ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিচারাধীন বিষয়ে রাজনীতিবিদের মন্তব্য বন্ধে নির্দেশনা চাই

এ কে এম রিপন আনসারী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১২
বিচারাধীন বিষয়ে রাজনীতিবিদের মন্তব্য বন্ধে নির্দেশনা চাই

ভুল আর অন্যায় দুটোই অপরাধ। আইন অনুসারে প্রত্যেকটি অপরাধ শাস্তিযোগ্য।

বিচারের জন্য অপরাধের শ্রেণী বিভাগ করেই সংবিধান ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুফ করতে পারেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতির পদটি নিরপেক্ষ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে সরকার গঠিত হয় এবং রাষ্ট্রপতিও নির্বাচিত হন। সরকারের আজ্ঞাবহ ব্যক্তি ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং রাজনৈতিক দল বা জোট পরিচালিত সরকার সমর্থিত ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির আসন পান।

বাংলাদেশের সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীর (পঞ্চদশ সংশোধনী) পর যে সংবিধান দিয়ে রাষ্ট্র চলছে সে সংবিধানের ৯৪ নং অনুচ্ছেদ বলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৯৫(১)  বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন। এই বিচারকগণ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীন আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকার্য পরিচালনা করিবেন। কিন্তু সংবিধানের ২২ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন।

আমরা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক। সংবিধান হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় আইন। আমরা আইন ও সংবিধানের প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল। সংবিধানের সমালোচনা করার এখতিয়ার আমাদের নেই। কারণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরকার গঠন করে সংবিধান তৈরি করেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেন। এই মেয়াদের মধ্যে জনগণের মতামত পরিবর্তনের সূযোগ নেই। আবার জনপ্রতিনিধিদের ভোট বিহীন ক্ষমতার লোভ যদি বেড়ে যায় তবে জননেতাদের ঝগড়া-বিবাদের মাঝে অজনপ্রতিনিধিরা সরকার চালানো শুরু করেন। অজনপ্রতিনিধিরা জনপ্রতিনিধিদের মারধর করে নির্যাতন করেন। বিশ্বে এমন রাষ্ট্র আছে কিনা আমার জানা নেই যেখানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত দুই জন সাবেক সরকার প্রধানকে এক যোগে জেলে রেখে অজনপ্রতিনিধিরা দেশ শাসন করেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা যখন ক্ষমতার চেয়ারে বসেন তখন ভুলে যান বিরোধী দলে থাকার কথা। যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা মিডিয়ার সাথে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। আবার যখন সরকারি দলে যান তখন মিডিয়াকে প্রতিপক্ষ মনে করেন। এই ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে গণতন্ত্র হারিয়ে যাওয়ার আশংকা থেকেই যাবে।

মঙ্গলবার সাগর-রুনি হত্যা মামলার বিচার সংক্রান্তে মহামান্য উচ্চ আদালতে দায়েরকৃত একটি রিট মামলার নির্দেশনাসহ আদেশকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েছি। বিচারাধীন বিষয়ে মিডিয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আদালতের এই ধরনের আদেশ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুক আমরা প্রত্যাশা করি। কিন্তু আরেকটি আশাবাদ ব্যক্ত করি, বিজ্ঞ আদালত তদন্তাধীন কোন মামলা সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের লাগামহীন অযাচিত মন্তব্য বন্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার পথ আরো সুগম হবে।

অনেক কথা আমরা জানি, বুঝি কিন্তু অনুভব করি না। ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা মনে করেন, মিডিয়া সব সময় আমাদের প্রশংসা করুক। ইতিবাচক আলোচন করলে খুশি কিন্তু নেতিবাচক আলোচনা করলে ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রবণতা এখন প্রতিষ্ঠিত। একদিন যদি সকল মিডিয়া বন্ধ থাকে তবে দেশের সাধারণ মানুষ কি করবেন তা জরিপ করে দেখুন। বাংলাদেশে এমন রাজনৈতিক দল এখনো তৈরি হয়নি যে দলের আহবানে যে কোন মুহুর্তে সরকার পতন হতে পারে। আমরা দেখেছি, বিরোধী দল বলেছেন, ৩০ এপ্রিল সরকার পতন হবে। আমরা দেখছি, বিরোধী দল কর্তৃক ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারকে সময় দেয়ার হুশিয়ারি। কিন্তু দুই সময়ের বিরোধী দলের হুসিয়ারির পর নির্বিঘ্নে সরকার দুটো পূর্ণ মেয়াদ অতিক্রম করতে পেরেছে।

