শীতল যুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধ কার্যত সমাপ্ত! বিশ শতকের শেষ দিকেই বিশ্ব রাজনীতিতে এমন বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। যে কারণে বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণে কেন্দ্রে চলে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
হঠাৎ করেই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা সেই হিসাব পাল্টে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে ইউক্রেন যোগদানে তৎপরতা শুরু করলে রাশিয়া দেশটিকে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। শেষ পর্যন্ত একটা ইস্যুও পেয়ে যায়। রুশপন্থি বিদ্রোহীদের দুই অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে গত ২১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
একদিকে ন্যাটো সাবেক অটোমান সাম্রাজ্য থেকে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত তাদের বলয় বাড়াতে তৎপরতা শুরু করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার সোভিয়েতভুক্ত রাষ্ট্রসমূহে প্রভাব বলয় বৃদ্ধিতে তৎপরতা শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে ইউক্রেনে এই সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। পশ্চিমা বিশ্ব সরাসরি এই যুদ্ধে না জড়ালেও রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। এমনকি অনেক দেশ সামরিক সরঞ্জাম দিয়েও সহযোগিতা করছে ইউক্রেনকে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিনের মধ্যেই পুতিন ইউক্রেন দখলের আশা করলেও যুদ্ধের এক চোরাবালিতে ঢুকে গেছে রাশিয়া। যেখানে তাদের বহু সেনা নিহতও হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন বিশ্ব রাজনীতিতে ফের স্নায়ুযুদ্ধকেও ফিরিয়ে এনেছে। ইতোমধ্যেই এই যুদ্ধে কোন দেশ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়াও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তো বটেই সাধারণ পরিষদেও ভোটের হিসাব-নিকাশকে গুরুত্ব দিচ্ছে দুই পক্ষই। এমনকি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের একটি উক্তিও বাংলাদেশে রুশ দূতাবাসের নজর এড়াতে পারেনি। বিশ্ব রাজনীতির এই মেরুকরণে বাকি বিশ্বের জন্য একটা নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করার প্রাসঙ্গিকতা ফের ফিরে আসছে।
গত শতকের মাঝামাঝিতে মার্কিন-সেভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই বলয়ের বাইরের দেশগুলো দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের বাইরে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নিরপেক্ষ নীতি বেছে নিয়েছিল। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, ঘানার প্রেসিডেন্ট কাওয়ামে নক্রমা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ড. সুকর্ন ছিলেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) উদ্যোক্তা। ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং সম্মেলনে মূলত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের কাজ শুরু হয়। যদিও ১৯৬১ সালে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনকেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে দেখা হয়। সেই সম্মেলনে তৃতীয় এই জোটের সদস্যদের জন্য পাঁচটি আচরণবিধি তৈরি করা হয়। যার মধ্যে স্বাধীনভাবে বিদেশনীতি পরিচালনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সহাবস্থান মেনে নেওয়া, দুই সামরিক শিবিরের অধীন কোনো জোটে যোগ না দেওয়া এবং স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার মতো বিষয়গুলো ছিল।
ন্যামের কার্যকারিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। অনেক সদস্য দেশের বিরুদ্ধে বিশেষ বলয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ার অভিযোগ ছিল। অনেকে এ আন্দোলনকে অকার্যকর হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তদুপরি স্নায়ুযুদ্ধকালে এই সংস্থাটি আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। প্রথমে আমেরিকা বিষয়টিকে ভালোভাবে না নিলেও পরে তারাও এ আন্দোলনকে ইতিবাচকভাবে নেয়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এই জোট আলোচনার অনেকটাই বাইরে থাকে। তবে ন্যাম বিলুপ্ত হয়নি। বর্তমানে এই জোটের সদস্য সংখ্যা ১২০টি। জাতিসংঘের বাইরে এটিই সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা। তিন বছর পর পর জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরই ১৯৭৩ সালে এই সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ওই বছর আলজেরিয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। পরের বছর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের ক্ষেত্রে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
সবশেষ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে ইউক্রেনে হামলার নিন্দা জানিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাস হওয়া প্রস্তাবে ভোটের সমীকরণ থেকে জোট নিরপেক্ষতার প্রাসঙ্গিকতা বোঝা যায়। কারণ ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদে এই প্রস্তাবের বিপক্ষে মাত্র পাঁচটি ও পক্ষে ১৪১টি দেশ ভোট দেয়। রাশিয়া ছাড়া বিপক্ষে ভোট দেয় কেবল বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া ও সিরিয়া। অথচ সাবেক সোভিয়েতভূক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যাই ১৫টি। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইরান, ইরাকসহ ৩৫টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে। ভোটের এই সমীকরণই বলে পাশ্চাত্য বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার এই লড়াইয়ে অনেক দেশই নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এমনকি ন্যাটোভূক্ত দেশের মধ্যে তুরস্ক ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। ইতোমধ্যে তুরস্কে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠকও হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশ, এমনকি সৌদি আরবের মতো মার্কিন প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকা দেশও থাকতে চাইছে মধ্যস্থতার ভূমিকায়। এ অবস্থায় দুই বৃহৎ শক্তির বলয়ে টানার প্রচেষ্টা ও নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় ন্যামকে কার্যকর ভূমিকায় রাখতে ছোট অনেক দেশই নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। হয়তো সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করে অচিরেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে ফের সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাবে।
খাদেমুল ইসলাম: আইনজীবী ও বাংলানিউজের আদালত প্রতিবেদক
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২২
এমজেএফ