ঢাকা, রবিবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জুন ২০২৪, ২২ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

লগি, বৈঠার মহাসমুদ্র!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১২
লগি, বৈঠার মহাসমুদ্র!

একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভা কাভার করেছেন এমন একজন সাংবাদিক বললেন, জামায়াতিরা যে ২০০৬ সালের ঢাকার লগি-বৈঠার কথা বারবার করে বলে, এর নেপথ্যের বেদনা কিন্তু ৭ মার্চ। কারণ সেদিনের সেই মহাসমুদ্রে লগি-বৈঠা হাতে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মাঝি-মাল্লাসহ এতো লাখো জনতা অংশ নিয়েছিল যে সত্তরের নির্বাচনের পর সেদিনেই জামায়াতিসহ পাকিস্তানপন্থি সব পুরোপুরি গণবিচ্ছিন্ন খড়কুঠোর মতো ভেসে যায়।

ওই সময় ঢাকায় অবস্থান করছিলেন শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক। এদের একজন নিউইয়র্কার পত্রিকার সাংবাদিক ভিক্টর চেস জনসভাস্থলে ওই সাংবাদিককে উপহাস করে বলেন, তোমাদের লোকজন এসব লগি-বৈঠা দিয়ে পাকিস্তানিদের কামান ঠেকাবে কিভাবে! তথ্যদাতা সাংবাদিক বয়সে তখন তরুণ। মার্কিন সাংবাদিকের বক্তব্য শুনে মনে মনে গালি দিয়ে ওঠেন, তুমি ব্যাটা সিআইএর দালাল! তৎকালীন অবজারভারের সাংবাদিক কেজি মুস্তাফা, এবিএম মূসা, পূর্বদেশের ফয়েজ আহমদ, দৈনিক পাকিস্তানের নির্মল সেন, সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমদ, হেদায়েত হোসেন মোরশেদ, আজাদের আহমেদ নূরে আলম, সংবাদের আমিনুল হক বাদশা, ইত্তেফাকের আমির হোসেনসহ আরো অনেক সাংবাদিক ঐতিহাসিক জনসভাটি কাভার করেন। তথ্যদাতা সাংবাদিক নিজে বিষয়গুলো লিখবেন তাই এখানে নাম উল্লেখ করে কিছু বলতে চাননি।

কত মানুষ এসেছিল ৭ মার্চের জনসভার ভাষণ শুনতে? এর জবাবে বলা হয়, সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ঢাকার জনসংখ্যা তখন সাড়ে তিন লাখ, চার লাখের বেশি ছিল না। কিন্তু সেদিন ঢাকায় ছিল, অথচ জনসভায় যায়নি, এমন কেউ ছিলেন কিনা তা বলা কঠিন। ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জনসভায় লোক আসেন। বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে চারদিক থেকে স্রোতের মতো লোক আসছিলেন। তাদের সবার হাতেই ছিল লগি-বৈঠা, বাঁশের লাঠি ইত্যাদি। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তথা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান ছিল বিশাল খোলা একটি ময়দান। এখানে ঘোড়দৌড় হতো। পুরো রেসকোর্স কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। প্রেসক্লাব, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শুরু করে শাহবাগ, রমনা পার্ক, কাকরাইল সব এলাকা জুড়েই ছিল শুধু মানুষ আর মানুষ। দুপুরের পর বঙ্গবন্ধু জনসভাস্থলে আসেন। তাকে নিয়ে আসেন আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসবক লীগের বিশাল একটি দল। বঙ্গবন্ধু এসেছেন, এটি জানার সঙ্গে সঙ্গে জনতা লগি-বৈঠা উঁচিয়ে ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘আপোস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, এসব স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। অনেক সময় ধরে চলতে থাকে জনসমুদ্রের গর্জন। জনতাকে শান্ত করতে বঙ্গবন্ধুকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আবার তর্জনি উঁচিয়ে তিনি যখন বক্তব্য শুরু করেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো আশ্চর্য নীরব হয়ে যায় জনতা।