কোন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তদন্ত শুরুর আগেই সরকারি দল বলে বিরোধী দল জড়িত আর বিরোধী দল বলে সরকারি দল জড়িত। বিচারের অপেক্ষা না করে তদন্তকালেই পরস্পরকে দোষারোপের সংস্কৃতি ন্যায় বিচারকে প্রভাবিত করার রীতিতে পরিণত হয়েছে।

এই সব ঘটনার কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে মিডিয়া।

মিডিয়ার কোন কর্মী এই দেশের সরকার প্রধান হয়নি। মিডিয়ার লোককে মেধার ভিত্তিতে কোন সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করা হয়নি। প্রতিমুহুর্তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যে মিডিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত হয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে কাজ করে সেই মিডিয়াকে বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা বীরত্ব প্রদর্শন নয়। পাহারাদারকে সরিয়ে দিলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় মিডিয়াকে সরিয়ে দিলে সে পরিস্থিতিই হবে। অতি প্রশংসা যে বিপদের অশনি সংকেত তা আমরা বুঝি না। সমালোচনা হলে আত্মশুদ্ধির সূযোগ সৃষ্টি হয় এই কথাটা যারা বক্তৃতা করে বলেন তারাই মানেন না।

স্কুল জীবনে একজন বৃদ্ধ মানুষ একদিন আমাকে একটি গল্প শুনিয়েছিলেন। গল্পের সারাংশটি এমন ছিল যে, রাজদরবারে রাজার আশে পাশে চাটুকাররা থাকেন। সব সময় রাজাকে খুশি রাখতে প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন সবাই। আর রাজাও মনে করলেন, রাজ্যজুড়ে শান্তির অভাব নেই। আমার এত লোকের প্রয়োজন কি। একদিন রাজা চাটুকারদের কথায় সকল বিশ্বস্ত লোকজনকে চাকরি থেকে সরিয়ে দিলেন। পাহারাদাররাও বাদ পড়লেন না। হঠাৎ একদিন রাজদরবার দখল হয়ে গেলো। যে সব পাহারাদার রাজার কাছে রাজ্যের ভালমন্দ সংবাদ দিতেন, ষড়যন্ত্রের গোপন খবরও রাজাকে জানাতেন তাদের চাকরি না থাকায় অবশেষে রাজাই রাজ্য হারালেন।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাংবাদিক রাষ্ট্রের পাহারাদারের মতই কাজ করেন। মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্রের ভালমন্দ সংবাদ জেনে থাকেন। এই সকল সংবাদ পর্যালোচনা করে রাষ্ট্রের মালিকরা পরবর্তিতে নেতা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন। মিডিয়াকে ছাড়া রাষ্ট্র অন্ধকার হয়ে যাবে। জনগণকে অন্ধকারে রেখে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। তাই শুধু ভাল নয়, ভাল মন্দ দুই ধরনের সংবাদই প্রয়োজন। ভুলগুলো ধরা পড়লে সংশোধনের সূযোগ সৃষ্টি হয়। কোন রোগের লক্ষণ ধরা পড়লে একটু চিকিৎসাতেই নিরাময় সহজ হয়। আর রোগের উপশম ধরা না পড়লে দূরারোগ্য রোগের সম্ভাবনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়।

তাই সাগর-রুনি হত্যা মামলাটি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে রাজনীতিবিদদের তদন্ত প্রভাবিত মন্তব্য বন্ধে জাতি আদালতের নির্দেশনা আশা করেন।

এ কে এম রিপন আনসারী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

বাংলাদেশ সময় ১২০০ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।