ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিদ্যালয় পর্যায় থেকে ঐচ্ছিক দ্বি-ভাষিক বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা

ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৪ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২২
বিদ্যালয় পর্যায় থেকে ঐচ্ছিক দ্বি-ভাষিক বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা

প্রত্যেক দেশেরই একটি ভাষানীতি থাকে, যাতে জাতীয়, ধ্রুপদী, নৃগোষ্ঠীগত ও বিদেশি ভাষার গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই।

যে কারণে দেশে জাতীয়, ধ্রুপদী, নৃগোষ্ঠীগত ও বিদেশি ভাষার পরস্পর মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। কিন্তু দেশে ভাষানীতির এই অনুপস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য কাল হয়ে উঠতে পারে। এর কারণ খুঁজে পাওয়া যায় ভাষার স্বরূপ ও প্রায়োগিকতা বিশ্লেষণে। সাধারণ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ভাষা হলো নিছক সংজ্ঞাপনের মাধ্যম। কিন্তু আদতে ভাষা কেবলমাত্র সংজ্ঞাপনের মাধ্যম নয়। বরং ভাষা হলো একটি সংযুতিপ্রসূত সংজ্ঞাপনের মাধ্যম, যা প্রেক্ষাপটভেদে নানারকম প্রভাবক হিসেবে অবতীর্ণ হয়। বিষয়টি বোধগম্য করার জন্য নিম্নে ভিন্ন দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষার স্বরূপ, উপযোগিতা ও প্র্রায়োগিকতা সম্পর্কে একটি বর্ণনা তুলে ধরা হলো: 

জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―
ক) বৃহত্তর জাতীয় সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম
খ) সামাজিকীকরণের মাধ্যম
গ) জাতীয়তাবাদের প্রতীক
ঘ) সভ্যতার বাহন
ঙ) সামাজিক সম্পদ ও 
চ) সাংস্কৃতিক সম্পদ।  

অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―
ক) ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার
খ) অন্যের সংস্কৃতিকে কলুষিত করার হাতিয়ার ও 
গ) অন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পরাধীন করার হাতিয়ার।  

ভাষার উক্ত স্বরূপ ও প্রায়োগিকতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভাষা কোনো জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ামক বিশেষ। সেজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশসমূহের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভাষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রয়াসী হয়। অনেক দেশ তাতে সুফল পায়। বাংলাদেশেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে যথাক্রমে সাম্রাজ্যবাদী ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রয়াস ছিলো। এই দুই শাসনামলেই গৃহীত ভাষানীতিসমূহ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী ছিলো। কিন্তু পাকিস্তান শাসনামলে ভাষানীতি প্রশ্নে আন্দোলন শুরু হলে তার পরম্পরায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বিস্মৃত হয়। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব শিক্ষানীতির মাধ্যমে একটি ভাষানীতির রূপকল্প আমাদের কাছে রেখে যায়। ভাষানীতির এই রূপকল্পটি হলো ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদে গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন।  

উল্লেখ্য যে, এই শিক্ষা কমিশনের প্র্রধান ছিলেন বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদা। এই শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে বাংলা ভাষাকে জাতীয় ও রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিয়ে একে শিক্ষার সকল স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। অন্যদিকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর থেকে উপরের স্তর পর্যন্ত ঐচ্ছিক বিদেশি ভাষা প্রবর্তনের সুযোগ রাখা হয়। এখানে বিদেশি ভাষার একটি সংজ্ঞা দেওয়া যাক। বিদেশি ভাষা হলো মাতৃভাষা ব্যতীত যেকোনো ভাষা, যা অন্য দেশে কথিত হয়। তবে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে তার দেশের ভাষাটি বিদেশি ভাষা হতে পারে, যেমন কানাডায় বসবাসকারী কোনো বাঙ্গালীর মাতৃভাষা হলো বাংলা। কিন্তু ইংরেজি ও ফরাসি হলো তার কাছে দেশ ভাষা।  

অবগতির জন্য এ পর্যায়ে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে বিধৃত বিদেশি ভাষা সংক্রান্ত অংশটির অনুলিপি তুলে ধরা হলো। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনটিতে বিদেশি ভাষা সম্পর্কিত বিষয়টি ৪.৬, ৪.৯ এবং ৪.১১ অনুচ্ছেদে বিধৃত রয়েছে, যা নিম্নরূপ:  
 
এই প্রতিবেদনে বিধৃত উপরের অনুচ্ছেদ থেকে যেমনটি দৃষ্ট হচ্ছে যে, এর উদ্দেশ্য ছিলো বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ভিত তৈরি করা এবং এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিচালনায় প্রয়োজনীয় জনশক্তি সৃষ্টি করতে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট সৃষ্টির কথা বলা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে বিদেশি ভাষা শিক্ষা প্রসারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা প্রত্যাহৃত হয়। পরিণামে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষা কার্যক্রম গতিহীন হয়ে পড়ে। যার ফলে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট বিদেশি ভাষা শিক্ষা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়।  

গত অর্ধ শতকে সাংজ্ঞাপনিক ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিস্তৃতির ফলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া গতিশীল হয়েছে। বিশ্বায়ন হলো বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় বিশ্বের অপরাপর দেশসমূহ পরস্পরের সাথে সহযোগিতায় ব্যপৃত রয়েছে, যেনো পরস্পর বিনিময়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে লাভবান হতে পারে। এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে বিদেশি ভাষার প্রায়োগিকতা ও উপযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সম্পর্ক ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেমন বিদেশি ভাষার উপযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনিভাবে ব্যক্তি পর্যায়েও এর উপযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দেশের মানুষ এখন কাজ ও শিক্ষার সন্ধানে উন্নত বিশ্বে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ দেশের মায়া ত্যাগ করে উন্নত জীবনের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হচ্ছে। যে যে উদ্দেশ্যেই বিদেশে গমন করুক না কেন, তার সে দেশের ভাষা জানা প্রয়োজন। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা থাকলে কোনো দেশেই আশানুরূপ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না।

চলমান এ বিশ্বায়নের সঙ্গে যুগপৎভাবে বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে নানা ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষার উপযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নিম্নে তুলে ধরা হলো—

ক. জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসাবে: বাংলাদেশের মানুষ অন্য দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে বিভিন্ন বিদেশি ভাষা, যেমন চীনা, ফরাসি ও জাপানি ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। দেশে শিক্ষা ও গবেষণাকর্মে নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এজমালি মাধ্যম হিসেবে একটি বিদেশি ভাষা, যেমন ইংরজি ও আরবি ব্যবহার করছে। এভাবে এ দেশে জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও আরবিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষার উপযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

খ. কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যম মাধ্যম হিসাবে: এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক সবসময় স্বাভাবিক থাকে না। দুটি ভিন্ন দেশ অথবা বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, আবার সময়ে সময়ে তা শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কে পরিণত হতে পারে। দু’টি ভিন্ন দেশ বা বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ সম্পর্ক নির্ভর করে মূলত আধিপত্য ও অর্থনৈতিক লাভালাভের হিসাবের ওপর। এ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত ইংরেজি ভাষা ব্যবহার হলেও, কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা ইংরেজি ভাষার চেয়ে অধিকতর কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সে বিবেচনায়, জাপান, চীন, রাশিয়া, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় যথাক্রমে জাপানি, চীনা, রুশ, হিন্দি, বর্মি ও থাই ভাষা ইংরেজি ভাষার চেয়ে অধিকতর কার্যকর বিদেশি ভাষা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।

গ. বাণিজ্যিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে: সংজ্ঞাপন মাধ্যমগত প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই অব্যাহত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উঠেপড়ে লেগেছে। যে কারণে বাণিজ্যিক বিনিময় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বাণিজ্যিক বিনিময়ে সাধারণত ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হলেও, বাণিজ্যিক বিনিময়ে ব্যপৃত বিপ্রতীপ দেশের ভাষা বাণিজ্যিক সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ চীন, জাপান ও ফ্রান্সের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে যথাক্রমে চীনা, জাপানি ও ফরাসি ভাষা অধিকতর কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। এভাবে দেশে ইংরেজি ভাষার বিপরীতে বিভিন্ন বিদেশি ভাষার উপযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঘ. সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে: বিভিন্ন দেশে জনমানুষের লৌকিক পর্যায়ে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়। দেশে দেশে শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকরা সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কোনো না কোনো বিদেশি ভাষা ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকরা ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক প্রয়োজনে বিভিন্ন বিদেশি ভাষা, যেমন জাপানি, কোরীয়, মালয়, আরবি, পালি, লাতিন ও সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষা ব্যবহার করেন। এভাবে সীমিত পর্যায়ে হলেও, সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে কিছু অপ্রচলিত বিদেশি ভাষার উপযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে।

ঙ. চাকরি বাজারে প্রবেশের মাধ্যম হিসাবে: বিশ্বায়নের যুগে এক দেশের জনশক্তি অন্য দেশের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্বে বিদেশি জনশক্তির চাহিদা রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। এসব দেশ তৃতীয় বিশ্ব থেকে সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি আমদানি করে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে এসব দেশে দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তি রফতানি হয়। এসব দেশের চাকরির বাজারে প্রবেশ ও সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজ সম্পাদনের জন্য সেসব দেশের ভাষা জানার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এভাবে দেশে আরবি, মালয়, জাপানি ও ইতালীয় ইত্যাদি বিদেশি ভাষা বিদেশে চাকরির বাজারে প্রবেশের মাধ্যম হিসেবে উপযোগিতা প্রমাণিত হয়েছে।

উক্ত আলোচনা থেকে লক্ষণীয়, বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতিতে বিদেশি ভাষার উপযোগিতা ও প্রায়োগিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এই শিক্ষার অনিয়মিত ও অপরিকল্পিত বিস্তার ঘটছে। এই শিক্ষা কার্যক্রম বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের প্রতিষ্ঠানে দৃষ্ট হয়। তার অন্যতম হলো:
১) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়াধীন একাডেমীসমূহে
২) শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন কারিগরী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে
৩) জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে
৪) বিভিন্ন বিদেশি কূটনৈতিক মিশন পরিচালিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহে
৫) English Medium School সমূহে
৬) বিভিন্ন শহরে বা বাজারে অবস্থিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহে 
    
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যদিও বিশ্বায়নে অনেকগুলো বিদেশি ভাষার প্রায়োগিকতা ও উপযোগিতা রয়েছে, তবুও উপযুক্ত ক্ষেত্রে উপযুক্ত বিদেশি ভাষাসমূহকে ব্যবহার না করে, শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষাকে বিশ্বায়নের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইংরেজি ভাষাকে জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্র ভাষা বাংলার চেয়েও অধিকতর মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠাকরণে তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই ধরণের তৎপরতাকে হালাল করতে গত ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার নিয়োজিত শিক্ষা কমিশন শিক্ষানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। এই পরিবর্তনের ফলে কার্যত ইংরেজি ভাষাকে জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার চেয়েও অধিকতর মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা আরোপ করা হয়েছে। অধিকন্তু এই পরিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের বিধৃত বিদেশি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কিত মূলনীতির বিপরীতে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষা চালু করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ দু’টি শিক্ষানীতিতে বিদেশি ভাষার মর্যাদা ও প্রায়োগিকতার কথা কিছু বলা হয়নি। ফলশ্রুতিতে ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে মর্যাদা ও প্রায়োগিতায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। সেজন্য এখন বাংলা ভাষা দাপ্তরিক কার্যক্রম, শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমে উপেক্ষিত হচ্ছে। এভাবে ইংরেজি ভাষাই এখন দেশি ভাষায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। এর ফলাফল স্বরূপ বাংলা ভাষা ও বিদেশি ভাষা- এই উভয় প্রকার ভাষার উপরই ইংরেজি ভাষা আধিপত্যবাদী ভাষা হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে।  

দেশব্যাপী ইংরেজি ভাষার অতিরঞ্জিত ব্যবহারের ফলে দেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচীত হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট বয়ে আনতে পারে। আর এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশে গঠিত প্রথম আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক প্র্রণীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে বিধৃত মূলনীতি অনুসারে দেশে একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত এই বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে, ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ও গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনে ফিরে যেতে। ঐ শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি উন্নতি সহায়ক একটি বিদেশি ভাষানীতি প্রণয়নপূর্বক তার নিরিখে একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার গড়ে তোলা প্রয়োজন।  

প্রস্তাবিত এই বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ধরণ হবে ঐচ্ছিক দ্বিভাষিক দক্ষতা ভিত্তিক বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয় পর্যায় থেকে অনেকগুলো বিদেশি ভাষা ও ধ্রুপদী ভাষা থেকে পছন্দমত ১টি অথবা ২টি বিদেশি ভাষা শিক্ষার জন্য বাছাই করতে পারবে অথবা শিক্ষার জন্য কোনো বিদেশি ভাষাকে বাছাই করা থেকে বিরত থাকতে পারবে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্য বিষয় হিসাবে ইংরেজি ভাষা ঐচ্ছিক বিদেশি ভাষা বিষয়ে পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী ইচ্ছে করলে জাপানি ও ফার্সি-এ দু’টি ভাষাকে যেমন শিক্ষার জন্য গ্রহণ করতে পারবে, তেমনিভাবে আরেকজন হয়তো সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার জন্য গ্রহণ করতে পারবে।  

