ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রেম কিংবা পরকীয়া

সজীব সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২
প্রেম কিংবা পরকীয়া

কালে কালেই সাহিত্যে পরকীয়া সম্পর্ক গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের অনেকের রচনায় পরকীয়া সম্পর্ককে ‘প্রবল-প্রচণ্ড প্রেম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই প্রেম (পরকীয়া) কখনো শরীরী, আবার কখনো প্লেটোনিক। বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী বা বড় অনেক ব্যক্তিত্ব তাঁদের জীবনের নানা পর্যায়ে এমন এক বা একাধিক সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। এ কারণে অনেকেই এ ধরনের (এক্সট্রা-ম্যারিটাল) সম্পর্ককে খুব ‘মহৎ’ বা ‘নান্দনিক’ বলে প্রচারের চেষ্টা করেন এ বলে যে, সৃষ্টিশীল মানুষদের পক্ষে এমন সম্পর্ক আসলে তাদের ‘মহৎ কাজের পেছনে ইনস্পিরেশন’!

এর সত্যতা কতোটুকু, তা আসলে এ বিষয়ে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। কেননা পরকীয়া সম্পর্ককে ভালো বা মন্দ হিসেবে মূল্যায়ন চূড়ান্তভাবে সাবজেকটিভ ব্যাপার; এতে অবজেকটিভিটি অনুপস্থিত। তবে এমন কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্যে প্রচলিত ও সর্বজনগ্রাহ্য রীতি-আচার একটি বড় অনুঘটক। তবে একজনের সাথে এমন সম্পর্কে আবদ্ধ থাকাকালে তার অবগতি ও সম্মতি ছাড়া আরেকজনের সাথে একই সম্পর্কে জড়ানো হলো একেবারে নির্ভেজাল অসততা। নিজের সঙ্গীর সাথে করা প্রতিশ্রুতি ভেঙে প্রকাশ্যে বা আড়ালে অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর মধ্যে সৃষ্টিশীলতা থাকুক আর না থাকুক, এতে সততা অন্তত কিছুমাত্র নেই। একজন সঙ্গীর সাথে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও এ সম্পর্কের কাছে সততার দাবিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা অবস্থায় অন্য একজনের সাথে একই বন্ধনে আবদ্ধ হলে সেখানে ‘ইনস্পিরেশন’ কতোটা আছে, তা বোঝা কঠিন হলেও সেখানে সততা যে বিন্দুমাত্র নেই, তা তো নিশ্চিত!

প্রাণিজগতে মানুষ ছাড়া অন্য দু-একটি প্রজাতির কথাই জানা যায় যারা পরস্পরের সাথে সম্পূর্ণ জীবন কাটিয়ে দেয় কিংবা একজন সঙ্গীতেই বিশ্বস্ত থাকে। বাকিদের মধ্যে এমন প্রবণতা নেই; এদের সবাই একাধিক সঙ্গীর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। মানুষের প্রেম এখানেই ভিন্নতর যে, সে একটা সময়ে একজন সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। সঙ্গীর সাথে কোনো কারণে বিচ্ছেদ ঘটলে নতুন করে অন্যের সাথে এ সম্পর্কে জড়ানোতে দোষের কিছু নেই; তবে একসাথে একাধিক সম্পর্ক বা পরকীয়া সম্পর্ক প্রকৃত পক্ষে প্রতারণা।

নৃতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিকভাবে একগামিতা (মনোগ্যামি) ও বহুগামিতা (পলিগ্যামি)- দুয়েরই অস্তিত্ব হাজারো বছর ধরে সমাজে রয়েছে। পশ্চিমের ‘ওপেন ম্যারেজ’ বা ‘ওপেন রিলেশনশিপ’-এর মতো ধারণাগুলো অন্যান্য সমাজেও দেখা যাচ্ছে। সঙ্গীদের মধ্যে বোঝাপড়া বা পারস্পরিক সম্মতি (ইনফরমড কনসেন্ট) থাকলে এতে বাইরের লোকেদের আপত্তির কারণ থাকার কথা নয়; কিন্তু সঙ্গীকে লুকিয়ে অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়ানো প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। আর মিথ্যা বা চৌর্যবৃত্তি অবলম্বনের কারণে এ ধরনের সম্পর্ক কখনোই নৈতিক (এথিক্যাল) নয়।

