ঢাকা, রবিবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জুন ২০২৪, ২২ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

ড. ইউনূস, দয়া করে আবারো ভেবে দেখবেন কি

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল, আয়ারল্যান্ড থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০১২
ড. ইউনূস, দয়া করে আবারো ভেবে দেখবেন কি

নিন্দুকেরা সবকিছুতেই সমালোচনা বা দোষ খুঁজে পান। ক’দিন আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের  একটি প্রতিনিধি দল আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংগে দেখা করতে গেলে প্রসঙ্গক্রমে তিনি তাদের কাছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাবনার মাধ্যমে তাদের সমর্থন কামনা করেন।



প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবটিকে ‘চমকপ্রদ’ আখ্যায়িত করে বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। অথচ আমাদের দেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী বিষয়টাকে ‘ঠাট্টা-মশকারির’ কথা বলে বেশ বিষোদগার করেছেন। বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ উপহাসের ব্যখ্যাও দাঁড় করান। তার মতে,  জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি যে প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্টের শিকে আমেরিকান ব্যতীত অন্য কারো কপালে ছেঁড়েনি সেখানে ওই পদে বাঙালি ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করা মানেই  উপহাসের শামিল।

উপহাস যখন আর উপহাস থাকছেনা বুঝতে পেরে কিছু বুদ্ধিজীবীও বেশ নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলেন। গত শনিবার একটি জাতীয় দৈনিকে উপসম্পাদকীয় পড়ে মনে হল, লেখক যেন ইউনূস সাহেবের একজন খাস বান্দা! প্রস্তাবটি নিয়ে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশ চালবাজি রয়েছে বিশ্লেষণ করে ড ইউনূস যেন এ ফাঁদে পা না রাখেন তারই কলাকৌশল তিনি বাতলেছেন পুরো লেখাটি জুরে। গুণধর এ বুদ্ধিজীবী কেবল সরকারের ধূর্ততা ও স্বার্থকেই বড়ো করে দেখলেন, কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের মতো একটি শক্তিধর প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট পদে এক বাংলাদেশির নিয়োগ প্রাপ্তি যে কতো বড়ো অর্জন হতে পারে তা তিনি একবারও ভেবে দেখার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। ধিক, শত ধিক এসব বুদ্ধিজীবী নামের জ্ঞানপাপীদের।

ড. ইউনূস শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে যে উদার ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে ‘অপ্রত্যাশিত সুসংবাদ’ ঊল্লেখ করেন বটে কিন্তু তার স্বীয় কর্মব্যস্ততার কথা বলে অত্যন্ত বিনয়ের সংগে তাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ১৯৯৫ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এ পদে তিনি যোগদান করতে আগ্রহী কিনা জানতে চাইলে একইভাবে তিনি বিনয়ী উত্তর দিয়ে নিজেকে দূরে রাখেন বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেন ইউনূস। সুতরাং মওদুদ সাহেবকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে অতি সহজেই বলা যায়, আমেরিকান না হয়েও ড ইউনূস ইচ্ছে করলে উল্লেখিত পদটি অনেক আগেই বাগিয়ে নিতে পারতেন।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডি ডব্লিঊ মজিনা রাজশাহী শিল্প ও বণিক সমিতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে জানান, ড. ইউনূস বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য যথার্থই একজন যোগ্য ব্যক্তি। তিনি যদি ওই পদে মনোনয়নের জন্য সম্মত হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণ সমর্থন দেবে। ড. ইউনূসের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ইতিবাচক বক্তব্য আমাদেরকে উৎসাহব্যঞ্জক করে তুললেও ইউনূসের নিজের অপারগতা আমাদেরকে অনেকটাই হতাশ করেছে।

২০০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি আয়ারল্যান্ডে একটি বিশ্বখ্যাত পাঁচতারা হোটেলে চাকরি করি। একদিন মার্কিন এক ভিআইপি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ড. ইউনূস সেখানে এলেন। হোটেলের রিসিপশন লবিতে আমাকে দেখেই নিঃসংকোচে বলে উঠলেন, ‘আরে মিয়া তুমি এখানে!’ পিঠ চাপড়ে এও বলেছিলেন, ‘তোমরা যারা বিদেশে থাকো, নীতি ও কর্ম ঠিক রেখে চলো। এতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ফুঠে উঠবে। ’