প্রস্তাবিত এই বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুকরণে প্রয়োজন হলো শিক্ষক, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রয়োজন। আরবি ও ইংরেজি ভাষা ব্যাতীত অন্যান্য বিদেশি ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালুকরণে প্রয়োজনীয় সংস্থানের স্বল্পতা বা অনুপস্থিতি রয়েছে।  প্রয়োজনীয় সংস্থানের এই স্বল্পতা ও অনুপস্থিতি থেকে প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থাটিকে অনেকেই অবাস্তব বলে বর্ণনা করে থাকবেন। কিন্তু স্মর্তব্য যে, আজ থেকে তিন দশক আগে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থারও প্রয়োজনীয় সংস্থানে অনুরূপ স্বল্পতা ও অনুপস্থিতি ছিলো। সে যুগে দেখা গেছে কলেজমসূহে ইংরেজি পড়ানোর মত শিক্ষক ছিলো না। সে অবস্থায় ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস নিতেন বাংলা, আরবি অথবা পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষকগণ। বিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও ইংরেজি পাঠদানের মত শিক্ষকের অভাব রয়েছে।  কাজেই প্রথম শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন মোতাবেক সেই ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন শুরু হলে, বর্তমানে দেশব্যাপী সমস্ত বিদেশি ভাষার শিক্ষাব্যবস্থা সমানভাবে গড়ে উঠতো ও বিস্তৃত হতো এবং বিদেশি ভাষা হিসাবে ইংরেজি ভাষার একক বিস্তৃতির কোনও সুযোগ থাকতো না। কাজেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সংস্থানের স্বল্পতা বা অনুপস্থিতির দোহাই দিয়ে  বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগে ক্ষান্ত দেওয়া এবং একক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার যৌক্তিকতা  নেই।  কাজেই জাতীয় স্বার্থে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত জাতীয় শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষানীতি প্রণয়ন পূর্বক দেশব্যাপী বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।  

এখনে উল্লেখযোগ্য যে, প্রস্তাবিত এই বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় তিন’টি ধারার সংযোজন থাকবে।  
প্রথমত: ভাষাগত দক্ষতার ভিত্তিতে বিদেশি ভাষা (ইংরেজি ভাষা সহ) শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম চালু হবে।  

দ্বিতীয়ত: প্রস্তাব অনুযায়ী দক্ষতা ভিত্তিক উক্ত বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হলে প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষার্থীর এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উত্তীর্ণের সুযোগ থাকলেও, বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে উপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ নির্ভর করবে দক্ষতা অনুযায়ী। অর্থ্যাৎ এখনকার মতো বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসের উত্তীর্ণের সুযোগ থাকলেও, বিদেশি ভাষায় (ইংরেজি সহ) এক ক্লাসের উত্তীর্ণের ভিত্তি হবে দক্ষতার ভিত্তিতে। এই শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে একই ভাষাগত দক্ষতা ক্লাসে বার্ষিক ভিত্তিক বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষার্থী একই দক্ষতা ভিত্তিক ভাষা ক্লাসের শিক্ষার্থী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হবে।   

তৃতীয়ত: এই শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাগত দক্ষতায় পিছিয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা ঐচ্ছিকভাবে নিজেকে ঐ ভাষা কোর্স থেকে প্রত্যাহারের সুযোগ থাকবে। এই প্রত্যাহার বিদ্যালয়ে ঐ শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষাক্রমকে প্রভাবিত করবে না।  

বিদ্যালয় পর্যায় থেকে প্রস্তাবিত এই ঐচ্ছিক দ্বিভাষিক দক্ষতা ভিত্তিক বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলে, চলমান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে কূটনৈতিক, বৈদশিক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে অধিক লাভবান হতে পারবে। অন্যদিকে এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে সমসাময়িককালে সূচীত নেতিবাচক পরিবর্তনসমূহ রোধ হবে এবং দেশ একটি অনভিপ্রেত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট থেকে রক্ষা পাবে।  

কাজেই ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে একটি বিদেশি ভাষানীতি প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়ানের মাধ্যমে বিদ্যালয় পর্যায় থেকে ঐচ্ছিক দ্বিভাষিক দক্ষতা ভিত্তিক বিদেশি ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।  

লেখক: অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ
পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট
ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
ভূতপূর্ব অভ্যাগত শিক্ষক, টোকি ও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।