গুরুত্বপূর্ণ বা জনপ্রিয় অনেক সাহিত্যকর্মে একসাথে একাধিক প্রেম বা পরকীয়া সম্পর্ককে খুব ‘গ্ল্যামারাস’ বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বড় অনেক ব্যক্তিত্বের জীবনেও এমনটি দেখা যায়। আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক শিল্পী-সাহিত্যিকসহ অনেকে বলেছেন, পরকীয়াও আসলে খাঁটি প্রেম। কারো কারো মতে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রেম বলে কিছু নেই; সব প্রেমই তো নতুন! কথা হলো, প্রেম নতুন বা পুরনো- এ নিয়ে বিতর্ক নিরর্থক; তবে একসাথে একাধিক ‘প্রেম’ আসলে পুরোটাই ফাঁকি। সবগুলোই এখানে ‘অসৎ’ সম্পর্ক। সে বিচারে ‘পরকীয়া প্রেম’ আসলে উভয় সঙ্গীর সাথেই অসততার পরিচয়।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে এবং সেগুলো দারুণভাবে জনপ্রিয়ও বটে! অনেকেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে পরকীয়ার প্রসঙ্গ টেনে এ ধরনের সম্পর্ককে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। যারা রবীন্দ্রনাথের পরকীয়া সম্পর্ককে গ্রাহ্য করেন, তারাই আবার সচেতনভাবে তাঁর এই কথাটি উপেক্ষা করেন: ‘প্রেমহীন দাম্পত্যজীবন ব্যভিচারের নামান্তর’। তাই একজন ব্যক্তি যদি মনে করেন তিনি তার সঙ্গীর প্রতি আগের মতো আর ‘প্রেম বোধ’ করছেন না, তাহলে তার উচিত হবে বিষয়টি নিজের সঙ্গীকে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো। কিন্তু সঙ্গীর প্রতি প্রেম নেই আর প্রেম জন্মেছে নতুন কারো প্রতি আর তাই পরকীয়া সম্পর্কের জন্ম হলো- এটি নিতান্তই অসততা শুধু নয়, ঘোরতর অন্যায়ও বটে। তাই নতুন সম্পর্কে জড়ানোর আগে পুরোনো সঙ্গীর সাথে সম্পর্কের বোঝাপড়া সেরে নেওয়া উচিত।

কোনো ব্যক্তির পক্ষে নিজের সঙ্গীর সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করে লুকিয়ে অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর মধ্যে তার সৃষ্টিশীলতা বা জ্ঞানের প্রমাণ রয়েছে- এমন ধারণার যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবে এর মধ্যে বিশ্বস্ততা ও সততার ঘাটতির পাশাপাশি চারিত্রিক দুর্বলতারও যে প্রমাণ রয়েছে, তা বোঝা খুব শক্ত ব্যাপার নয়।

‘প্রেম ফুরিয়ে গেলেও’ একসাথেই থাকতে হবে এবং অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ানো যাবে না- এমনটাও ঠিক নয়। একটা সময়ে দুজনের মধ্যে ভালোবাসা কিংবা বোঝাপড়ার ঘাটতি হতেই পারে। এমন হলে সম্পর্কটাকে ‘বোঝা’ হিসেবে বয়ে বেড়ানোর কোনো কারণ নেই। তবে কথা হলো, একজন সঙ্গীর সাথে প্রতিশ্রতিবদ্ধ থাকাকালে অন্যের প্রতি আগ্রহ, দুর্বলতা বা আসক্তি তৈরি হলে পুরোনো সঙ্গীকে তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে সেই সম্পর্ক থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে এসে এর পরেই কেবল নতুন সম্পর্কে জড়ানো উচিত। তাহলেই কেবল নতুন সম্পর্কটি নতুন ‘প্রেম’ হবে। যদি অন্যের প্রতি দুর্বলতা বা ‘প্রেম’ তৈরি হয়, তাহলে পুরোনো সঙ্গীকে লুকিয়ে সেই ‘প্রেম’ চালিয়ে না গিয়ে বরং সঙ্গীকে স্পষ্টভাবে তা জানিয়ে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার মতো সৎ সাহসটুকু একজন ‘প্রেমিকের’ থাকা উচিত।

পরকীয়া সম্পর্কের মধ্যে যতোই দুর্নিবার আকর্ষণ, রোমাঞ্চ আর আনন্দের আতিশয্য থাকুক, সেখানে সততা নেই বলে তা ‘প্রেম’ হতে পারে না। প্রেম হতে হবে নিষ্কলুষ-নির্দোষ; অসৎ সম্পর্ক কখনো ‘প্রেম’ হতে পারে না। তাই পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে রোম্যান্টিসিজমে ভোগার কারণ নেই এবং এমন অসৎ সম্পর্কের মধ্যে গ্ল্যামার কিংবা সৃষ্টিশীলতা আরোপের চেষ্টা নিরর্থক।

পরকীয়া কেবলই প্রতারণা; প্রেম নয়।

লেখক: শিক্ষক, লেখক ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।