদম বেত্রাঘাত হল। বেত্রাঘাতই প্রায়শ্চিত্তের মহা পন্থা।

স্কুলে শুধু ছোট শব্দেই নয়, বড় বাক্যও বছরের পর বছর ভুল করেছি। ‘গরু মেরে জুতো দান’ প্রবাদটি বছরের পর বছর পড়ে এসেছি ‘জুতো মেরে গরু দান’। বাক্যটি মনে গেঁথে গিয়েছে। জুতো মারা খাওয়া যথেষ্ট অপমানের ও অসম্মানের। এর বিনিময়ে এক হালি গরু পেলেও মানহানির মূল্য পরিশোধ হয় না। ভুল করে হলেও এই বাক্যটি থেকে আমি শিক্ষা লাভ করেছি- অর্থের চাইতে সম্মান অনেক বড় জিনিস। সম্মান গেলে তা অর্থের মূল্যে পরিশোধ হয় না। যৌবনে এসে এক তরুণীর কাছে হেনস্তা হয়ে শুদ্ধ বাক্যটি শিখলাম। সেই কাহিনী খুব করুণ। করুণ হলেও তা বলা যাবে না। কারণ, এতে লেখক হিসেবে নরুণ কাটা যাবে।

অনেক প্যাঁচাপ্যাচি করলাম, এবার মূল কথায় আসা যাক। ফোনে এক বন্ধু আমাকে সংবাদটা দিলো। রোববার ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের কাছে ড. ইউনূসকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ভাষায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জুতো মেরে গরু দান’ করছেন।

শেখ হাসিনার ক্যারিশমাটিক এ প্রস্তাবের সংবাদ প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাধারণের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ দেখলাম। কেননা, এর আগে তিনি বয়সের দোহাই দিয়ে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে টেনে নামিয়েছেন। বলেছেন, ঘুষখোর আর সুদখোরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। ক্ষুদ্রঋণের সফলতা পুরোটাই সরকারের বলেও দাবি করেছেন। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানিকেও উপেক্ষা করেছেন। ড. ইউনূসের পারিবারিক বন্ধু মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও শেখ হাসিনাকে ফোন করে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তাতেও নমনীয় হননি। ইউনূসকে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়েছেন। ক্ষমতা লোভী সম্বোধন করেছেন। মিসেস হিলারি অভিমান করে তার বাংলাদেশ সফরে আসতে অনীহা প্রকাশ করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাসিনা সরকারের দূরত্বের সৃষ্টি হয়।

প্রধানমন্ত্রী আজ শুধু এ প্রস্তাবই রাখেননি, ১৮০ ডিগ্রি মোড় নিয়ে ড. ইউনূস ও দারিদ্র্য বিমোচনে তার ক্ষুদ্রঋণের অবদান নিয়ে ব্যাপক ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। তার এ আহ্বান যে রাজনৈতিক, তাতে কারোই সন্দেহ নেই। আমাদের দেশের সরকার গঠনে আমেরিকার দোয়া থাকতে হয় বলে একটা জনশ্রুতি রয়েছে। ইউনূস বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় আমেরিকার দোয়া থেকে আওয়ামী লীগের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মনে করে বিরোধী শিবির মনে মনে হাসছিলও বেশ। শেখ হাসিনা আমেরিকার দোয়া বিষয়ে মোক্ষম দাবার ঘুঁটিটি চাললেন। ইউনূসই হচ্ছেন আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার বর্তমান ট্রাম্পকার্ড।

শেখ হাসিনা তার চাল চাললেন বটে। বাকি চাল ইউনূসের হাতে। বিশ্বব্যাংকের প্রধান হওয়া বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই গর্বের ব্যাপার। কিন্তু এতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। লাভবান হবেন ইউনূসও।

তবু কথা থেকে যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে অপদস্থ হওয়া এবং কর্তৃক তার সম্পর্কে আওয়ামী লীগ প্রধানের আগের নেতিবাচক বক্তব্যের কথা নিশ্চয়ই তিনি ভুলে যাননি। এখন আওয়ামী লীগই তাকে সম্মান দিতে চাচ্ছে। এটা কি তিনি কিভাবে নেবেন? তিনি কি এতে সম্মতি দেবেন? আগের অপমান-অপদস্ত হওয়ার কথা ভুলে তিনি কি রাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাংকে নেতৃত্ব দেওয়ার গৌরবে গৌরবান্বিত করবেন?

মনোয়ার রুবেল: কবি ও ব্লগার
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad