করোনা মহামারির রেশ চলছে এখনো, এর কারণে মানুষ এমনিতেই বহুবিধ কষ্টে আছে। এর ওপর যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
তাছাড়া আর দু’সপ্তাহ পরেই রহমত মাগফেরাত নাজাতের বার্তাবাহক পবিত্র রমজান মাস। বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে রমজানের বিশেষত্ব অসীম।
বেশ কিছুদিন থেকে সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীন। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। বিভিন্ন সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ানোর কথাও বারংবার উঠে এসছে এসব প্রতিবেদনে। এত এত সংবাদের পরও সিন্ডিকেট ভাঙা দূরে থাক, বরঞ্চ সিন্ডিকেট যেন দিন দিন বটগাছে রূপ নিচ্ছে।
একদিকে সাধারণ মানুষের হাহুতাশ বাড়ছে, অন্যদিকে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষও বাড়ছে সমানে। মাঝখানে লাভবান হচ্ছে শুধুই অসাধু সিন্ডিকেটগুলো।
আওয়ামী লীগের সরকার যখন ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে পেরেছিল। তাতে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্টও ছিল। কিন্তু গতবার ২০১৮ সালে সরকার গঠনের পর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়া যে শুরু হয়েছে, তা যেন আর থামছেই না। তাছাড়া বাজার মনিটরিং ঢিলেঢালা বা নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না।
বিগত কয়েক বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাল ডাল পেঁয়াজ রসুন তেলসহ ইত্যাদি নিত্যপণ্যের দাম আগের দাম থেকে বেড়ে দ্বিগুণ পর্যন্ত হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে দ্রব্যমূল্যের পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সরকার গঠনের বছর দুয়েক পর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরই আন্তরিক মানুষের সাবলীল সুন্দর জীবন যাপনের প্রতি। কিন্তু একটি অসাধু চক্র বারবার সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালায়। এই কাজে অসাধু চক্রটিকে অধিকাংশে সফলও বলা চলে। তাই সরকারের উচিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই চক্রটির মূলোৎপাটন করে শিকড় উপড়ে ফেলা।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং সংবাদ মাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, যে চিকন চালের দাম ২০০৯ সালে প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা ছিল, সে চালের দাম বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭-৭৫ টাকা। মোটা চালের দাম ছিল ২২-২৩ টাকা, বর্তমানে দাম বেড়ে ৫০-৫৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ডালের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি মসুর ডালের দাম ছিল ৮০-৯০ টাকা, বর্তমানে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি ১০০-১১০ টাকা। আমদানিকৃত মসুর ডালের দাম ছিল ২০০৯ সালে ৫০-৬০ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫-৯০ টাকা। ২০০৯ সালে মুগ ডালের দাম ছিল ৮৫-১০০ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০-১৪০ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি আটার দাম ছিল ২৭-২৯ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮-৪৬ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি ময়দার দাম ছিল ৩৫-৩৭ টাকা, বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-৫৫ টাকা।
পেঁয়াজ- ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০-৪৪ টাকা, বর্তমানে বেড়ে সে পেঁয়াজ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়। আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৮-৩৪ টাকা, বর্তমানে সে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরপরও মাঝেমধ্যে পেঁয়াজের বাজার অস্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।
রসুন- এক কেজি রসুনের দাম ছিল ৮০-৮৫ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে কেজি ১১০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০-৭৩ টাকা। বর্তমানে সেই তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫-১৮০ টাকায়। যদিও সরকার বলছে কেজি ১৬৮ টাকার ওপরে যারা দাম নিবে সেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
চিনি- ২০০৯ সালে আমদানিকৃত এক কেজি চিনির দাম ছিল ৫২-৫৪ টাকা, বর্তমানে সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ১০০ টাকায়।
ডিম-২০০৯ সালে দেশি মুরগির ডিম হালি ছিল ৩২-৩৪ টাকা, সেটা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়।
ফার্মের মুরগির ডিমের (লাল) দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৫-২৬ টাকা, বর্তমানে হালি ৪০-৪৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গরুর মাংস- গরুর মাংসের কেজিপ্রতি ২০০৯ সালে দাম ছিল ২২০-২৩০ টাকা, বর্তমানে প্রতি কেজি (হাড়সহ মাংস) বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকায়। আর হাড়ছাড়া প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকায়।
গরুর মাংস এখন অঘোষিতভাবে অনেকটা ওপরতলার মানুষদের খাবার হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ এখন মেজবান কিংবা অনুষ্ঠানে গরুর মাংস খেতে পান।
তাছাড়া উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে শাক সবজিসহ উৎপাদনশীল প্রতিটি পণের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। অথচ উৎপাদনকারী কৃষক তাদের ন্যায্যমূল্য থেকে সর্বদা বঞ্চিত হয়। সেখানেও মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেশ তৎপর। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা তেমন চোখে পড়ে না।
তার ওপর বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল/সিলিন্ডার খরচ, গাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা খরচ বিভিন্ন সেবা প্রাত্যহিক নানা খরচসহ জীবন যাপন সংশ্লিষ্ট সকল খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ।
আগে যেখানে ২০ হাজার টাকা বেতনের একজন চাকরিজীবি টেনেটুনে সংসার চালাতে পারতেন, এখন উল্টো ৫-১০ হাজার টাকা প্রতিমাসে লোন হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। পারিবারিক কলহ বাড়ছে। ভেঙে পড়ছে পারিবারিক সামাজিক চেইন।
দু’সপ্তাহ পরেই পবিত্র রমজান। আরবসহ সারা বিশ্বে পবিত্র রমজানকে কেন্দ্র করে রোজাদারদের সম্মানে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ৫০-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেন। বিভিন্ন দেশে রোজাদারদের ইফতার-সাহরি খাওয়ানো হয় বিনামূল্যে নেকির উদ্দেশ্যে। আর তার ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। দেশে রমজান এলেই সবকিছুর দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রমজানে যেসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে রোজাদারদের জিম্মি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় তারাও অধিকাংশ মুসলমান।
মুসলমান হিসেবে হলেও এহেন গর্হিত অনৈসলামিক কাজ হতে বিরত থাকা উচিত এসব মুসলমান ব্যবসায়ীদের।
সরকারের প্রতি অনুরোধ, সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে অতি দ্রুত সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে পণ্য সরবরাহ বাড়ানো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা, রমজান রিলেটেড পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো, মজুদদারী কঠোরভাবে দমন করা, বাজার মনিটরিং জোরদার করা, অসম প্রতিযোগিতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, একক কোন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিকট ব্যবসার বিশেষ সুবিধা না দেওয়া, কৃষক টু ভোক্তার একটি শক্তিশালী চেইন তৈরিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা, অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়াসহ সিন্ডিকেটে জড়িতদের লাইসেন্স বাতিল করে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে জেল জরিমানার বিধান নিশ্চিত করতে পারলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমে জনমনে স্বস্তি আসতে পারে। অন্যথায় ‘যেই লাউ সেই কদুই’ থেকে যাবে। সাধারণ মানুষ নীরবে কান্না করেই যাবে।