পহেলা অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস। আমিও প্রবীণ।
বাংলাদেশে ষাট বা তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের প্রবীণ নাগরিক হিসেবে অভিহিত করা হয়। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর আট শতাংশ প্রবীণ, অর্থাৎ প্রায় এক কোটি ত্রিশ লক্ষের মতো। এই দিনে আমি সকল প্রবীণদের জানাই অভিনন্দন, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যারা আজ ষাট বছরে উপনীত হয়েছেন বা ইতিমধ্যে সেই স্বর্ণফলক স্পর্শ করেছেন। সবার এই ভাগ্য তো হয় না।
আজ যারা প্রবীণ, তাদের সময়ে তারা পরিবারের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। প্রয়োজনে বাঘের মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন, পাড়ি দিয়েছেন সাগর, হিমালয় ডিঙ্গিয়েছেন হেলায়। আজ ক্লান্ত অবসন্ন শরীর, চোখের জ্যোতি গেছে কমে, অল্পতেই আসে ক্লান্তি। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ-ব্যাধি। তার ওপর উপার্জনও নেই। এই হচ্ছে প্রবীণদের সত্যিকারের অবস্থা, কি পুরুষ-কি নারী।
আর্থিক ও অবস্থানভেদে এই প্রবীণ নাগরিকদের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। শহুরে ও গ্রামীণ প্রবীণদের সমস্যা ভিন্ন। আবার উচ্চবিত্ত, সচ্ছল ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের সমস্যারও ভিন্নতা আছে।
অসচ্ছলদের প্রধান সমস্যাগুলো হচ্ছে- আর্থিক অনটন, সন্তান কর্তৃক অবহেলা ও অত্যাচার এবং শারীরিক রোগ-শোক ও স্বাস্থ্যসেবার সংকট। যদিও পিতা-মাতাকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আইন আছে। তা সত্ত্বেও অনেক পিতা-মাতা সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন না।
সচ্ছল ও উচ্চবিত্তদের প্রধান সমস্যা একাকিত্ব ও শারীরিক অসুখ-বিসুখ। সন্তানরা বিদেশে বা অন্য জায়গায় থাকেন, বুড়োবুড়ি একা গ্রামের বাড়িতে বা শহরে। দেখাশুনা করার কেউ নেই। আগে সেবা-শুশ্রুষা করার জন্য সাহায্যকারী পাওয়া যেত। এখন অধিকাংশই গার্মেন্টস বা অন্য জায়গায় কর্মজীবী।
পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় যখন স্বামী বা স্ত্রী মারা যান। নিঃসঙ্গতা তখন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এই অবস্থায় পুরুষ কিংবা মহিলা যদি আবার বিয়ে করতে চায় তখন সমাজের বক্রোক্তি শুনতে হয়। সবচেয়ে বেশি বাধা আসে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে। ওদের সময় দেওয়ার সামর্থ্য বা ইচ্ছা নেই। অথচ এই প্রবীণরা একাকী কি নিয়ে বাঁচবে-সেটা নিয়ে চিন্তা নেই।
কথায় বলে, রক্ত দেওয়ার জন্য রক্ত লাগে না; কলিজা লাগে। মানবজীবনে বার্ধক্য একটি প্রাকৃতিক পর্যায়। এটাকে আমরা কিভাবে গ্রহণ করবো, তা নির্ভর করছে আমাদের মানসিকতার ওপর। বর্তমান প্রজন্ম তাদের প্রবীণদের কি বোঝা হিসেবে নিবে, নাকি সম্পদ হিসেবে নিবে। যখন সময় ছিল প্রবীণরা (তখনকার তরুণরা) তাদের সময়, শ্রম ও আন্তরিকতা দিয়ে পৃথিবীকে বর্তমান পর্যায়ে রেখেছে।
এখন বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব, এই প্রবীণদের দেখভাল করা। এটা এক অর্থে এক রকমের ইন্স্যুরেন্স। বর্তমান প্রজন্ম যদি প্রবীণদের জন্য কিছু করার মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করে, পরবর্তী প্রজন্মও তাদের পাশে থাকবে।
শুধু সরকার প্রবীণদের সব সমস্যা সমাধান করে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। সীমাবদ্ধতা আছে। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতার, জাগরণের। সরকার এখন প্রায় ৪৪ লক্ষ বয়স্কদের মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয়। ভবিষ্যতে এটা এক কোটিতে নিয়ে যাওয়া পরিকল্পনা আছে।
