মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে পাঁচ ছেলে ও স্বামীকে হারিয়েছেন মানু রানী সুশীল। এই বিধবার সঙ্গী হয়েছেন আরও পাঁচ বিধবা, পুত্রবধূরা।
গত ৩০ জানুয়ারি মারা যান সুরেশ চন্দ্র শীল। পিতার মৃত্যুতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য বাড়িতে গিয়েছিলেন সন্তানরা। শ্মশান থেকে ফেরার পথে ৮ ফেব্রুয়ারি বাড়ির কাছে মহাসড়কের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় পিকআপ চাপায় একসঙ্গে নিহত হন অনুপম শীল, নিরূপম শীল, দীপক শীল, চম্পক শীল ও স্মরণ শীল। ওই সময় গুরুতর আহত হন রক্তিম শীল। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন। আর রক্তিমের দুই বোনের মধ্যে হীরা শীলের এক পা কেটে ফেলা হয়েছে। তিনি মালুমঘাট মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনার ভয়াবহতায় রক্তিমের আরেক ভাই প্লাবন শীল স্ট্রোক করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আরেক বোন মুন্নি শীল কাঁদছেন মায়ের সঙ্গে। কাঁদছেন ভ্রাতৃবধূরাও।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের পাইন্দং ইউনিয়নের পেলাগাজী মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সময় ধানবোঝাই একটি চাঁদের গাড়ি সড়কের পাশে দুই ছাত্রীকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তারা নিহত হয়। নিহতরা উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের হাইদচকিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী আবুল বশরের মেয়ে মিশু আকতার ও একই ইউনিয়নের মোহাম্মদ লোকমানের মেয়ে নিশা মনি। ওই দুই পরিবারে কান্না থামেনি এখনও।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, দেশে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত ও ৯ হাজার ৩৯ জন আহত হয়েছেন। সংগঠনটির হিসাবমতে, গত বছর রেলপথে ৩৯৬ জন নিহত, ১৩৪ জন আহত হন। নৌপথে ১৮২টি দুর্ঘটনায় ৩১১ জন নিহত ও ৫৭৮ জন আহত হন, নিখোঁজ হন ৫৪৪ জন। ২০২০ সালে ৬ হাজার ৬৮৬ জনের প্রাণহানি ও ৮ হাজার ৬০০ জনের আহত হয়। এ ছাড়া সে সময় রেলপথে ৩১৮ ও নৌ দুর্ঘটনায় ৩১৩ জন নিহত হন। চলতি ২০২২ সালের শুরু থেকেই দুর্ঘটনার মড়ক লেগে আছে।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। প্রথমে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন। পরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে এই আন্দোলন ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তিন বছর পর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির চিত্র বদলায়নি। প্রতিদিন ঝরছে প্রাণ।
দেশের সড়কব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ হচ্ছে। নামছে বিলাসবহুল গাড়ি। তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেনি। সংসদে পাস হওয়ার এক বছরের বেশি সময় পর ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগে মূল দায়িত্ব পুলিশ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)।
দেশের পরিবহন খাত দীর্ঘদিন ধরে ১৯৩৯ সালের ‘বেঙ্গল মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্ট’ এবং পরে ১৯৮৩ সালে মোটরযান অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এই আইনে অপরাধের সাজা কম ছিল। এ জন্য আইন মানার প্রবণতাও ছিল কম। ফলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ সাজার বিধান যুক্ত করার দাবি এসেছিল। এরশাদের শাসনামলে চালকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরে নেমে আসে।
২০১০ সালে নতুন সড়ক আইনের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১২, ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে চার দফা খসড়া প্রণয়ন করা হয়। প্রথমে সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যক্তির মৃত্যুর দায়ে ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত শাস্তির প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে শাস্তি কমানোর দাবি আসে। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছরের সাজার বিধান রেখে আইন পাস হয়। এরপর পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘটে সারাদেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষিতে আইনটির প্রয়োগ আটকে যায়।
চকরিয়ায় বেপরোয়া গতির পিকআপের চাপায় পাঁচ ভাই নিহত হওয়ার ঘটনায় পিকআপটির চালক সাহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আটক করার কথা জানিয়েছে র্যাব। তবে এর আগে দুর্ঘটনার পর ফেলে রাখা পিকআপ জব্দ করে হাইওয়ে পুলিশ। পিকআপটির নম্বর ছিল ‘চট্টমেট্রো-ন-১১-৪৭৪০’। এই নম্বরটি ভুয়া বলে জানিয়েছে বিআরটিএ।
বিআরটিএ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বরের সূত্র ধরে নিশ্চিত হওয়া গেছে- প্রদর্শিত গাড়ির নম্বরটিও ভুয়া। পিকআপটির ফিটনেস মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালের ১২ মে।
দেশে গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা। দফায় দফায় কর মওকুফের পরও মালিকরা গাড়ির ফিটনেস হালনাগাদ করছেন না। বিআরটিএ সূত্র বলছে, দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার ৭৭টি (৩০ নভেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত)। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমন গাড়ি ছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় সংসদে গত ২৬ জানুয়ারি এ তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। অর্থাৎ এক বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বেড়েছে ৫৯ হাজার ৪৮টি। বুয়েট দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে ছিল ৬৬ হাজার ৬৬১টি ফিটনেসবিহীন গাড়ি। ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর ২৫ ধারা অনুযায়ী, বিআরটিএ থেকে মোটরযানের ফিটনেস সনদ নেওয়ার বিধান রয়েছে। তারপরও ১০ বছরের বেশি সময় ধরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মোটরযানের ফিটনেস নবায়ন করা হয়নি।
শিশু অর্ক, আয়ুষ্মান, অভি তাদের বাবাকে আর পাবে না, মানু রানী পাবেন না নাড়ি ছেঁড়া ধনদের। শোকের বোঝা ভারি হয়েছে। একটি দুর্ঘটনা এখন সারাজীবনের কান্না সেই ঘরে। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া সুরেশ চন্দ্রের মেয়ে মুন্নী সুশীলের দাবি, চালক ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের চাপা দিয়েছে। এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আইসিইউতে সংকটাপন্ন সন্তান রক্তিম সুশীলের জন্য মা মানু রানীর প্রার্থনা, ‘ভগবান, রক্তিমকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও’। সবার ভালোবাসা-প্রার্থনায় রক্তিম হয়তো বেঁচে ফিরবেন, তবে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতেও নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২২
টিসি