অতঃপর মঞ্চে আসলেন নেতা—শুরু করলেন ২২ মিনিটের তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম, ঐতিহাসিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধু খুব সাবলীল ভঙ্গিতে তার বক্তৃতা শুরু করেন । বঙ্গবন্ধু বলেন, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে’। শুরুতেই তার এমন আবেগস্পর্শী সূচনায় জনসমুদ্র বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। জনতার কামনা ছিল সেখানেই সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেবেন বঙ্গবন্ধু। সাংবাদিকদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ গুজব ছিল। এমন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ-ক্র্যাকডাউন শুরু করে দেবে এমন একটি গুজব ছিল বাতাসে। জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ধারাবাহিক প্রয়োজনীয় সব কথাই বলেছেন বঙ্গবন্ধু। বলেছেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে...’, ‘আমি যদি আর নির্দেশ দিবার নাও পারি...’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল...’। এবং সবশেষে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা’। তার প্রতিটি ঘোষণার সঙ্গে লগি-বৈঠা উঁচিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেছে জনতা। কারো কিছুতেই দ্বিমত অথবা অতৃপ্তি-অসন্তোষ ছিল না। মূলত গণবিদ্রোহ ঘটে যায় সেদিনই। পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসূত্রটি ছিঁড়ে যায়। নতুন একটি রাষ্ট্রের পথে হাঁটা শুরু করে দেয় দেশের মানুষ।

৭ মার্চের ভাষণের একটি গল্প আমাকে বলেছিলেন অগ্রজ সাংবাদিক নির্মল সেন। ৭ মার্চ ভাষণের রাতে তারা কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। নির্মল সেন বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বলেন, `এ ভাষণ আপনি দিলেন কি করে। এটি তো আপনার ভাষণ না। এটি তো আমাদের বামপন্থিদের ভাষণ। ` বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ জবাব দিয়ে বলেন, ‘নির্মল, তোমরা বামপন্থিরা মনে করো তোমরাই খালি পড়াশুনা করো। আমরা কিছু করি না! সারারাত বারান্দা দিয়া হাঁটছি আর একটার পর একটা লাইন সাজাইছি’! ৭ মার্চের ভাষণের পুরো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এটি ছিল পুরোপুরি একটি সময়ের ভাষণ। একাত্তরের মার্চের অগ্নিগর্ভা পুরো সময়টিই যেন ওই ভাষণে উঠে এসেছে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে রেসকোর্সের জনতা তথা জাতির যা যা চাওয়ার-অপেক্ষার এর পুরোটাই স্বতঃস্ফূর্ত উঠে এসেছে। তেমন একটি সময় ছাড়া যেন এমন একটি ভাষণ দেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব না।

সেই রেসকোর্সেই পরে পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়। স্বাধীনতার পর ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সফরে এসে ভাষণ দেন সেই রেসকোর্সেই। কিন্তু সেই রেসকোর্স কেন পরে হারিয়ে গেল? রেসকোর্সের নাম পাল্টে বঙ্গবন্ধুই কেন রাখলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান? এ ব্যাপারে তথ্যদাতা সূত্রটির মতে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মদ-জুয়া এসব নিষিদ্ধ করেন। ঘোড়দৌড়ের সঙ্গে যেহেতু জুয়া জড়িত তাই সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর নতুন নামকরণকৃত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথমে লাগানো হয় হাজার হাজার নারকেল গাছ। বরিশাল-ফরিদপুর অঞ্চলের গ্রামগুলো সুপারি-নারকেল গাছে পরিপূর্ণ-ছায়াশীতল। শৈশবের স্মৃতি থেকেই বঙ্গবন্ধু হয়তো ঢাকার বুকের উদ্যানটিতে এত নারকেল গাছ লাগান। এরপর জিয়াউর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি অংশ জুড়ে সৃষ্টি করেন শিশুপার্ক। জিয়ার এখানে শিশুপার্ক প্রতিষ্ঠার পেছনে রেসকোর্স তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস থামাচাপা দেবার ষড়যন্ত্র ছিল বলে বিতর্ক আছে। এ ব্যাপারে সূত্রটির বক্তব্য জিয়ার মনের কথা বোঝা মুশকিল। কিন্তু মুখে তিনি কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। বিচিত্রার ‘একটি জাতির জন্ম’ প্রবন্ধ আর দৈনিক বাংলার ইন্টারভ্যুতে তিনি স্পষ্ট বলেছেন ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার সবদিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি পার্লামেন্টের প্রথম ভাষণেও তিনি ‘২৭ মার্চ কালুরঘাটের বেতার ঘোষণা’র কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানেও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। কারণ জিয়াও জানতেন আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছে এবং স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। সেটি ২৭ মার্চ না। একবার মতিউর রহমান চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে ‘শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তার মূল্যায়ন জানতে চান। জবাবে জিয়া বলেন, মতি সাহেব আমি কিভাবে তার আলাদা করে মূল্যায়ন করবো। ইতিহাসই তো তার স্থান ইতিহাসে নির্ধারিত করে দিয়ে গেছে। এর জন্য জিয়া তখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউর নাম পাল্টানোর একটি প্রস্তাবেও সায় দেননি।

ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় : ২০৩১ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।