টাকা ছাড়াও প্রবীণদের জন্য অনেক কিছু করা যায়। যেমন: বাস-ট্রেনে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখা। বিমানবন্দর, শপিংমল, হাসপাতাল ও ব্যাংকে প্রায়োরিটি সার্ভিস দেওয়া ইত্যাদি। প্রবীণদের চিকিৎসা সেবার জন্য কমিউনিটি হোম ডেলিভারী সার্ভিস অত্যন্ত উপকারী হবে। প্রতি ওয়ার্ডে বা চার-পাঁচ ইউনিয়নে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র থাকলে সেখান থেকে প্রয়োজনে বাসা বা বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা দেওয়া যায়। প্রবীণদের দেখাশুনা ও চিকিৎসার জন্য অনেকে প্রবীণ নিবাস, বৃদ্ধাশ্রম, মোক্ষধাম ইত্যাদির কথাও আলোচনায় আসে। প্রবীণ নিবাস আর বৃদ্ধাশ্রম এক কথা নয়। অনেকের টাকা-পয়সা সব আছে। সন্তানরা হয়তো বিদেশে বা নাই। এ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী একটা বাড়িতে একা থাকাও সমস্যা। এক্ষেত্রে তিনি টাকা দিয়ে প্রবীণ নিবাসে থাকার ব্যবস্থা করে নেন। এখানে স্বেচ্ছায় প্রবীণরা যেতে ইচ্ছুক। এখানে স্বাস্থ্য পরিচর্যা, সমবয়সীদের সাথে মেলামেশা, নিজস্ব মতামতের মূল্য-সবই আছে। আবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হয় অনেক প্রবীণকে, যা অত্যন্ত অনৈতিক কাজ। আমি এই কাজের ঘোর বিরোধী।
প্রবীণরা সমাজের বোঝা নয়, তারা অলংকার। হয়তো শারীরিকভাবে তারা কাজে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আমাদের দেশে অনেক বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আছে। তারা যদি চান তাহলে তাদের সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি) দিয়ে এই প্রবীণদের জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন। আমরা সমাজে অনাথ আশ্রম, এতিমখানা এসওএস পল্লী ইত্যাদি দেখি। সেই আদলে প্রতি ইউনিয়নে যদি একটা প্রবীণ বাড়ি করা যায় তাহলে এই প্রবীণদের অনেক উপকার হয়। সেই প্রবীণ নিবাসের নামে কিছু খাস জায়গা বরাদ্দ পেলে গরু-ছাগল বা হাঁস- মুরগীর খামার করে তারা তাদের রোজগারে চলতে পারবে।
প্রবীণ ব্যবস্থাপনা বর্তমানে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তাদের অনেক দায়িত্বের মধ্যে প্রবীণ সেবাও একটি। দেশের আট শতাংশ মানুষের যে দায়িত্ব সেই দায়িত্ব দিয়ে আলাদা একটা মন্ত্রণালয় করা জরুরি। তারা দেশের প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত থাকবেন আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবীণদের নিয়ে কাজ করা সব সংস্থাগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে একসাথে কাজ করতে পারেন।
যেহেতু প্রবীণদের অনেক কিছুই আর্থিকভাবে সংশ্লিষ্ট। তাই অন্যান্য বন্ডের মতো প্রবীণ স্কীম বা বন্ড ছাড়া যেতে পারে। অথবা প্রবীণ স্কীম। চল্লিশোর্ধ্ব যে কোনও ব্যক্তি মাসে মাসে টাকা জমা করবেন। ষাট বছর পূর্ণ হলে তাকে লাভ সমেত ফেরত দেওয়া হবে। আর লাভের বাড়তি টাকা সরকার প্রবীণদের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারবে। অনেক দেশে প্রবীণ সার্ভিস ব্যাংক আছে, যেখানে প্রবীণদের যত ঘণ্টা যে সেবা দিবেন সেই সেবা আপনার সময়ে আপনি পাবেন বা সমমূল্যের অর্থ পাবেন।
যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। প্রবীণ হয়েছি বলে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে শুয়ে থাকলে চলবে না। প্রবীণদের প্রথম কাজ হচ্ছে নিজেকে যতদূর পারা যায় সুস্থ রাখা। এই ব্যাপারে কোনও ছাড় নেই। প্রতিদিন যতটুকু সম্ভব হাঁটাহাঁটি করুন, ইচ্ছে হলে যোগব্যায়াম বা প্রাণায়াম করুন। অবহেলা করলে নিজেরও কষ্ট হবে অন্যদেরও কষ্টে ফেলা হবে। যেটা করলে আপনার ভালো লাগে, সেটাই করুন। সবসময় কোনও না কোনও কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করুন। দেখবেন, আপনার জীবন আনন্দময় হয়ে উঠবে। প্রবীণ হলে ছেলে-মেয়েরা দেখবে, এই সনাতন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ছেলে-মেয়েরা অবশ্যই দেখবে। কিন্তু নিজের বার্ধক্যের পরিকল্পনা নিজেই করুন।
আজ আপনি অনেক আয় করেন। কিন্তু একসময় আপনার আয় আর থাকবে না। তখন আপনি কিভাবে চলবেন তার চিন্তা করা দরকার। তাই ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করুন। প্রবীণদের কল্যাণে শুধু রাষ্ট্র, সমাজ বা পরিবারের ওপর দায় চাপালে হবে না, বরং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রবীণদের সত্যিকার মঙ্গল সম্ভব।
লেখক: ভাইস চেয়ারম্যান, দীপ্ত ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন
[email protected]