বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। দেশগুলো নিজেদের মতো করে দিবসটি উদযাপন করে।
নারী দিবস পালনকে কেন্দ্র করে বিতর্কও রয়েছে। কেউ মনে করেন, নারীর প্রাপ্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে মনে করিয়ে দিতে নারী দিবস পালনের দরকার রয়েছে। অন্যরা মনে করেন, নারীদের জন্য আলাদা দিবস উদযাপন করার মাধ্যমেই বরং নারীদের দুর্বল করে দেখা হচ্ছে।
আপাতদৃষ্টিতে দুই পক্ষেরই বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত। তবে, এখনো যেহেতু নারীর প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি, তাই নারী দিবসকে কেন্দ্র করে বছরে একটি দিনও যদি সমাজের ভাবনায় বিষয়টি সচেতনভাবে উঠে আসে, তাতে ক্ষতি তো নেই!
নারী দিবসকে কেন্দ্র করে নানাজনের নানা ভাবনা থাকলেও প্রকৃত অর্থে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে নারীর অর্জন উদযাপন করা হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল লক্ষ্য। এর পাশাপাশি সমাজে নারীর সমতার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে এ লক্ষ্যে সচেতনতা বাড়ানোও এর আরেকটি উদ্দেশ্য।
এ বছর নারী দিবসের মূল ভাবনা বা থিম হলো 'পক্ষপাত ভাঙা' (#ব্রেকদ্যবায়াস)। দ্য ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ডে ওয়েবসাইটে জেন্ডার-সমতাভিত্তিক একটি বিশ্ব নির্মাণের আহ্বান জানানো হয়েছে যেখানে কোনো পক্ষপাত থাকবে না এবং নারীরা সব ধরনের স্টেরিওটাইপ ও বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকবে। জাতিসংঘের থিম হলো 'টেকসই আগামীর জন্য আজ জেন্ডার সমতা' (জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি টুডে ফর আ সাসটেইনেবল টুমরো)। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে একটি টেকসই পৃথিবী গড়তে হলে এখনই নারীর প্রতি বৈষম্য ও পুরুষের প্রতি পক্ষপাত দূর করে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে হবে।
এ বছর নারী দিবসের থিম কালার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে তিনটি রঙ : বেগুনি, সবুজ ও সাদা। এর মধ্যে বেগুনিকে বেছে নেওয়া হয়েছে ন্যায় ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে, সবুজকে আশাবাদের জন্য এবং সাদা এখানে পবিত্রতা নির্দেশ করছে। অবশ্য নারীর সঙ্গে সবসময় 'পবিত্রতা'র এই ধারণাটি আরোপ করা যে বিতর্কিত, ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ডে ওয়েবসাইটে তা স্বীকারও করা হয়েছে।
সব মিলে তাহলে কী পাচ্ছি আমরা?
নারীবাদী আন্দোলনের চার ধারার প্রথমটিতে (ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজম; ১৯০০-১৯৫৯) মূলত সম্পত্তি ও রাজনীতিতে নারীর সমান অধিকারের দাবি তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় ধারায় (সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম; শুরু হয় ১৯৬০ সালে) লিঙ্গ বৈষম্য, আইনি বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন এবং নিজের শরীর, যৌনতা ও প্রজনন প্রক্রিয়ায় নারীর মতাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি সামনে আসে। তৃতীয় ধারার নারীবাদী আন্দোলনে (থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম; শুরু হয় গত শতাব্দির নব্বইয়ের দশকে : ১৯৯০-২০০০ সাল) উঠে আসে নারীর ব্যক্তিসত্তার প্রসঙ্গ। ২০০০ সালের পর থেকে শুরু হওয়া চতুর্থ ধারায় (ফোর্থ ওয়েভ) যে আন্দোলন চলছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে লিঙ্গভিত্তিক হয়রানি এবং নারী-বিদ্বেষ বিরোধী জনমত গঠনের প্রচেষ্টা।
এই চারটি ধারায় জীবন ও জীবিকার নানা ক্ষেত্রে নিজের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা আদায়ে নারীকে লড়াই করতে হয়েছে এবং এই লড়াই এখনো চলমান। এই বিষয়গুলোতে নারীর অর্জন অনেক; তবে তা সম্পূর্ণ তো নয়ই, একে যথেষ্টও বলা যায় না। তাই, নারীর বিরুদ্ধে চলমান বৈষম্য ও সহিংসতা দূর করতে হবে এবং সমাজের সব মানুষের মধ্যে অসাম্য দূর করতে হবে। এজন্য আমাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব পরিসরে নারীরা যেন পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষ যেন স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে পারে, এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন কখনোই অর্জন করা সম্ভব হবে না।
নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা বা বৈরি থাকলে চলবে না; একে অন্যের সহযোগী হতে হবে। পুরুষকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নারীকে পুরুষের চেয়ে 'দুর্বল ও অধম' ভাবার একটি চর্চা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রয়েছে; এর বদল দরকার। পুরুষ কেবল প্রেমেই নারীর কাছে আত্মসমর্পণ করে, এ ছাড়া অন্যকিছুতে নয়; জীবনে নয়, কর্মে নয়। কিন্তু পরিবারে-সমাজে-রাষ্ট্রে নারীর তুলনাতীত ভূমিকা বা অবদানের কথা স্বীকার করে তার কাছে পুরুষের শ্রদ্ধায় আনত হওয়া উচিৎ। নারীর কাছে শুধু প্রেমে নয়, শ্রদ্ধায়ও নতজানু হওয়া চাই। এই বোধ যেদিন পুরুষের হবে, সমাজের হবে, সেদিন সমাজ বদলাবে- এর আগে নয়।
এজন্য আমাদের সবাইকে নিজেদের প্রথাগত ও অনুদার মানসিকতা বদলাতে হবে। আর এজন্য সবার আগে দরকার এ বিষয়ে সচেতনতা; হোক না তা নারী দিবসকে কেন্দ্র করেই!
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা: মিডিয়াস্কুল ডট এক্সওয়াইজেড।