আমরা জানি, ইংরেজি বা অন্য ভাষাভাষীদের মাঝে থেকে পরস্পর দু’জন ব্যক্তির বাংলা বা অন্য কোনো ভাষায় কথা বলা বাকিদের জন্য অনেকটাই অস্বস্তিকর। ড. ইউনূস এ কথা জেনেও আমার সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলতে তাতে ভ্রূক্ষেপ করেননি। বাংলায় কথা বলেছেন। স্বজাত্যবোধের প্রতি তাঁর যে টান, তাই এতে ফুঠে উঠেছে।

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে যে প্রেস রিলিজ দিয়েছেন, সেখানেও তিনি একটা দেশপ্রেমের উদাহরণ টেনেছেন। ১৯৯৫ সালে বিল ক্লিনটন তাকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হতে বললে এর সূত্র ধরে এক মার্কিন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলো, ‘আপনি প্রেসিডেন্ট হলে প্রথম কী কাজটি করবেন?’ উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সদর দপ্তর ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তরিত করবো। ’ এ ধরণের সাহসী মন্তব্যে দৃঢ় দেশপ্রেমই ফুঠে ওঠে।

তবে, ড. ইউনূসের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে আমার সেই অসাধারণ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ আমি আশা করেছিলাম- স্বীয় দেশ ও জাতিকে বিশ্ব দরবারে মাথা ঊঁচু করে দাঁড় করাবার জন্য এ ধরনের একটি সম্মানজনক প্রস্তাবে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে ড. ইউনূস সম্মতি জ্ঞাপন করবেন। কিন্তু তিনি কেবল নিজস্ব কাজের কথা বিবেচনায় এনে যে অপারগতার কথা বললেন, তাতে আমার মতো অনেকেই আশাহত হয়েছেন।

বিশ্ব সামাজিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তার সাথে সহমত প্রকাশ করেই আমরা বলতে চাই, আপনি যে সামাজিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। সামাজিক ব্যবসাকে সবার কাছে পরিচিত করা, এর সফল বাস্তবায়ন করা, পৃথিবীর তরুণদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশাবাদী করে তোলা এবং নতুন পৃথিবী সৃষ্টিতে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার যে অদম্য আগ্রহ আপনার, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদের দায়িত্ব ভার নিলে তাতে হয়তোবা কিঞ্চিত ব্যত্যয় ঘটবে,তা অস্বীকার করি না। কিন্তু বিশ্ব সামাজিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বা এর সর্বোচ্চ পদে নিজেকে নিযুক্ত করার আগ পর্যন্ত সময়টুকু দেশ ও জাতির উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কথা বিবেচনায় এনে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণের সুযোগটি কি নেয়া যায় না!

জানি, আমার মতো নাদানের কথা হয়তোবা তাঁর মনেই নেই। প্রতিদিন কতজনের সঙ্গেইতো তাঁর দেখা হয়! তাঁর মনে না থাকারই কথা। কিন্তু তাঁর মতো একজন নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া কিংবা  কথা বলা এ সবই যে আমার কাছে অক্ষত স্মৃতি। আমাদের ক্রিয়াকলাপ বা নৈতিকতার মাধ্যমে প্রবাসে যেন নিজ দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তুলতে পারি,  এ কথা বলে তিনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন। আজ তাঁর সে কথার রেশ ধরেই অনুরোধ করে বলতে চাই, বিশ্ব ব্যাংকের মতো একটি প্রভাবশালী, বৃহৎ ও সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদটি লাভের যদি যথার্থ সুযোগ পান তবে তিনি অবশ্যই যেন সে সুযোগ হাতছাড়া না করেন।

তাঁর মত একজন বরেণ্য ও কৃতী ব্যক্তিত্ব বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদ অলংকৃত করলে বাংলাদেশের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে তেমনি তিনি নিজেও উন্নয়নশীল বিশ্বের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের উন্নয়নের ধারাকে আরো শক্তিশালী করতে সক্ষম হবেন। তাই ঈর্ষণীয় এ পদটি গ্রহণের ব্যাপারে সদয় সম্মতি জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তিনি পুনর্বিবেচনা করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।       

লেখকঃ আয়ারল্যান্ড প্রবাসী
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৯ ঘণ্টা, ০৪ মার্চ, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।