মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান দ্বিতীয় এবং বিশ্বের মধ্যে ৪১তম। আইএমএফের তথ্যের আলোকে সম্প্রতি কানাডাভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্টের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
করোনা মহামারির পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়ে। এতে দেশে দেশে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি, কমে আসে মানুষের জীবনযাত্রার মান। এ অবস্থায়ও রফতানি, রেমিট্যান্স, বিদ্যুতায়ন কিংবা আর্থসামাজিক খাতে বাংলাদেশ অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। আঞ্চলিক ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
অর্থনীতি-বিষয়ক পত্রিকা নিক্কেই সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংকটের ফলে মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে ফরেন রিজার্ভের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আরো টেকসই অবস্থানে গেছে দেশটি, যা সম্ভব হয়েছে দৃঢ় সিদ্ধান্তের কারণে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ রাজস্ব আদায়ের সুষম গতি ধরে রাখতে পেরেছে কারণ দেশটি করোনার প্রথম দুই ধাক্কার মধ্যেও খুব কড়াকড়ি আরোপ করেনি। দেশটি তার মুদ্রার মানের পতন ঠেকাতে মুক্তবাজারে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রয়েছে, যার ফলে যেকোনও দুর্যোগের পরিস্থিতি মোকাবিলায় তহবিল সংরক্ষণ করছে, পাশাপাশি সতর্কভাবে রাজস্ব ঘাটতি এবং চলতি হিসাবের ভারসাম্য পরিচালনা করে আসছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগার সঙ্কুচিত হওয়া এবং বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অংশ একই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। মালদ্বীপ বাহ্যিক এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ধাক্কাগুলির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং জিডিপি অনুপাতের সাথে এর ঋণ শতভাগ ছাড়িয়ে গেছে। দুর্বল আর্থিক শৃঙ্খলা, দূরদর্শিতার অভাব এবং অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্পের কারণে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে। পাকিস্তানও শ্রীলঙ্কার পথে রয়েছে কারণ জানুয়ারিতে তার ঋণের জিডিপি অনুপাত ছিল ৩৫ শতাংশ এবং ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশটির মতো একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতও মুদ্রাস্ফীতি থেকে মুক্ত নয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে খুচরা মূল্য প্রায় ৭.৮ শতাংশ বেড়েছে।
ফিনান্সিয়াল টাইমসের সাবেক এশিয়া সম্পাদক ডেভিড পিলিং এক নিবন্ধে লিখেছেন, নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই গত তিন যুগে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে আটগুণ। শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত ব্যয়ের সক্ষমতা অর্জন করেছে পরিবারগুলো। শিল্পখাতে অর্থসরবরাহ বাড়ানোর পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে ব্যাংকগুলোতে। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ অর্জন করেছে অসামান্য সাফল্য। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাড়ছে নারীদের অংশগ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র প্রসঙ্গ তুলে ধরেন ডেভিড পিলিং বলেন, বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য। নিবন্ধে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের ৩২ মিলিয়ন ডলার থেকে পোশাক খাতের রফতানি আয় ছাড়িয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। অনেকে বাংলাদেশের আকাশে শ্রীলংকার ছায়া দেখছেন, আবার কেউ কেউ উল্লেখ করছেন দেশ শ্রীলংকার পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে, কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে অন্য মেগা প্রকল্পগুলো গৃহীত হয়েছে। আর শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে’।
তিনি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ঋণ নিচ্ছে। তবে তা যাতে বোঝা হয়ে না ওঠে সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। আমাদের মূল লক্ষ্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সম্পদ বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করা।
১০৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক জিডিপির ভিত্তিতে ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্ট ১৯১ দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৩৯৭ বিলিয়ন বা ৩৯ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র ভারতই বাংলাদেশের উপরে রয়েছে। দেশটির জিডিপির আকার ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতি। দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩১ সালে বাংলাদেশে এমন কেউ থাকবে না যাকে অতি দরিদ্র বলা যাবে। বাংলাদেশ সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়নের পথে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বর্তমান শুল্ক এবং কোটামুক্ত সুবিধা শুধুমাত্র ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইইউ বাজারে পাওয়া যাবে।
হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তবে এখানে যে দাম বাড়ানো হয়েছে, তা নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া বাড়ানো হয়নি। যতদিন সম্ভব ছিল আওয়ামী লীগ সরকার ততদিন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করেনি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিগত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রিতে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশে ভোক্তারাও তার সুফল পাবেন। সারা বিশ্বে এখন দাম কমে আসছে। সব জায়গায় কমা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশও কম দামে কেনা শুরু করেছে। এগুলো যখন দেশে এসে পৌঁছাবে, তখন চাপ থাকবে না। তখন দেশের ভোক্তারা কম দামে জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে পারবেন।
এ বছরের শেষ নাগাদ ঢাকার উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে মেট্রোরেল চালু হবে। মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। অক্টোবরে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হতে পারে দেশের প্রথম টানেল। এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট আগামী বছরের শেষ নাগাদ। তাই সরকারকে অতীতের মতোই শুধুমাত্র প্রকৃত উন্নয়ন খাতে, আয়বর্ধক সম্ভাবনাময় খাতে, দারিদ্র বিমোচন খাতে প্রকল্প নিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০২২
টিসি